শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বেশ কয়েক বছর ধরেই যশোর রোডের দুই পাশের শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলি কেটে আন্তর্জাতিক রাস্তা যা বাংলাদেশ বর্ডার অবধি গিয়েছে, তাকে বেশি গাড়ি চলাচলের সহায়ক বানানোর চেষ্টা চলছে। বহু আন্দোলন হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আবার যাঁদের বাগান আছে বড় গাছ সমেত তাঁরা প্রায় গাছ শূন্য প্রতিবেশীদের থেকে শুনতে পান প্রায় গাছ কেটে দেওয়ার উপদেশ। এত বড় উপদেশের মূল কারণ গাছ থাকলেই পাতা পড়বে, সেগুল পরিস্কার করতে হবে। সময় এবং টাকা খরচ হবে কত গুলো মূল্যহীন শুকনো পাতার জন্য। খুব সহজ সমীকরণে বললে প্রকৃতি থেকে সচেতন দূরত্ব এবং প্রকৃতিকে ছেঁটে রাখা বাগানের মতো রাখলেই মানুষ পরিকল্পিত উন্নয়নের রেখা ধরে এগিয়ে যাবে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে।

এই ভাবনার পথে একটুখানি অন্য ভাবনা জুড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদেরও মনে হয় নানা বিধি নিষেধ আর ছেঁটে রাখা বাগানের মতো সাজিয়ে রাখতে চায়। মানুষ বাগান দেখে অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক দর্শনের গয়না পরা নারীকে দেখে তারিফ করবে আর গাছের ফল খেয়ে অর্থাৎ নারীর দ্বারা সেবা পাওয়ার পর, বিক্রি করে অর্থাৎ নারীর সেবার দ্বারা পুষ্ট হয়ে , শ্রম এবং যন্ত্রের ব্যবহার করে রোজগার করা এক অপার্থিব জয়ী হওয়ার আনন্দ উপলব্ধি করবে, আবার বাগানের অসুখ করলে প্রথমে সারানোর চেষ্টা তারপর কেটে ফেলার ইচ্ছে প্রকাশ করবে। কারণ পরিষেবার মাপকাঠি এক পেশে। গাছের ছায়া বা অক্সিজেন বা অন্য প্রাণী কে আশ্রয় দেওয়া গ্রহণীয় নয়। তাই নারী বা প্রকৃতির প্রতি সহমর্মিতা বা কৃতজ্ঞতা বোধ থাকবে না। নারীবাদী আন্দোলনকারীরা এই নারী এবং প্রকৃতির প্রতি ছেঁটে রাখা বাগানের মতো সাজিয়ে রাখার মনোভাবের সমালোচনা করেছেন আর বলছেন এই আচরণ আসলে এক ধরনের নিপীড়নমূলক ভাবনা এবং তার বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের প্রতিদিনের যাপনচিত্রে চোখ বোলালে আমরা সহজেই বুঝতে পারব কীভাবে এই নিপীড়ন করার ভাবনার বীজ আমাদের নারী পুরুষের মধ্যেকার থাকবন্দি বিভেদ বা উচ্চ নীচের বিভেদের ধারণা কে তৈরি করা হয়। সেই সঙ্গে বার বার মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যে, পুরুষ আবেগের দাস নয়, সে আবেগকে সরিয়ে রেখে যুক্তির বেড়াজাল দিয়ে, মেধা দিয়ে, শরীর দিয়ে সমাজের প্রগতি নির্মাণ করে চলে। আর নারী হল প্রকৃতির স্বরূপ। নারীর আবেগ এবং তার আবেগ পূর্ণ নরম শরীর নতুন জীবনকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে। নারীর আবেগের বেগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় কখনও। অনেক সময় সমাজের চাপে নিয়ন্ত্রণ সমাজ নির্দিষ্ট পথে হয় না তখন সমাজ মনে করে নারীর শরীরে জিনের প্রবেশ ঘটেছে, অথবা খারাপ হাওয়া লেগেছে কিংবা সরাসরি বলে দেওয়া হয় যে, সে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। নয় তো তখন তাকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। অর্থাৎ নারীর মনের অবস্থার সঙ্গে তার শারীরিক অবস্থান এবং সামাজিক অবস্থানকে মিলিয়ে নারীর সামাজিক প্রকৃতি নির্মাণ করা হয়। এই নির্মিত সামাজিক প্রকৃতির সঙ্গে যখন নারীকে লড়াই করতে হয় নিজের প্রকৃত অবস্থানকে বোঝানোর জন্য তখন সমাজ একটি খুব সহজ পথ বেছে নেয়। সেই পথ হল নারীকে রহস্যময়ী বলে আখ্যায়িত করে দেওয়া ।

এই ভাবে দেগে দেওয়ার পিছনে কখনই যুক্তির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু সমাজ মনে করে পিতৃতন্ত্র যুক্তির বাইরে বেরোতে পারে না কখনও। অর্থাৎ সমাজে সবসময় নারীকে অপরিচিত এবং আদিমতার সঙ্গে অর্থাৎ যেন এক প্রকৃতির প্রতিরূপ হিসেবে মিলিয়ে দেখার প্রচেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

কে গো অন্তরতর সে…

পোন্নিয়িন সেলভান ২: ছোটবেলার ভালোবাসার সামনে ‘পরদারেষু মাতৃবৎ’ও দুর্বল হয়েছিল

সমাজ এই ভাবে নারীকে বোঝার চেষ্টা করে কেন?
শুধুই কি দমনের ইচ্ছে থেকেই করা হয়, নাকি নারীকে এই ভাবে ‘অনিশ্চিত’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে পুরুষের কামনার বাসনাকেই সে উদ্ঘাটন করে যাওয়ার সেবাদাসী থেকে যাবে আজীবন? কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের কামনার সময় কাজের সময়ের সঙ্গে যাতে সঙ্ঘাত না করে এবং বৈবাহিক জীবনের মধ্যে কামনাকে আটকে রেখে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রকারের ‘অনিশ্চিত’ নারী তৈরির প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।

প্রথম প্রকারের মধ্যে আইনি স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে যাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া গিয়েছে, সেই নারী আর দ্বিতিয় প্রকার হল সেই নারীরা (এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যার কথা কখনই জোর দিয়ে বলা যায় না) যাদের মধ্যে সিনেমার নায়িকা থাকতে পারেন বা অন্য কোনও নারী, যাকে কখনও কাছে পাওয়া যাচ্ছে আবার কখনও পুরোপুরি অনুমান করে নিতে হচ্ছে, কিন্তু তারাও ‘অনিশ্চিত’ নারী। এখানে সেই প্রশ্নটি আসে যে আমরা যখন বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হই আমাদের প্রগতির ধারাকে সুনিশ্চিত করতে, কারণ বিজ্ঞান আমাদের সুস্পষ্ট জ্ঞান দেয় এবং সেই জ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক। কারও প্রভাবে সে প্রভাবিত নয়। তাহলে সেই বিজ্ঞানের আলোকে নারীকে কেন ‘অনিশ্চিত’ নারী হিসেবে দেখছি? বিজ্ঞানের মধ্যেও তাহলে পিতৃতন্ত্র যুক্তির দমনমূলক প্রভাব আছে। একটা আগ্রাসী মনোভাব লুকিয়ে আছে।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

চলো যাই ঘুরে আসি: চুপি চুপি ঘুরে আসি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

একজন ডাক্তার তার ডাক্তার স্ত্রীকে বাধ্য করলেন দ্বিতীয় বার সন্তান নিতে। ডাক্তার স্ত্রীর পরিবারের লোকজন বিষয়টিকে সমর্থন করলেন। কারণ নড়বড়ে দাম্পত্যকে টিকিয়ে রাখার সেতু বলে ধরে নেওয়া হয়েছে সন্তানকে। সমাজ ধরে নিয়েছে সন্তান হলে উভয়ের মধ্যে সন্তান মানুষ করার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয় সচেষ্ট হবে। কারণ মানবশিশুর স্বাবলম্বী হতে অন্যান্য প্রাণীর থেকে বেশি সময় লাগে। কিন্ত বাস্তব ক্ষেত্রে অধিকাংশ পুরুষ হাতে কলমে সন্তান মানুষ করতে অপারগ থাকে। ব্যাতিক্রমীদের এখানে ধরছি না। পুরুষ মায়ের ভূমিকা পালন করতে পারে কী পারে না সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। মায়ের ভূমিকা বা বাবার ভূমিকা অর্থে বিশেষ কিছু কাজ করা বা প্রতিপালন করার কথা বলা হয়। সে ক্ষেত্রে সন্তানকে শিখিয়ে দিতে হয় যে সে কীভাবে সমাজের নিয়ম কানুন শিখে সমাজে টিকে থাকবে। এখানে যে সমাজের নিয়ম, মূল্যবোধ আয়ত্ত করেছে সেই সন্তান প্রতিপালন করতে পারবে। শেখানোর ক্ষমতা যার থাকে সেই শিখিয়ে দিতে পারে। তাই সন্তানের শেখার বিষয়টিতে শুধু মা বা বাবা নয়, বরং তার বন্ধু বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা থেকে যায়। সন্তানের জন্ম দিতে নারীর কোনো শারীরিক সমস্যা হতে পারে সেই বিষয়টিকে উহ্য রাখা হয়।

আবার আমারা মূল আলোচনাতে ফিরে আসি। ডাক্তার দম্পতি ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি লক্ষ করা যায় যারা তথাকথিত বিজ্ঞানের চর্চা করে চলেছেন, তাঁরা স্ত্রীদের উপরে সন্তান নেওয়ার চাপ বাড়িয়েছেন পুত্র সন্তান লাভের আশায়। কোনও কারণে এরকম এক ডাক্তার দম্পতির প্রথম এবং দ্বিতীয় সন্তান কন্যা হওয়ার জন্য শোক জ্ঞাপন করে জানালেন যে, পুরুষ ডাক্তারের বংশ লোপ পেয়েছে। আর যারা প্রচলিত ঐতিহ্যকেই আঁকড়ে ধরে আছেন নিজেদের বিজ্ঞানের শিক্ষাকে গ্রহণ করার সুযোগ না পেয়ে তাদের কাছে মা ষষ্ঠীর ব্রত উৎযাপনের জ্ঞানের মধ্যেই সব কিছু সীমাবদ্ধ।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০: প্রশিক্ষক গুরু বিশ্বামিত্র, নারীহত্যা না মানবধর্ম?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?

কিন্তু উভয়েই আদিমতার বুনো গন্ধকেই ভালোবেসেছে। আদিম সমাজের নারী পুরুষের বিষমকামী, প্রজননমুখী সম্পর্ককেই বারে বারে আঁকড়ে ধরেছে মানুষ? তাহলে উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতিকে বিজ্ঞানের বস্তুমুখী ধারনার বদলে আমরা দেখছি আমাদের পিতৃতন্ত্র যুক্তির তৈরি খোপের মধ্যে দিব্যি ঢুকিয়ে দিয়ে বলছি এটাই বিজ্ঞান।

তার ফলাফল? লেখার শুরুতেই যা বলেছি নির্বিচারে গাছ কেটে নিয়ে বলছি ভীষণ গরম লাগছে এবার এয়ারকন্ডিশনার চালাও। আবার গাড়ির গতি বাড়াতে হবে, না হলে আমাদের বেগবান জীবন পিছিয়ে পড়বে। কারখানা তৈরি করতে হবে তার জন্য মাটির তলা থেকে হলেও কাঁচামাল জোগাড় করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করে মানুষকে বাধ্য করতে হবে নিজের প্রয়োজনের বেলুনকে ফুলিয়ে যেতে। তারপর সেই বেলুন ফেটে গেলে অতিরিক্ত কেনা জিনিসগুলো ফেলার জন্য আবার জমি খুঁজতে হবে। গাছগুলো কেটে ফেলে সেই বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে সাহায্য করার জন্য, না হলে প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে পিতৃতন্ত্র যুক্তির বিজ্ঞান।
কখনও পিতৃতন্ত্র যুক্তির বিজ্ঞানের মনে হচ্ছে না যে, সে আসলে প্রকৃতির অংশ। কোনও ভাবেই প্রকৃতির বাইরে সে নয়। প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতির নিয়ম না জানতে চেয়ে যদি বলতে থাকি প্রকৃতি অনিশ্চিত অথচ বাস্তবে প্রকৃতিকে সবসময় লুঠ করে নিতে চাইছি। তাকে পদদলিত করতে চাইছি। কখনই প্রকৃতিকে তার নিজের মতো থাকতে দিতে চাইছি না। প্রকৃতিকে সময় দিতে চাইছি না তার ক্ষত সারিয়ে ওঠার জন্য। প্রকৃতিকে সবসময় সেবা দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তুলছি, ঠিক যেমন করে আমরা আমাদের নারীদের কাছ থেকে দাবি করতে থাকি।

এ ভাবে প্রকৃতিকে অনিশ্চিত বলা এবং সেই সঙ্গে নারীদেরও অপরিচিত করে তোলার পিতৃতন্ত্র যুক্তির বিজ্ঞান কখনই আমাদের সাম্যতার ভাবনাকে পিচ্ছিল, অশান্ত, আশঙ্কাময় করে তুলতে পারে না। আশার আলো আমাদেরকেই বের করে আনতে হয়। তবে সেই সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে গেলে মানুষকেই আবার বিভাজন ভুলে জ্ঞানের দিগন্তকেই নতুন করে খুলে দিতে হবে সবার জন্য।—চলবে

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content