রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

গিরিশচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে এসে উপস্থিত হয়েছেন আর গড়িমসি করলেন না একেবারে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে। দক্ষিণের বারান্দায় একখানি কম্বলের উপর বসে আছেন ঠাকুর। ঠাকুর গিরিশচন্দ্রকে দেখেই বললেন, ‘এসেছিস? আমি জানি তুই আসবি৷ বসে পড় আমার কাছে।’ ঠাকুরের পায়ের কাছে বসে পড়লেন গিরিশ। বললেন, ‘আপনি জানেন না আমি কত বড় পাপী। আমি যেখানে বসি সাত হাত মাটি পর্যন্ত তলিয়ে যায় পাপের ভারে।’ ঠাকুর গিরিশচন্দ্রের কথা শুনে বললেন, ‘তাই নাকি?’ অভয়মাখা হাসি দিয়ে বললেন, ‘তুই এত পাপী যে পতিতপাবন সে পাপ হরণ করতে পারবে না, তাই নাকি।’ গিরিশচন্দ্র তখন ঠাকুরকে বললেন, ‘আমি যে পাপের পাহাড় করেছি ঠাকুর।’ তার উত্তরে ঠাকুর বললেন, ‘পাহাড় করেছিস নাকি? ও তো তুলোর পাহাড়। একবার মা বলে ফুঁ দে, ঠিক উড়ে যাবে।’

গিরিশচন্দ্র ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন থেকে আমি কী করব ঠাকুর?’ ঠাকুর অভয় দিয়ে বললেন, ‘যা করছিস তাই করলে হবে।’ গিরিশচন্দ্র উত্তরে বললেন, ‘কী করছি বই লিখছি। ধারণা নেই, লিখেই চলেছি অভ্যাসবশে।’ পতিতপাবন ঠাকুর বললেন, ‘বই লেখাটাও কর্ম৷ কর্ম না করলে কৃপা পাবে কী করে? জমি পাট করে রুইলেই তো জন্মাবে ফসল। তবে কী জানিস একটু স্মরণ মনন চাই। এটি হচ্ছে যুক্ত হওয়ার সেতু।’ ঠাকুর আরও বলে চলেছেন, ‘সকাল-বিকেল স্মরণ মনন একটু রাখিস। কীরে পারবিনে?’ মুষড়ে পড়লেন গিরিশচন্দ্র।

এ আবার কী বাঁধাবাঁধি। সকালে কখন ঘুম থেকে ওঠেন তারই ঠিক নেই। বিকেলে থিয়েটারে নয় অন্য কোথাও। স্মরণ মননের সময়টা কোথায়? নিজের মনেই গিরিশচন্দ্র বলে চলেছেন, ‘বহুদিনই সকালের সঙ্গে দেখা হয় না। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে দুপুর আর বিকেল?’ গিরিশচন্দ্র কুণ্ঠিত মুখে বললেন, ‘বিকেল যেখানে কাটে সেখানে আরেকরকম মোহনিদ্রা।’ ঠাকুরও ছাড়ার পাত্র নন। ‘বেশ, তাহলে খাবার আগে?’ ঠাকুরের কত দায় অমনিভাবে বলছেন কাতর হয়ে ‘না খেয়ে থাকতে পারবি না। বেশ তো খেতে বসে একটু নাম করিস মনে মনে।’ গিরিশচন্দ্র ভাবছেন রোজ তিনি খান তো? এমন একেকটা দিন গেছে, কাজে-কর্মে খাওয়াই হয়নি। কোনওদিন দশটায় কোনওদিন বা বিকেল তিনটে চারটে। কোনও কোনও দিন কতকগুলো শিঙাড়া কচুরি খেয়ে দিন কেটেছে। থিয়েটারে আবার খাওয়া-দাওয়া? তাই কোনওরকমে খেয়ে নিলেই হল। তাই তিনি বললেন, ‘ও আমি পারব না।’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে গিরিশচন্দ্র আরও বললেন, ‘খাওয়ার আমার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। তাছাড়া খিদের সময় খাবার পেলে আর কিছু তখন মনে থাকে না।’ তবু ঠাকুর হাল ছাড়েননি। সেই মমতাভরা কণ্ঠে বললেন, ‘বেশ তো শোবার আগে? শুতে না শুতেই তো ঘুম আসে না। অন্তত কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই হয়। তখন সেই এক আধ মিনিট সময়টুকুর মধ্যেই একটু নাম করে নিস।’

গিরিশ মনে মনে বলে চলেছেন তার আবার ঘুম? কোথায় শুয়ে পড়েন ঠিক নেই। কোন বিছানায়? কার বিছানায়? তারও ঠিক নেই। মাথা হেঁট করে রইলেন গিরিশচন্দ্র। বললেন, ‘আমার ঘুম আসে না। ঘুম যদি না আসে কী করে স্মরণ মননে?’ একটার পর একটা ঠাকুরের এই যে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন, এত বাজে লাগছে গিরিশের, বলার নয়। শুধু জপ করতে বলেছেন। তাও তিনি পারবেন না। চোখ পর্যন্ত বুজতে হবে না। একটু শুধু ভাব। কিন্তু ঠাকুর যাঁকে কৃপা করেছেন তিনি কী করে ছাড় পাবেন ঠাকুরের কাছ থেকে? ঠাকুর তাই বলছেন, ‘বেশ তোকে কিছুই করতে হবে না। তুই আমাকে শুধু বকলমা দে।’ এ কথার মানে বুঝতে পারলেন না গিরিশচন্দ্র। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার মানে?’ তখন ঠাকুর বলছেন, ‘তার মানে তোকে কিছুই করতে হবে না। তোর ভার আমার উপর ছেড়ে দে। তোর হয়ে আমি নাম করব। তুই শুধু কলম ছুঁয়ে দে আমি সই করব তোর হয়ে।’ এর থেকে বেশি আর কী চাই?

এইভাবে গিরিশচন্দ্রকে ঠাকুর কৃপা করেছিলেন। তিনি ধুলো মুছে কোলে তুলে নিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্রকে। তাই গিরিশচন্দ্র বলছেন মনে মনে আমি কি হরি টরি কাউকে চিনি। আমি চিনি তোমাকে। তোমাকে বকলমা দিয়েছি। তুমি নিয়েছ আমার ভার। তুমি আমার ভারহরণ।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্মদিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। আজকের এই ৪ মার্চ শুক্রবার রামকৃষ্ণদেবের তিথি পুজো উপলক্ষে গিরিশচন্দ্রের উপর ঠাকুরের কৃপার এই বর্ণনা করলাম পাঠকদের জন্য। ঠাকুরের পায়ে শতকোটি প্রণাম।

Skip to content