মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

অফিস কাচারিতে এখন কারও মুখ তোলার সময় নেই। কারণ অর্থনৈতিক বছর মার্চ মাসে শেষ হবে, আর এপ্রিল থেকে শুরু হবে নতুন বছর। অন্যদিকে স্কুলগুলিতে পরীক্ষা চলছে। এদিকে মায়েরা যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ (সিসিএল) এর জন্য আবেদন করেছেন। এবার এই নিয়ে শুরু হয়েছে চিৎকার চেঁচামেচি। অভিযোগ মহিলা সহকর্মীদের প্রতি যে, তাঁরা এই কাজের চাপের সময় কেন ছুটির আবেদন জানাচ্ছেন। এ রকম উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ৮ মার্চ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করি। কড়াইতে তেল বেশি গরম হয়ে গিয়েছে। এবার তাতে ফোড়ন দিয়েছি, ব্যাস ঝাঁজে কেশে মরছে সারা বাড়ির লোকজন। বেড়ালগুলোও পালিয়েছে। আমি খুন্তি হাতে দাড়িয়ে ভাবছি নারী দিবস উদযাপনের কিছু প্রভাব কি আমাদের রোজকার জীবনে পড়ছে!
উদযাপনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা যদি ভাবি নারী দিবস উদযাপন উদার অর্থনীতির প্রভাবে এই উপমহাদেশে এসেছে তাহলে, একটু ভুল ভাবা হয়ে যাবে। তবে এটাও ঠিক এই উদযাপন উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে প্রথম শুরু হয়েছিল। তারপর আমাদের দেশে ঢেউ এসে পড়েছে এবং বেশ জোরেই পড়েছে। এ বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি সরোজিনী নাইডুর জন্মজয়ন্তীতে জাতীয় নারী দিবস উদযাপন করেছি। সরোজিনী নাইডু গান্ধীজির সঙ্গে আলোচনা করে অনুমতি আদায় করেছিলেন লবণ সত্যাগ্রহতে ভারতীয় নারীদের আংশগ্রহণের বিষয়ে। আসলে এই অংশগ্রহণ করার অনুমতি আদায়ের মধ্যে দিয়ে সরোজিনী নাইডু রান্নাঘরের সঙ্গে ‘পাবলিক স্পেস’ এর মধ্যে যে যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সংযোগ আজও ভারতীয় নারীকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লড়াই করতে ভিতর থেকে সাহায্য করছে, খালি চোখে আমরা হাতরাসের কিংবা নির্ভায়ার মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৯: অষ্টবক্র শরীর— পুরুষের সমাজে পুরুষ শরীর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১০: পেটের গ্যাস সারা দেহেই ঘুরে বেড়ায়!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

আসলে নারীরা নিজেদের অস্তিত্ব এবং অধিকার দুটো বিষয়কে এক সুত্রে বাঁধতে চাইছেন খুব সুচতুর ভাবে। তবে এখনও তাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের লোহার জালের উপরে সজরে আছড়ে পড়ার ব্যথা থেকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। তাই বিশ্বের ইতিহাসে নারীদের লড়াই যা নতুন গড়ে ওঠা শিল্পসমাজে শুরু হয়েছিল, সেই বিষয়গুলি আবার তুলে ধরতে হবে। যাতে সব স্তরের নারীদের মনে নতুন ধারার লড়াইয়ের ভাবনা জেগে ওঠে।

বিংশ শতাব্দির গোড়াতে প্রথমে উত্তর আমেরিকাতে অল্প সংখ্যক নারী আওয়াজ তোলেন যে, কেন তাঁদের দাস ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতি আদায়ের পরে তাঁরা আরও বেশি সংখ্যায় একত্রিত হয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে নারী শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে তীব্র আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই নারীদের মধ্যে ভাবনার উদয় হয় যে, তাঁদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সমাজের সামাজিক বিভাজনকে পাশে রেখে একত্রে সমান অধিকারের জন্য দিবস পালন করতে হবে। সেই ধারা আজও অভ্যাহত আছে। সেই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীদের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করাও কমে যায়নি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

স্বাদে-গন্ধে: রোজকার খাবার একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে? বাড়িতে সহজেই বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালং পনির

ভারতীয় উপমহাদেশে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়ে থাকেন নারীরা। কৃষি শ্রমিক হিসেবে কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ব্যবস্থাতে তাদের এই অবদানকে সরাসরি স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এখনও বহু নারী প্রতি শ্রমিক দিনে খুবই অল্প মজুরিতে কাজ করে থাকেন। শহরাঞ্চলে যদিও বা একটু মজুরি বেশি পেতে পারেন। তবে সেখানে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বেশি। কিন্তু গ্রাম মফঃস্বলে খুব কম মজুরিতে তাঁদের রাজি হয়ে যেতে হয়। এর পরেও নারীদের বাড়ি ফিরে গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে হয়। বাচ্চাদের দেখাশুনো করতে হয়। সারাদিনের কাজের মজুরি কম হওয়ার কারণে বেশি পরিশ্রম করতে হয়, ফলে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের ধৈর্য ধরে খাওয়ানোর সময় দিতে অপারগ হন। তখন তাঁরা ফাস্টফুড খাওয়াতে শুরু করেন। ফলে বাচ্চা অপুষ্টতে ভুগতে শুরু করে।

খবরের কাগজে এই সব রিপোর্ট ছাপা হয় বটে কিন্তু আমরা খুব একটা কিছু করে উঠতে পারি না। নারী দিবসে ছাড়ের বিজ্ঞাপন দেখে আমরাই আপ্লুত হয়ে যাই। আমরা তখন ভাবতে থাকি এই নারী দিবস উপলক্ষে কিছু তো পুঁজিপতিরা ভাবনা চিন্তা করেছে। এই ভাবতে থাকার আর একটি ছবি দেখলাম খবরের কাগজে। জানা যাচ্ছে, একটি বেসরকারি হাসপাতেলের মহিলা চিকিৎসকেরা একটি আলোচনাচক্রে অংশ নিয়েছেন। আলোচনার বিষয় ছিল, এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের ফলে মহিলারা কখনও পরিবারকে অবহেলা করেছেন কিনা। আশ্চর্যজনক ভাবে মহিলা চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা সবসময় পরিবারকে পাশে পেয়েছেন। কিন্তু যেটা উঠে এল না প্রতিবেদনে, সেটা হল এই মানুষগুলো পরিবার বলতে শুধুই যদি বিসমকামিতার পরিবার বোঝায় তাহলে কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এই দাবির মধ্যে অনেক সমঝোতা আছে, যা তাঁরা প্রকাশ্যে আনতে পারছেন না। হয়তো নিজেদের সচেতনতার অভাবে কিংবা নিজেরাই এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের অবস্থানকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, আর্থারাইটিসের ব্যথায় দীর্ঘ দিন কষ্ট পাচ্ছেন? স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

ইংলিশ টিংলিশ : ‘R’-এর রকমারি উচ্চারণ— জানো তো form আর from এর মধ্যে তফাত কী?

রেণু খাতুনের কথা আমরা ভুলে যাই কী করে? আমরা অজান্তেই কিছু মানুষকে ফেলে চলে যাচ্ছি না তো? এই ফেলে রেখে চলে না যাওয়ার অঙ্গীকার থেকেই ১৯১০ সালে কোপেনহেগেন শহরে কর্মরতা মহিলাদের এক অধিবেশনে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ক্লারা জেটকিন প্রথম এই বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, মেয়েদের বিশ্বব্যাপী একটি নির্দিষ্ট দিন উদযাপন করতে হবে। কারণ তাতে নিজেদের দাবি-দাওয়াগুলো নিয়ে জোরদার প্রভাব বিস্তার করা যাবে সরকারের উপর। সমাজের উপর।

১৯১১ সালে নিউইয়র্ক শহরে ১৪০ জন নারী শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন আগুনে পুড়ে গিয়ে। নারী আন্দোলনকারীদের মধ্যে খুব আলোড়ন ফেলে দেয় এই মর্মান্তিক ঘটনাটি। হেলেন টড প্রতিবাদের ভাষাতে নতুন অভিঘাত এনে বললেন, নারীদের ‘ব্রেড অ্যান্ড রোজেস’ এই দুটি দাবি করতেই হবে। সমাজকে নারীদের খাবার, ভালোবাসা ও যত্ন দিতে হবে।

মানবধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভুতি প্রকাশ করা। মেয়েরা যে সহমর্মী তা আবারও প্রকাশ পেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রাশিয়াতে। রাশিয়ান নারীরা যুদ্ধের ভয়াবহতা আগাম আঁচ করে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ২৩ তারিখ নারী দিবস উদযাপন করেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার ২০ লক্ষ সৈনিকের মৃত্যুর প্রতিবাদ জানিয়ে ‘ব্রেড অ্যান্ড পিস’ আন্দোলন করা হয়। রাশিয়ান নারীরা সেই আন্দলনের মধ্যে দিয়ে অন্যান্য দাবি-দাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার অর্জন করেন। সেই সময় থেকেই ২৩ ফেব্রুয়ারির এই আন্দোলনকে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার-এ ফেলে দেখা যায় এই দিনটা হচ্ছে ৮ মার্চ। সেই থেকে আমরা রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎপরতায় ১৯৭৫ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবেই নারী দিবস পালন করে আসছি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১

যোগা-প্রাণায়াম: প্রসাধনী নয়, স্রেফ যোগাভ্যাসে বাড়ান ত্বকের জেল্লা!

আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে ভারত সরকার সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় নারীরা কীভাবে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছেন এবং এ সব বিষয়ের নারীদের উপর প্রভাব কী, জানতে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। ডক্টর ফুলরেণু গুহর তত্তাবধানে তখন যেন আমরা নতুন ভাবে ভাবনা চিন্তা করার দিশা পেলাম। ভারতীয় নারীদের কাছে স্বতন্ত্র আন্দোলনের ভাষা যেন এই সময় থেকেই নির্মাণ হতে শুরু করেছিল।

১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে যখন একটি দশককে নারীদের জন্য নির্ধারণ করে, তখন ভারতীয় সমাজে নারীদের অধিকারের লড়াইয়ের বিষয়টি অন্য মাত্রা পায়। এই ভিন্ন মাত্রা পাওয়ার কারণ ওই কমিটি ভারতীয় নারীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিল কোন সহজ-সরল রেখাতে নারীদের উপরে হয়ে চলা অত্যাচার বোঝা যাবে না। এত জটিল সমীকরণ ছিল যে, ভারতীয় ইতিহাসের অলিগলি কখনও হয়তো প্রবাহমান কালের ধারায় নারীকে পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কখনও ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে নানা রকমের সামাজিক পরিবর্তন নারী, পুরুষ, পরিবার, রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উচ্চ-নিম্ন ধারা তৈরি করেছে। আবার নব ভারতের নব নারী নির্মাণ প্রক্রিয়া অন্য রসায়ানের সম্পর্কও নির্মাণ করছে।

তাই ২০২৩ সালে দাড়িয়ে নারী দিবস উদযাপনের মধ্যে শুধু দিন যাপনের ইতিহাসে চোখ না বুলিয়ে আমদের ভাবনার রাজপথেও হাঁটতে হবে। আর তলিয়ে ভাবতে হবে, কীভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীদের একত্রিত করে সমাজের নানান সমস্যাকে ভেদ করে নিজস্ব ক্ষমতাকে আয়ত্তে আনা যায়।

ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ সর্বপরি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর আদি দাবি,’ নারী চিরকাল পরের অধীন’ এই জবানি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

Skip to content