শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ধরুন একজন ফুল বিক্রেতা। তার নাম শ্যামলী। ফুলের বাজার থেকে ফুল কিনে প্ল্যাটফর্মে এসে বস্তাজাত করছেন সুতলি দড়ি দিয়ে। পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া দড়ি আচমকা ছিঁড়ে গিয়ে বস্তার বাঁধন খুলে গেল। ট্রেন ঢোকার সময় হয়ে গিয়েছে। শ্যামলীর ঘেমে গিয়েছে। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এই মুহূর্তে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা এক পুরুষ যাত্রী হেসে উঠলেন দড়ি ছেঁড়া দেখে। অনেকের মনে হতে পারে, এই হেসে ওঠার সঙ্গে ভয়ের হাসির বা ফিয়ার লাফটারের যোগ থাকতে পারে।

এই আচমকা বিপদে কি হবে ভেবে হেসে উঠেছে। আসলে আমরা হাসি, কান্না, নানা রকম শব্দ প্রভৃতির মাধ্যমে আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করি। অথবা বলা যেতে পারে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার বিচার করি। তাহলে এই হেসে ওঠা কি ওই নারীকে বলা যে, তুমি এই দড়িটাও ঠিক করে রাখতে পার না বা অন্য ভাবে বললে মেয়ে মানুষের এই রকম বুদ্ধি হয়। এ বার তাহলে আর একটা অভিজ্ঞতার কথা শোনাই। সেখানে ছেলেরা নিজেদের নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করছে।

সকাল বেলায় একদল উঠতি খেলোয়াড় ছেলের দল ট্রেন ধরবে বলে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আগের দিনের মাঠের একটি ঘটনা আলোচনা করছে। ঘটনার কেদ্রবিন্দুতে আছে একটি ছেলের অন্য দলের ছেলের হাতে মার খাওয়ার কথা। যে ছেলেটি গল্পটি বলছে, সে যখন বর্ণনা দিচ্ছে যে মার খাওয়া ছেলেটিকে মারতে মারতে তার চোখ, মুখেও লাথি মারছে। সেটা শুনে দুই একটি ছেলে হেসে উঠল। এই হেসে ওঠার মধ্যে কোন অনুভূতি প্রকাশ পেল? একটি ছেলে মার খাচ্ছে, আহত হচ্ছে জেনেও হেসে ওঠা কীভাবে ব্যাখ্যা করব আমরা। আমি এখানে কীভাবে হেসে উঠল বলার মধ্যে দিয়ে কিন্তু আমার অনুভবকে জাহির করে ফেলছি।
আমি ঘটনা শুনে মনে মনে দৃশ্য কল্পনা করে অনুভূতি প্রকাশ করে আমার অবস্থান জানাচ্ছি। তার পরেই মনে হল, এ ভাবে অন্য নারীরাও কি হেসে ওঠেন বা উঠবেন? সেই সময় সেই ছেলেদের বয়সি মেয়ে খেলোয়াড় দের দেখলাম চিন্তা মুখে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনে কীভাবে উঠবে এতজন তাই ভেবে। তারা নিজেরা এরকম কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে না বা ছেলেদের গল্পের দিকে মনও দিচ্ছে না।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে কারা বেশি অনুভূতি প্রবণ এবং সহানুভূতিশীল। সোজা উত্তর দেওয়া মুশকিল। একটু অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম একটি স্পষ্ট বিভাজন এই অনুভূতি প্রকাশ করা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে রয়েছে। একদল গবেষক নারীদের মধ্যে অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারে আলাদা করে প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছেন। আবার আর একদল গবেষক লিঙ্গ তারতম্যের বিষয়টির সঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশের বিষয়টিকেও যুক্ত করেছেন। গবেষকরা তাই ইউরোপ এবং আমেরিকার মানুষদের নিয়ে করা গবেষণার তথ্য দিয়ে এশিয়া কিংবা ভারতের মানুষদের লিঙ্গ ভেদে অনুভূতি প্রকাশের কারণের তারতম্য বিচার করতে চাননি।

তবে যে পদ্ধতিতে গবেষণা করা হয়েছে এবং যে বিষয়গুলি গবেষণা করে কারণ বলে তুলে ধরেছেন, তার একটা প্রয়োগ ঘটিয়ে দেখা যেতে পারে। কারণ সম্প্রতি সংবাদপত্রে দেখলাম স্ত্রী এবং আট বছরের কন্যাকে হত্যা করে স্বামী আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের কাছে এই হত্যা কোন অনুভূতি থেকে। নিজেকে বাঁচানোর নাকি, আক্রোশ থেকে? আট বছরের শিশু কন্যার প্রতি কীভাবে আক্রোশ জন্মাতে পারে? হত্যা করার সময় যন্ত্রণাতে কাতরাতে থাকা দুটি মানুষকে দেখে কী অনুভূতি হল হত্যাকারীর? অর্থাৎ সামাজিক প্রেক্ষাপট এই অনুভূতি তৈরি হতে ভূমিকা নেয়। সমাজের ভূমিকা না থাকলে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক রকমের অনুভূতি প্রকাশ পেত না। সেই জন্য কি বলা যায় লিঙ্গ ভেদে অনুভূতি আলাদা হয়?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩৬: লিঙ্গ-বৈষম্য কি সত্যি আছে?

রিভিউ: হোচি পারবে কুমুদিনী ভবনের রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে?

নারীবাদী মনস্তাত্ত্বিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, নারীদের সহানুভূতি রয়েছে এবং এটি একটি গুণ বলে বিচার করা যেতে পারে। এই গুণের তিনটি প্রধান উপাদান আছে। প্রথম উপাদান হিসেবে ধরা হয়েছে, কল্পনাপ্রসূত অভিক্ষেপ, দ্বিতীয় উপাদানটি হল অন্যের আবেগ সম্পর্কে সচেতনতা এবং তৃতীয় বিষয়টি হল উদ্বেগ।

এখানে কল্পনাপ্রসূত অভিক্ষেপ মানে, মনে মনে কল্পনা করতে পারা যে কোন ঘটনায় মানুষের মনে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। ঘটনা কল্পনা করতে পারার বিষয়কে বলা হচ্ছে। আবেগ, অনুভূতি বিষয়গুলি যেহেতু লিঙ্গ ভিন্নতার মতোই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে আলাদা হতে পারে সেই বিষয়টি মাথায় রাখা, নারীরা পারেন। তাই তারা সবার সঙ্গে এক রকম ভাবে কথা বলেন না। কারও সঙ্গে বেশি আবেগ মিশিয়ে আবার কখনও কঠিন গলায় তারা কথা বলে থাকেন। কিন্তু আমার মনে হয়, এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ নারীদের মধ্যে স্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে বাস্তবে তা কিন্তু নয়। তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশকেও নিয়ন্ত্রণ করে রাখে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে সবসময় দেখতে চায় সেবা করা এক মাতৃ মূর্তি হিসেবে। সেই নারী নিজের আবেগে রাগ প্রকাশ করলে শুনতে হবে সে দজ্জাল। তার মধ্যে কোনও দয়া-মায়া কিছুই নেই। এই দয়া-মায়ার সঙ্গে জড়িয়ে রাখা হয় ক্ষমা করা এবং ঘেন্না বা অপরাধের মতো বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টিকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, এই দেশ এই মাটি

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

এখানেই আমাদের যে বিষয়টিতে জোর দিতে হবে সেটা হল, আবেগের সঙ্গে যুক্তিকে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা। আমরা নারীদের আবেগের প্রতিমূর্তি বলার সঙ্গে সঙ্গে বলছি তারা আবেগকে জোর দিতে গিয়ে যুক্তিকে সরিয়ে রাখে আর তাতে সমাজের সাম্যতা নষ্ট হয়। সাম্যতা ফিরিয়ে আনার হলে আবার তা জুড়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষের সঙ্গে। পুরুষ মানুষ তাই সহানুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে দেখবে যুক্তির বুদ্ধি কতটা আছে।

এক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের সম্পূর্ণ সহায়তা পাওয়া যাবে। শাশুড়ি ( বলছি শুধু মাত্র উদাহরণ হিসেবে, কারণ কালকেই এক মা দুঃখ করে বলছেন ছেলেরা মা কে সাজতে দিতে চায় না, বাবা মারা গেছেন বলে) কিংবা পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা মনে করবে এই ভাবে নারীর মন আবেগ সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই সময়ে লক্ষ্মীর পাঁচালি মনে করে দেখুন সেখানে জোরে হাসতে বারণ করা আছে নারীদের। সমাজ মনে করে নারীদের নিজেদের আবেগের নিয়ন্ত্রণ দরকার সবার আগে। লিলিথ এর গল্প বলেছিলাম আমি আগের কোন পর্বে।

দড়ি ছিঁড়ে যাওয়াতে তাই হাসি বেরিয়ে পড়ে এই বলে যে লাইলনের দড়ি থাকলে এই বিপদ বা সমস্যা হত না। কিন্তু পুরুষ এখানে ভাবতে পারছে না সেই মহিলা কেন পচনশীল দড়ি ব্যাবহার করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন আবার আসে অন্যের বোকামোতে আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশে কি হাসি হবে। হাসি মানে অবজ্ঞা। শ্রদ্ধা না থাকা।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

তৃতীয় বিষয়টি নিয়ে বলাই যায় আমরা সবাই কম বেশি দেখে থাকি বা উপলব্ধি করি তা হল, আগে থেকে সচেতন থেকে বা কোনও ঘটনা ঘটলে যাতে আসে পাশের মানুষকে তারা উপদেশ দিয়ে হোক বা সচেতন করে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। বাড়ি থেকে মায়ের ঘন ঘন ফোন আসা বা ফোন করে জানতে চাওয়া, চেনা পরিচিতদের তাদের অবস্থান বা বিপদে কিছু সাহায্য লাগবে কিনা। উদ্বেগের প্রয়োজন আছে কারণ বাড়ির পুরুষ মানুষ সে ছেলে হোক বা স্বামী বাড়ি ফেরেনি বা কোথাও মাতাল হয়ে পড়ে থাকলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে কে? এই নারীদের তা করতে হবে। আর নারীকে তো বাড়িতেই রাখা হয় তাই অর্থ উপার্জনের কাজ ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে উদ্বেগ আসে না পিতৃ তন্ত্রের পুরুষদের।

কিন্তু কখনও কখনও এই উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ অন্য বিষয়ের সুত্রপাত ঘটায়। সেই বিষয়গুলো কখনও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন হতে পারে আবার কখনও নিজেদের ভিটে মাটি বহুতল আবাসন বা কারখানা হওয়া থেকে বাঁচানতেও সামিল হওয়া হতে পারে। আমি এমনও দেখেছি অনেকে শহরাঞ্চলেও খাটালের ব্যবসা করেন। পৌরসভা থেকে তুলে দিলে খাবে কি সেই উদ্বেগ থেকে ছেলে কোলে সেই নারী আধিকারিকদের সামনে ছেলেকে চিমটি কেটে কাঁদিয়ে নিজের ব্যবসা বাঁচিয়েছিল। ঠিক ভুলের হিসেবের থেকে পেটের হিসেব সেখানে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

বলা যেতে পারে আবেগের সঙ্গে সামাজিক অবস্থানের যোগাযোগ অনেক বেশি। মেয়ে হওয়া সমাজের চোখে খানিক সম্মানহানির বিষয়। তাই আট বছরের মেয়েকে হত্যা করার সময় সমাজ নিয়ন্ত্রিত আবেগ বিবেকে ধাক্কা মেরে বলেনি যে, এ ভাবে একটি শিশুকে কেন কোনও পশু পাখিকেও নির্মম ভাবে হত্যা করা যায় না। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ রদ এবং চালু করতে চাইলেন তখন তাঁদের মধ্যে কিন্তু নারী শুধু নয়, সব মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁরা পুরুষ ও ধার্মিক হয়েও যে বিষয়টিতে জোর দিয়েছিলেন তা হল ‘সাহস, বৈরাগ্য, বিচার এবং একনিষ্ঠা’। এ সবের সমাহারই হল শ্রদ্ধা। সবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন।

দুর্বল মানসিকতা আমাদের পরাধীন করে দেয়। আমরা নিজেরা যদি নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিজের উপর আস্থা রেখে মর্যাদাবোধ জাগিয়ে না রাখি, আর নির্ভর করি অন্যের সাহায্যে কীভাবে স্বীকৃত এবং সমর্থিত হবে, তখন আমাদের নিজেদের প্রতি আর শ্রদ্ধাশীল থাকা হয় না। নিজের প্রতি শেখায় অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। এই অভ্যেস আমাদের খুব ছোট থেকে শিখতে হবে এবং করতে হবে। না হলে বহরমপুরের ঘটনা যেখানে প্রেমে প্রত্যাখ্যিত হয়ে প্রেমিকাকে ৪২ বার ছু্রির আঘাত করে মৃত্যুদণ্ড পেয়ে বলে যায় সহানুভূতি দেখাল সবাই কিন্তু তার আবেগ নিয়ে খেলে গেল যে তার বিচার হোল না । প্রত্যাখান অনেক বড় অপরাধ যার বিচার সে পেল না।—চলবে।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content