শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র যাঁকে ভবপারের কান্ডারিরূপে দর্শন করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। গিরিশচন্দ্র জানতেন এমন পাপ নেই যা তিনি করেননি। তবু তিনি অহংকারের সঙ্গে বলতেন, ‘তুমি আসবে আগে জানলে আরও বেশি করে অপচার করে নিতুম।’ আরও বলতেন গিরিশচন্দ্র ‘ঠাকুরের কাছে আর সকল শুদ্ধসত্ত্ব ছেলেরা এসেছিল; আর এমন পাপ নেই যা আমি করিনি। তবু তিনি আমায় গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কিছু নিষেধ করেননি, সব আপনি ছুটে গেল।’ এসবই সত্যি কিন্তু শুধু পাপ বিমোচন-এর দিক থেকে গিরিশচন্দ্রকে দেখলে অন্যায় হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে সেই দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি দেখেছিলেন তাঁর ভৈরব এক হস্তে সুধা পাত্র অপর হস্তে সুরা ভাণ্ড নিয়ে মায়ের মন্দিরে উপস্থিত। গিরিশচন্দ্র ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকের ভেতর দিয়ে যে সুধা বিতরণ পূর্বক বঙ্গবাসীকে তৃপ্ত করেছিলেন, ঠাকুরের সান্নিধ্যে পরে সে সুধা আরও অকাতরে বিতরিত হতে লাগল। ঠাকুর বলেছিলেন গিরিশকে ‘তুমি যা করছ তাই করো। ওতে লোকশিক্ষা হবে।’ আর ঠাকুর মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, মা যেন গিরিশকে লোকশিক্ষার জন্য শক্তি দেন। ঠাকুরের পক্ষে এত কাজ করা অসম্ভব। জগন্মাতা সে প্রার্থনা শুনেছিলেন।

বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার-এর দ্বিতীয় অবদান হল গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটক ‘ধ্রুবচরিত্র’। এটি প্রথম অভিনীত হয় ১৮৮৩ সালের ১১ আগস্ট শনিবার। গিরিশচন্দ্র তাঁর এই ধ্রুবচরিত্র পৌরাণিক নাটকের আখ্যানভাগ মূলত দুটো সংস্কৃত মহাপুরাণ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমটি মহর্ষি বশিষ্ঠের পুত্র পরাশরের লেখা বিষ্ণুপুরাণম। আর অপরটি হল মহর্ষি ব্যাসদেব-এর লেখা বিখ্যাত মহাপুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতম্। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধ্রুবচরিত্র নাট্য কাহিনিতে বিষ্ণুপুরাণ অপেক্ষা ভাগবতের প্রভাব বেশি দেখা যায়।
অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ‘ধ্রুবচরিত্র’ নাটক রচনার উৎস প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্রের কথকতা শক্তির অবতারণা করেছেন। তিনি লিখছেন, ”সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা ও নাট্যকার স্বর্গীয় কেদারনাথ চৌধুরি মহাশয় কলিকাতার বাসাবাড়িতে একদিন কথকতা সম্বন্ধে প্রসঙ্গ ওঠে। গিরিশবাবু বলেন, ‘কথকতা বড় কঠিন, একই ব্যক্তিকে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করিতে হয়। বিশেষরূপ যোগ্যতা না থাকিলে প্রত্যেক চরিত্রের বিভিন্নতা দেখাইতে পারা বড় কঠিন, তার উপর সাজসরঞ্জাম দৃশ্যপট ও সহকারী অভিনেতাদের সহায়তা থাকে না।’ কেহ বলিলেন, ‘সুনিপুণ হইলেও একই ব্যক্তি কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় বিশেষত কণ্ঠস্বরের বিভিন্নতা প্রদর্শন কদাচ সম্ভবপর নহে।’ গিরিশচন্দ্র বলিলেন, ‘আচ্ছা কাল আমি কথকতা করিয়া তোমাদিগকে শুনাইব। চরিত্রগত পার্থক্য দেখানো যায় কি না, কণ্ঠস্বরের বৈলক্ষণ্য হয় কি না এবং রসের অবতারণায় শ্রোতাকে মুগ্ধ করা যায় কি না, তোমরাই বিবেচনা করিয়া দেখিবে।’

‘তৎপর দিবস কেদারবাবু বন্ধুবান্ধব নিমন্ত্রণ করিয়া বাসায় একটি ক্ষুদ্র উৎসবের আয়োজন করেন। গিরিশ কথকতা করিবেন শুনিয়া ৫০-৬০ জন ভদ্রলোক একত্র হন। গিরিশচন্দ্র ধ্রুবচরিত্রের কথা বলেন। বিভিন্ন রসে, বিভিন্ন ভাষায় এবং বিভিন্ন ভঙ্গিতে প্রত্যেক চরিত্রের বিভিন্ন অভিনয়ে সেদিন সকলেই এক অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করিয়াছিলেন। এইসকল শ্রোতার অনুরোধে গিরিশবাবু পরে ‘ধ্রুবচরিত্র’ নাটক রচনা করেন।’

কেবলমাত্র পৌরাণিক নাটক বললে সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে না। ‘ধ্রুবচরিত্র’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া সমস্ত নাটকই ভক্তিরসাত্মক বা ভক্তিমূলক। অনাবিল হরিভক্তি প্রচারে এই নাটকের মূল উদ্দেশ্য। হরিভক্তি এর অন্তরস্বরূপ, হরিভক্তি এর হৃদয় স্পন্দন। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্রের একাধিক নাটকে হরিভক্তির যে প্রাধান্য দেখা যায় এবং সেই সময়ের বঙ্গরঙ্গভূমিতে হরিভক্তির প্রবল বন্যা বইয়ে দর্শকমণ্ডলীকে মাতোয়ারা করে তুলেছিল, ‘ধ্রুবচরিত্র’ নাটকে তারই সূচনা হয়েছে। সেই জন্য এই সময়ের এবং পরের পৌরাণিক নাটকগুলিকে ‘ভক্তিমূলক পৌরাণিক নাটক’ বলাই সংগত।

আলোচ্য নাটকে বিদূষক চরিত্রটি গিরিশচন্দ্রের দ্বিতীয় সংযোজন। নাট্যকারের এই শ্রেণিচরিত্র সৃষ্টি এটাই প্রথম প্রয়াস। সংস্কৃত নাটকের আদর্শেই মূর্খ, লোভ সর্বস্ব, রাজার প্রেমের সহায়ক পার্ষদরূপে বিদূষক চরিত্রটি এই ধ্রুবচরিত্র নাটকে অঙ্কিত করা হয়েছে। আলোচ্য নাটক অগণিত দর্শকমণ্ডলী সমাদৃত স্টার থিয়েটার-এর একটি মঞ্চসফল নাটক। প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী আপন আপন ভূমিকায় নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিখ্যাত গায়িকা ও অভিনেত্রী ভূষণকুমারী ধ্রুবচরিত্র নাটকে ধ্রুব চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর অভূতপূর্ব অভিনয় ও মনোমুগ্ধকর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে দর্শক সমাজকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিলেন। ‘ধ্রুবচরিত্র’ নাটকের অন্যতম আকর্ষণ সহজ-সরল সর্বজনবোধ্য ভাষায় রচিত অনবদ্য সংগীত গুচ্ছ। আগের নাটক দক্ষযজ্ঞ নাটকটিরও সুরকার ও সংগীত শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট সংগীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী ওরফে বেণীওস্তাদ। বিভিন্ন রাগে ও তালে সুগঠিত করে নাটকের সমস্ত গানে তিনি অপূর্ব সুর সংযোজন করেন। এই নাটকে সর্বমোট ২৫টি গান। ২৫টি গানের মধ্যে ধ্রুবরূপী অভিনেত্রী ভূষণকুমারীর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তিনি একক কণ্ঠে গেয়েছেন দশটি গান। এই নাটকে ধ্রুবের পরেই সুনীতির উল্লেখ করা যায়। সেকালের বিখ্যাত গায়িকা-অভিনেত্রী কাদম্বিনী এই চরিত্রের শিল্পী। তিনি একক কণ্ঠে গেয়েছেন পাঁচটি গান। নাটকের অনেক গান সমকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলি হল ‘ফুলে পূজা হবে তা তো’, ‘বালকে বিপদে রাখো রাঙাপদে’, ‘হরিনামের ঢেউ’, ‘গহন মাঝারে ডাকিছে তোমারে’, ‘প্রেমে ডাকো হরি বলে’, ‘আয়রে আয় হরি বলে বাহু তুলে নেচে আয়’, ‘নাচো বনমালী দিব করতালি’, ‘হরি শ্যাম মুরলীধারী’ প্রভৃতি। ধ্রুবচরিত্র নাটকের প্রথম অভিনয় রজনীতে বিভিন্ন ভূমিকায় যাঁরা অভিনয় করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ধ্রুব চরিত্রে ভূষণকুমারী, বিদূষক অমৃতলাল বসু, মহাদেবের চরিত্রে উপেন্দ্রনাথ মিত্র, ব্রহ্মা চরিত্রে নীলমাধব চক্রবর্তী, সুনীতি চরিত্রে কাদম্বিনী, সুরুচির চরিত্রে বিনোদিনী প্রমুখ শিল্পী। ‘ধ্রুবচরিত্র’ নাটক সেই সময়ে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content