ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।
ভারতে আদর্শ পুরুষ এবং নারী নির্মাণ প্রক্রিয়ার ইতিহাসের ধারা পর্যবেক্ষণ করতে গেলেই সবার আগে উঠে আসে রাম এবং সীতার নাম। এই দুই নামধারী চরিত্র নির্মাণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সমাজের নারী এবং পুরুষ চরিত্র পূর্ণতা পায় বা আদর্শ হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিষমকামী সম্পর্কের আদর্শ রূপ কেমন হওয়া উচিত তার একটি বাস্তব মেশানো গল্প বা কাহিনি হল রামায়ণের রাম-সীতার গল্প।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। রাম-সীতার গল্প মোটামুটি একই রকম হলেও তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে ভারতের বিভিন্ন ভৌগলিক স্থান ও সময় ভেদে স্থানীয় সমাজ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যদি বাল্মিকি রচিত রামের গল্প ধরে এগতে থাকি, তাহলে কৃত্তিবাসের লেখা রামের চরিত্র নির্মাণ আমাদের এক অতি ক্ষমতাশালী পুরুষের সঙ্গে পরিচয় করায়। আর তাঁর পাশে সীতার চরিত্র একজন গৃহকর্মে নিপুণা, প্রতিবাদ করতে না পারা নারীত্বের প্রতিরূপ।
এই অতি প্রচলিত গল্প ধরে ভারতে বিষমকামী লিঙ্গ নির্মাণ নিয়ে যতটা আলোচনা করা দরকার ঠিক ততটাই করব। কারণ, আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য, ভারতীয় সমাজ কীভাবে পুরুষ নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করেছে। এছাড়াও আজকের দিনের কেতাদুরস্ত পৌরুষ মানসিকতার পুনর্বিবেচনার জন্য বার বার আতস কাচের নীচে ফেলতে হচ্ছে, কারণ নারী পুরুষের সম্পর্কে হিংসা বেড়েছে। এমন পুরুষ নির্মাণের প্রক্রিয়াতে বিশ্বায়নের প্রভাব কীভাবে পড়ছে সেটাও বিবেচ্য। এর পরেও যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, আমরা যখনই নারীদের ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করতে যাই, তখন পুরুষ এবং পৌরুষের নির্মাণ বিষয়টি আলাদা করে রাখলে হবে না। পুরুষের সমাজে লিঙ্গ অবস্থানটি কী সেই বিষয়টি আমাদের আলোচনা করতেই হবে। পুরুষদেরও নিজেদের লিঙ্গ অবস্থান বুঝে আলোচনা করতে হবে। তা না হলে নারীবাদী আন্দোলনের যে পর্যায়, মূলত যাকে দ্বিতীয় তরঙ্গ বলে থাকি, সেই সময়ে পুরুষকে ভীষণ ভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল অপরাধী বলে। সব পুরুষকেই অপরাধী বলা যুক্তি সম্মত নয়। অর্থাৎ সেই সময়ে পুরুষের লিঙ্গ অবস্থানকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। রাম-সীতার গল্প মোটামুটি একই রকম হলেও তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে ভারতের বিভিন্ন ভৌগলিক স্থান ও সময় ভেদে স্থানীয় সমাজ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যদি বাল্মিকি রচিত রামের গল্প ধরে এগতে থাকি, তাহলে কৃত্তিবাসের লেখা রামের চরিত্র নির্মাণ আমাদের এক অতি ক্ষমতাশালী পুরুষের সঙ্গে পরিচয় করায়। আর তাঁর পাশে সীতার চরিত্র একজন গৃহকর্মে নিপুণা, প্রতিবাদ করতে না পারা নারীত্বের প্রতিরূপ।
এই অতি প্রচলিত গল্প ধরে ভারতে বিষমকামী লিঙ্গ নির্মাণ নিয়ে যতটা আলোচনা করা দরকার ঠিক ততটাই করব। কারণ, আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য, ভারতীয় সমাজ কীভাবে পুরুষ নির্মাণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করেছে। এছাড়াও আজকের দিনের কেতাদুরস্ত পৌরুষ মানসিকতার পুনর্বিবেচনার জন্য বার বার আতস কাচের নীচে ফেলতে হচ্ছে, কারণ নারী পুরুষের সম্পর্কে হিংসা বেড়েছে। এমন পুরুষ নির্মাণের প্রক্রিয়াতে বিশ্বায়নের প্রভাব কীভাবে পড়ছে সেটাও বিবেচ্য। এর পরেও যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, আমরা যখনই নারীদের ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করতে যাই, তখন পুরুষ এবং পৌরুষের নির্মাণ বিষয়টি আলাদা করে রাখলে হবে না। পুরুষের সমাজে লিঙ্গ অবস্থানটি কী সেই বিষয়টি আমাদের আলোচনা করতেই হবে। পুরুষদেরও নিজেদের লিঙ্গ অবস্থান বুঝে আলোচনা করতে হবে। তা না হলে নারীবাদী আন্দোলনের যে পর্যায়, মূলত যাকে দ্বিতীয় তরঙ্গ বলে থাকি, সেই সময়ে পুরুষকে ভীষণ ভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল অপরাধী বলে। সব পুরুষকেই অপরাধী বলা যুক্তি সম্মত নয়। অর্থাৎ সেই সময়ে পুরুষের লিঙ্গ অবস্থানকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল।
এখন পুরুষ যদি এই পরিস্থিতিতে নিজের কথা বলতে গিয়ে নারীদের লিঙ্গ অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে, তাহলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। কেন বলছি এই কথা? কিছুদিন আগেই সমাজমাধ্যমের পাতায় দেখলাম, কিছু পুরুষ বিশেষ একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, পুরুষরা চাকরি করলে তাদের স্ত্রীদের নমিনি করেন। কিন্তু নারীরা চাকরি পেলে নিজের মা-বাবাকে নমিনি করে রাখেন। আবার ট্রেনে যেতে যেতে এও কানে এল, এমন অনেকেই চাকরি করেন (অবশ্যই মহিলা) যাঁদের চাকরি করার কোনও প্রয়োজনই নেই। শাড়ি, গয়না কিনেই তাঁরা টাকা খরচ করেন। কিন্তু কেউ একবারও বলছে না যে, তাঁরা কাজ কেমন করছেন।
তাই আমাদের প্রয়োজন এই বিষয়গুলোর পর্যালোচনা করা এবং প্রশ্ন তোলা। যাতে বর্তমানে নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে না না মহল থেকে, তেমনই পুরুষ হিসেবে যারা পরিচিত হচ্ছেন তাদের সামাজিক অবস্থান কীভাবে তারা দেখবেন সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
বাল্মীকির রামায়ণে রামকে একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়েছেন। যিনি সমাজের অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখার জন্য সমাজের তৈরি নিয়মের পালন করেন। নিজের গুরুজনদের কথা মেনে চলেন। আর স্ত্রী সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা একবার দিতে বলেছিলেন। তারপর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বনবাস শেষ করে ফিরে আসেন।
এ বার একবার কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণ দেখুন। অনেকেই প্রশ্ন করবেন, আমি বেছে বেছে এই দুটি রামায়ণের গল্প দেখছি কেন। বাল্মীকি রামায়াণকেই আদি রামায়ণ হিসেবে দেখে হয়। ধরা হয় আনুমানিক ৫০০ বিসি থেকে ১০০ বিসি-এর মধ্যে লেখা হয়েছে। আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ লেখা হয়েছে ১৫ শতকে। এই শতকেই ভাস্কো-দা-গামা কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বণিকের কাছেই নিজভূমে ভারতীয়দের পরাধীন পরিণতি দেখতে পাই। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের নিজস্ব বিবর্তনের ধারণা অর্থাৎ ইউরোপীয় প্রভাবহীন ক্রমবিকাশ আমরা এই কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণটিতে দেখতে পাই। এই কারণে আমি এই রামায়ণ নিয়েছি আজকের আলোচনার জন্য।
তাই আমাদের প্রয়োজন এই বিষয়গুলোর পর্যালোচনা করা এবং প্রশ্ন তোলা। যাতে বর্তমানে নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে না না মহল থেকে, তেমনই পুরুষ হিসেবে যারা পরিচিত হচ্ছেন তাদের সামাজিক অবস্থান কীভাবে তারা দেখবেন সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
বাল্মীকির রামায়ণে রামকে একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়েছেন। যিনি সমাজের অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখার জন্য সমাজের তৈরি নিয়মের পালন করেন। নিজের গুরুজনদের কথা মেনে চলেন। আর স্ত্রী সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা একবার দিতে বলেছিলেন। তারপর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বনবাস শেষ করে ফিরে আসেন।
এ বার একবার কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণ দেখুন। অনেকেই প্রশ্ন করবেন, আমি বেছে বেছে এই দুটি রামায়ণের গল্প দেখছি কেন। বাল্মীকি রামায়াণকেই আদি রামায়ণ হিসেবে দেখে হয়। ধরা হয় আনুমানিক ৫০০ বিসি থেকে ১০০ বিসি-এর মধ্যে লেখা হয়েছে। আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ লেখা হয়েছে ১৫ শতকে। এই শতকেই ভাস্কো-দা-গামা কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বণিকের কাছেই নিজভূমে ভারতীয়দের পরাধীন পরিণতি দেখতে পাই। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজের নিজস্ব বিবর্তনের ধারণা অর্থাৎ ইউরোপীয় প্রভাবহীন ক্রমবিকাশ আমরা এই কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণটিতে দেখতে পাই। এই কারণে আমি এই রামায়ণ নিয়েছি আজকের আলোচনার জন্য।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৯: পৌরুষ, পুরুষ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও কিছু সমস্যা
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৭: বিপৎকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই…
কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণে দেখছি বাল্মীকি কীভাবে দস্যু রাত্নাকর থেকে মরা মরা বলতে বলতে বাল্মীকি হয়ে উঠছেন। মূল রামায়ণে তিনি তপস্বী। তারপর দেখছি বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ রক্ষার জন্য রাম লক্ষ্মণকে যেতে দেবেন না বলে দশরথ ছলনা করছেন। মূল রামায়ণে দশরথ খুব তৎপরতা দেখিয়েছিলেন ছেলেদের পাঠানোর ক্ষেত্রে। তারপর দেখা গেল সীতার আর আহল্যার চরিত্র চিত্রায়নে বড় পরিবর্তন। মূল রামায়ণে যেখানে অহল্যাকে বলা হয়েছে তপস্বিনী সেখানে কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণ বলছে আহল্যা পাথর হয়েছিলেন। রামের চরণ স্পর্শে তিনি মানুষের শরীর ফিরে পান। আর সীতার ক্ষেত্রে দেখা গেল দু’ বার তাঁকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হল। আর রাবণ যখন হরণ করতে এলেন মূল রামায়ণের সীতা তর্ক করলেন এবং নিজেকে রক্ষা করার যথাযথ চেষ্টা করলেন।
কিন্তু কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণ সীতাকে দেখালেন পুরপুরি অসহায় একজন নারী। তিনি একবারও এই অপহরণের জন্য প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তিনি যখন দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন তখন ঘটনাটিকে উপস্থাপন করা হল এই ভাবে যে, তিনি পাতালে নিজের মায়ের কাছে চলে গেলেন। তিনি নিজের পরিজনদের ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পৃথিবীতে তার থাকার জন্য কোনও জায়গা থাকলো না।
এ বার আসছি রাবণ এবং বিভীষণের মধ্যে বিবাদ প্রসঙ্গে। রাবণের পরস্ত্রী হরণ করার বিষয়টিকে বিভীষণ মনে করেছিলেন হীন পৌরুষের কাজ। তাই তিনি দাদাকে এই কাজ পুনর্বিবেচনা করতে বলেন। দাদা রাবণ ভাইয়ের কথা শুনে তিরস্কার করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, বড় দাদা রাবণ ছোট ভাইকে তিরস্কারের পাশাপাশি আঘাতও করেন।
এ বার আমরা একবার নৃতাত্ত্বিক গবেষণাতে দৃষ্টিপাত করি। দুই রামায়ণের গল্পে দুই লিঙ্গ নির্মাণ প্রক্রিয়াতে কী কী বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল এবং কেন? আমাদের কীভাবে তা ভাবা দরকার। বর্তমানে পুরুষ/ পৌরুষ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যখন আমরা কথা বলছি, তখন আমরা খুব সহজেই একজন নারী এবং বায়োলজিক্যাল ধারণা থেকে বলছি। সেই নারী কীভাবে পুরুষের কাছে পদানত হয়েছে সেই ভাবনা থেকে দেখছি। রামায়ণের গল্পে সীতার কথা যখন বলছি, তখন আমরা রামকে দোষারোপ করছি। রামের অগ্নিপরীক্ষা নেওয়ার কারণে সীতার অপমান কীভাবে হয়েছিল সে কথা আবিষ্কার করা যায় না। অহল্যার কথা যখন বলছি, তখনও দেখতে পাচ্ছি যে তার তপস্বী পরিচয়কে আবিষ্কার করা হচ্ছে। সেটাও অপমান। এই ঘটনাগুলি সামজেরই ঘটনা।
কিন্তু কৃত্তিবাসের লেখা রামায়ণ সীতাকে দেখালেন পুরপুরি অসহায় একজন নারী। তিনি একবারও এই অপহরণের জন্য প্রতিবাদ করতে পারলেন না। তিনি যখন দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন তখন ঘটনাটিকে উপস্থাপন করা হল এই ভাবে যে, তিনি পাতালে নিজের মায়ের কাছে চলে গেলেন। তিনি নিজের পরিজনদের ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পৃথিবীতে তার থাকার জন্য কোনও জায়গা থাকলো না।
এ বার আসছি রাবণ এবং বিভীষণের মধ্যে বিবাদ প্রসঙ্গে। রাবণের পরস্ত্রী হরণ করার বিষয়টিকে বিভীষণ মনে করেছিলেন হীন পৌরুষের কাজ। তাই তিনি দাদাকে এই কাজ পুনর্বিবেচনা করতে বলেন। দাদা রাবণ ভাইয়ের কথা শুনে তিরস্কার করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, বড় দাদা রাবণ ছোট ভাইকে তিরস্কারের পাশাপাশি আঘাতও করেন।
এ বার আমরা একবার নৃতাত্ত্বিক গবেষণাতে দৃষ্টিপাত করি। দুই রামায়ণের গল্পে দুই লিঙ্গ নির্মাণ প্রক্রিয়াতে কী কী বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল এবং কেন? আমাদের কীভাবে তা ভাবা দরকার। বর্তমানে পুরুষ/ পৌরুষ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যখন আমরা কথা বলছি, তখন আমরা খুব সহজেই একজন নারী এবং বায়োলজিক্যাল ধারণা থেকে বলছি। সেই নারী কীভাবে পুরুষের কাছে পদানত হয়েছে সেই ভাবনা থেকে দেখছি। রামায়ণের গল্পে সীতার কথা যখন বলছি, তখন আমরা রামকে দোষারোপ করছি। রামের অগ্নিপরীক্ষা নেওয়ার কারণে সীতার অপমান কীভাবে হয়েছিল সে কথা আবিষ্কার করা যায় না। অহল্যার কথা যখন বলছি, তখনও দেখতে পাচ্ছি যে তার তপস্বী পরিচয়কে আবিষ্কার করা হচ্ছে। সেটাও অপমান। এই ঘটনাগুলি সামজেরই ঘটনা।
আরও পড়ুন:
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা
সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই মানুষরা যে ভাবে জীবনযাপন করছে তাকে কেন্দ্র করেই আমরা এই লিঙ্গ নির্মাণ এবং তাদের মধ্যেকের বিভাজনকে আলাদা করে যাচাই না করে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক লিঙ্গ এবং বায়োলজিক্যাল ধারণাকে জুড়ে দিচ্ছি প্রবল ভাবে। কিন্তু আমরা বোঝার চেষ্টা করি না বা প্রশ্ন করছি না যে, নারী যাদের বলছি তিনি কি নিজে পুরুষের মতো এই ভাবে জীবনযাপন করতে পারেন? তিনি কি আরও কঠোর ভাবে পুরুষের আদর্শ অনুসরণ করতে পারেন? তিনি শারীরিক ও মানসিক আঘাত হানতে পারেন? অসম্ভব কিছু নয়। আবার পুরুষ মানেই কি এই আগ্রাসন? কিন্তু আমরা এই পৌরুষ নির্মাণের গল্পে এই দুই নির্মাণের দোলাচলের সম্ভবনাগুলিকে খুঁজে দেখিনি। আমরা দেখলাম না রাবণের মা নিকষা কীভাবে ছোট ছেলে বিভীষণকে দিয়ে বড় ছেলে রাবণের আগ্রাসনকে থামাতে চাইলেন।
এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলি আলাদা করে দেখতে চাইছি না। রাবণ সামাজিক ক্ষমতা বলে ছোট ভাই অর্থাৎ আর এক পুরুষের উপর ক্ষমতার আস্ফালন করা হল। ছোটভাই সীতার প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু আমরা কী করলাম? তাঁকে আজন্মকাল ধরে বলে এলাম ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমরা সদাই ব্যস্ত থাকলাম রাবণ এবং রামের মধ্যে যুদ্ধ দেখতে। কিন্তু মূল্যবোধের ধারণার নিরিখে কীভাবে সমাজ লিঙ্গ ভাবনার কথা ভাবতে পারে সেই বিষয়ে আলোকপাত করছি না, ১৫ শতকে করিনি, তাহলে পরে কী করেছি?
এর পরেও আমরা ভারতীয় পুরুষকে মনে করছি তারা সবাই পরস্পরের ভাই, সবাই এক। তারা একত্রে এক যোগে নারীদের বঞ্চিত করে এসেছে। কিন্তু খুব ভালো করে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে রাম এবং সীতা উভয়কেই বনবাসের ধাক্কা সইতে হয়েছিল। দু’জনই রাজনীতির শিকার ছিলেন। দু’জনেই রানি কৈকেয়ীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকার হয়েছিলেন। অর্থাৎ আবারও আমাদের বুঝতে হবে, নারী-পুরুষের এক রকম রাজনৈতিক লড়াই লড়তে হয়। নারীর লড়াইকেও খাটো করে দেখলে চলবে না। আবার পুরুষের এটাও মনে করলে চলবে না যে, নারী আন্দোলন করে যে রাজনৈতিক লড়াই করছে তাতে তাদের প্রাপ্তি কিছু কম হবে না।
কিন্তু আমরা ঔপনিবেশিক শাসনে থেকে জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনে ডুবে গিয়ে আবারও বিষমকামী নারী-পুরুষ নির্মাণের মধ্যে আটকে গেলাম। আর ব্রিটিশ পেনাল কোড বা আইপিসি মেনে নিলাম। বললাম ৩৭৭ ধারায় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বা অর্ডার অফ নেচারের বিরুদ্ধে গিয়ে যৌন প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করা যাবে না। আমাদের সামনে বিষমকামী আগ্রাসন হয়ে গেল পৌরুষ নির্মাণের চাবিকাঠি।
এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলি আলাদা করে দেখতে চাইছি না। রাবণ সামাজিক ক্ষমতা বলে ছোট ভাই অর্থাৎ আর এক পুরুষের উপর ক্ষমতার আস্ফালন করা হল। ছোটভাই সীতার প্রতি অবিচারের প্রতিবাদ করতে চাইল। কিন্তু আমরা কী করলাম? তাঁকে আজন্মকাল ধরে বলে এলাম ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমরা সদাই ব্যস্ত থাকলাম রাবণ এবং রামের মধ্যে যুদ্ধ দেখতে। কিন্তু মূল্যবোধের ধারণার নিরিখে কীভাবে সমাজ লিঙ্গ ভাবনার কথা ভাবতে পারে সেই বিষয়ে আলোকপাত করছি না, ১৫ শতকে করিনি, তাহলে পরে কী করেছি?
এর পরেও আমরা ভারতীয় পুরুষকে মনে করছি তারা সবাই পরস্পরের ভাই, সবাই এক। তারা একত্রে এক যোগে নারীদের বঞ্চিত করে এসেছে। কিন্তু খুব ভালো করে তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে রাম এবং সীতা উভয়কেই বনবাসের ধাক্কা সইতে হয়েছিল। দু’জনই রাজনীতির শিকার ছিলেন। দু’জনেই রানি কৈকেয়ীর উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিকার হয়েছিলেন। অর্থাৎ আবারও আমাদের বুঝতে হবে, নারী-পুরুষের এক রকম রাজনৈতিক লড়াই লড়তে হয়। নারীর লড়াইকেও খাটো করে দেখলে চলবে না। আবার পুরুষের এটাও মনে করলে চলবে না যে, নারী আন্দোলন করে যে রাজনৈতিক লড়াই করছে তাতে তাদের প্রাপ্তি কিছু কম হবে না।
কিন্তু আমরা ঔপনিবেশিক শাসনে থেকে জাতীয়তাবাদের আগ্রাসনে ডুবে গিয়ে আবারও বিষমকামী নারী-পুরুষ নির্মাণের মধ্যে আটকে গেলাম। আর ব্রিটিশ পেনাল কোড বা আইপিসি মেনে নিলাম। বললাম ৩৭৭ ধারায় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বা অর্ডার অফ নেচারের বিরুদ্ধে গিয়ে যৌন প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করা যাবে না। আমাদের সামনে বিষমকামী আগ্রাসন হয়ে গেল পৌরুষ নির্মাণের চাবিকাঠি।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা
এখানে প্রতিযোগিতা শুরু হল কীভাবে দুর্বল পুরুষ বা দুর্বল নারী প্রমাণ করে আদিপত্যবাদী পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে সমমানের প্রতিযোগীর সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে সুপার পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। আজকেই শুনলাম কোন এক স্কুলের মাঠে দুই ছাত্রের মধ্যে ভীষণ মারামারি হয়েছে। একটি মেয়েকে প্রেম নিবেদন করাকে কেন্দ্র করে এই ঝামেলা। বাকি ছাত্র এবং সেই মেয়েটি অবশ্য উপভোগ করেছে সেই লড়াই।
এই আদিপত্যবাদী পুরুষের দাপটে তাই বঞ্চিত বা হেরে যাওয়া পুরুষের কথা চাপা পড়ে যায়। আবার অন্য দিকে আদিপত্যবাদী পুরুষ জুড়ে যায় বিশ্বায়নের বিভিন্ন চিত্র বা ল্যান্ড স্কেপের সঙ্গে। বিনোদন দুনিয়াতে আমরা সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, হাঙ্ক, ডবলুডবলুএফ-এর সঙ্গে নিজেদের জুড়ে নিতে থাকি। আমরা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাই দেশের বাইরে, দেশের মধ্যে গ্রাম থেকে শহরে। সেখানে রাজনৈতিক নীতি, আর্থিক নীতি আমাদের মধ্যে আরও বেশি করে বিরোধ, বিজয়ের উল্লাস, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ করা, আমাদের মধ্যে অসমতা, আশান্ত লিঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছে।
পুরুষরা মহিলাদের নিয়ে করা বিশেষ কোনও টিভি প্রোগ্রাম দেখতে চায় না। সেরকম কোনও আলোচনা সভাতে অংশগ্রহণ করতে চায় না। রাষ্ট্র কোনও প্রকল্প ঘোষণা করলে সেখানে না না রকম টিপ্পনি করতে শোনা যায়। বিশ্ব দরবারে বা জাতীয় পর্যায়ে যখন নারীদের নিয়ে কোনও আলোচনা বা তাদের কোনও বিশেষ দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন এই পুরুষদের নিজেদের মনে হয় দুর্বল কিংবা পিছিয়ে পড়া। তখন তারা নিজেদের বাড়িতেই শুরু করে অত্যাচার, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। রেণু খাতুনের ঘটনাটি মনে করে দেখুন।
পরিশেষে তাই বলা যায় বহুমাত্রিক পুরুষ এবং পৌরুষ আর তাদের বহুবিধ দর্শন যেমন পিততন্ত্র, বাকি দর্শনের এখনও নামকরণ হয়নি। কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ সমন্বিত এবং কীভাবে আধিপত্য বিস্তারকারী পুরুষ এবং পৌরুষ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, আমাদের জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। তা না হলে আমরা সারাজীবন রাম আর রাবণের যুদ্ধ দেখে যাব। আর কিছু মানুষ কখনও রামের পক্ষে, আবার কখনও বা রাবণের পক্ষ নিয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধে আশা করে যাবে।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
এই আদিপত্যবাদী পুরুষের দাপটে তাই বঞ্চিত বা হেরে যাওয়া পুরুষের কথা চাপা পড়ে যায়। আবার অন্য দিকে আদিপত্যবাদী পুরুষ জুড়ে যায় বিশ্বায়নের বিভিন্ন চিত্র বা ল্যান্ড স্কেপের সঙ্গে। বিনোদন দুনিয়াতে আমরা সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, হাঙ্ক, ডবলুডবলুএফ-এর সঙ্গে নিজেদের জুড়ে নিতে থাকি। আমরা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাই দেশের বাইরে, দেশের মধ্যে গ্রাম থেকে শহরে। সেখানে রাজনৈতিক নীতি, আর্থিক নীতি আমাদের মধ্যে আরও বেশি করে বিরোধ, বিজয়ের উল্লাস, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ করা, আমাদের মধ্যে অসমতা, আশান্ত লিঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছে।
পুরুষরা মহিলাদের নিয়ে করা বিশেষ কোনও টিভি প্রোগ্রাম দেখতে চায় না। সেরকম কোনও আলোচনা সভাতে অংশগ্রহণ করতে চায় না। রাষ্ট্র কোনও প্রকল্প ঘোষণা করলে সেখানে না না রকম টিপ্পনি করতে শোনা যায়। বিশ্ব দরবারে বা জাতীয় পর্যায়ে যখন নারীদের নিয়ে কোনও আলোচনা বা তাদের কোনও বিশেষ দক্ষতা নিয়ে আলোচনা করা হয়, তখন এই পুরুষদের নিজেদের মনে হয় দুর্বল কিংবা পিছিয়ে পড়া। তখন তারা নিজেদের বাড়িতেই শুরু করে অত্যাচার, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। রেণু খাতুনের ঘটনাটি মনে করে দেখুন।
পরিশেষে তাই বলা যায় বহুমাত্রিক পুরুষ এবং পৌরুষ আর তাদের বহুবিধ দর্শন যেমন পিততন্ত্র, বাকি দর্শনের এখনও নামকরণ হয়নি। কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ সমন্বিত এবং কীভাবে আধিপত্য বিস্তারকারী পুরুষ এবং পৌরুষ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে, আমাদের জানতে হবে এবং বুঝতে হবে। তা না হলে আমরা সারাজীবন রাম আর রাবণের যুদ্ধ দেখে যাব। আর কিছু মানুষ কখনও রামের পক্ষে, আবার কখনও বা রাবণের পক্ষ নিয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধে আশা করে যাবে।
* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।