শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

সূর্পণখার কথা আমার আরও বেশি করে জানতে ইচ্ছে করছিল। তাই আমি একজন খুব বড় মাপের সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ মানুষের কাছে প্রশ্ন করে বসেছিলাম—সূর্পণখার নাক কেটে দেওয়ার বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখছেন? উনি আমাকে এক রকম উত্তর দিয়েছিলেন। সেই উত্তর আমার মধ্যে কীপ্রভাব ফেলেছিল সেটা কেউ জানার চেষ্টা করেনি। সেই সভায় উপস্থিত আর একজন বিশেষজ্ঞ আমাকে ডেকে বললেন, রাম বিবাহিত জেনেও সূর্পণখা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাই (উনি ব্যাঙ্গ করার ভঙ্গিতে) লক্ষ্মণ নাক কেটে দিয়েছিল। আমি শুনে বলছি যে, এই হিংসা আপনি মেনে নিচ্ছেন? গান্ধীজির অহিংসার কথা মানেন না? উনি জবাবে কী বলেছিলেন আমার মনে নেই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল আইনি বিচ্ছেদের মামলায় নারীদের সম্পত্তির অধিকার নয়, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ নারীর নির্ভরশীলতা বজায় রাখা হয়।

তবে শর্ত আছে, নিজেকে সতী প্রমাণ করে যেতে হবে। তার থেকে বিচ্যুত হলে কোর্ট ভরণপোষণের এই নির্ভরশীলতা কেড়ে নিতে পারে। তাই সূর্পণখার নাক কেটে দেওয়ার বিষয় এখনও গল্পে, দৈনন্দিন জীবনে থেকে যায়, থুড়ি রেখে দেওয়া হয়। নারীদের স্থাবর কিংবা অস্থাবর সম্পত্তিতে বা এককথায় অর্থনৈতিক অধিকার দিতে আইন যেখানে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না, সেখানে আমাদের সাধারণ নৈতিকতার মধ্যে নারীকে সমানাধিকার দিতে চাওয়ার ইচ্ছে জাগ্রত হওয়া মুশকিল।

আমাদের দেশে পুরুষদের প্রধান অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে দেখা হয়। পুরুষের অর্থ উপার্জনে যাতে কোনও বাধা না আসে, তাই নারীদের বাড়ির কাজ দৃশ্যত দুই হাত আর অদৃশ্য আরও হাত দিয়ে নাগাড়ে করে যেতে হয়। এই কাজের প্রতিদান স্বরূপ শাড়ি, গয়না প্রভৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মতামত চাওয়া হয় না। কিন্তু যদি দেখা যায় সরকার কোনও বিশেষ ছাড় দিচ্ছে, তখন বউটির নামে কিছু কেনা হল। পরে আবার বিক্রি করে দেওয়া হলেও সেই টাকায় বাড়ির বউয়ের কোনও অধিকার থাকে না।
আমাদের দেশে নারীদের বাধ্য করা হয় বিয়ের আগে এবং সন্তান জন্মানোর আগে চাকরি ছেড়ে দিতে। বিয়ের আগে অবধি চাকরি থেকে পাওয়া টাকা বিয়ের প্রয়োজনে খরচ করা হয়, নয়তো ভাই বা দাদার কোনও ট্রেনিং নিতে খরচ হয়। অর্থাৎ এই টাকাতেও সেই নারীর নিজের অধিকার নেই। সন্তান জন্মানোর আগে ছেড়ে দিতে হয়, কারণ সবাই সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে চায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বামীরা এই মাতৃত্বকালীন ছুটি যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে চাপ সৃষ্টি করে বেশি ছুটি দেওয়ার জন্য। আর এক্ষেত্রে অজুহাত থাকে এখন সন্তান হতে সমস্যা হয়। সবার একটাই সন্তান হয়। তাই অগণিত ছুটি দেওয়া হোক।

সন্তানধারণ করা যদি নারীর শরীরের জন্য সমস্যার হয়, তাহলে নারীকে সন্তান ধারণে বাধ্য করা এবং তার অর্থনৈতিক সুবিধের উপর অধিকার জমিয়ে রাখা এখানে চাকরি করতে দেব কিন্তু স্বামী তথা পরিবারের বউ হওয়ার প্রথা গত শর্ত মেনে চলতে হবে। এই পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করলে মানে দাড়ায় নারীর উপর অবিচার করাই হয় সব ক্ষেত্রেই। তার অর্জিত অর্থের উপর যেমন অবিচার হয় তেমনি এই অবিচার করা হয় নারীর শরীরের উপর, ভীষণ ভাবে। নারীর শরীর তাঁর সম্পদ। অথচ সেই সম্পদের উপর ভাগ বসিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নিজের সত্ত্বা বজায় রাখার জন্য উত্তরাধিকার চাইছে । আমরা কখনওই সেই বিষয় নিয়ে কথা বলছি না। উল্টে আমরা বলছি, সন্তানধারণ করাই নারীর অধিকার। তার বা তাঁর পিতার বা স্বামীর সম্পদের উপর অধিকার নয়। তখন আমরা বলব নারী সব পারে তাই নিজের টা নিজেই করে নেবে। ভালোবেসে কেউ দেবে না তাকে!

নারীর রোজগারের টাকা পরিবারের মূল টাকা নয়, হাবে ভাবে কিন্তু তা কখনও স্বামীদের মদ যোগানের টাকা হয়ে দাঁড়ায়। কখনও আবার স্বামীর সম্পদ বৃদ্ধির কাজে সহায়ক টাকা হয়ে যায়। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও স্বামীদের অসুস্থটা বা অন্য কারণে যেমন কারখানা বদ্ধ হয়ে গেলে নারীকে হয় তো কাজে নামতে হয়েছে। কিন্তু সেখানেও প্রতি পদে সেই নারীকে নিজের নৈতিকতার এবং সীতার মতো অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এরকম পরিস্থিতিতে যখন নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে মামলা করে, তখন সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হল— সেই নারীকে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের দেশের আইন এবং সামাজিক ন্যাবিচার (সোশ্যাল জাস্টিস) কী অধিকার দেয়? কারণ, বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করা নারীর বয়েস যদি ষাটের গোঁড়ায় পৌঁছয়, তখন আরও কিছু বিষয়ের জটিলতা আমাদের সামনে উঠে আসে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩৯: নারীর গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের অধিকার—সমস্যা ঠিক কোথায়?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

আমাদের দেশে মূলত মিতক্ষরা আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম রাজ্যে দায়ভাগ নিয়ম অনুযায়ী ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পত্তির ভাগ করে দিয়ে থাকে। এই ভাগের মধ্যে বাড়ির বউকে আলাদা করে সম্পত্তির ভাগ দেওয়া হয় না, যদি না তাঁর স্বামী মারা গিয়ে থাকেন। এদিকে যাঁদের পরিবারে সম্পত্তির পরিমাণ কম বা বিয়ের সময়ে যৌতুক বা পণ অনেক দেওয়া হয়েছে বলে মেয়েদের কাছ থেকে সই করিয়ে সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হয় ছেলেদের, সেখানে কিন্তু মেয়েটি বঞ্চিত হল। এই বঞ্ছনার হিসেব কেউ রাখে না।

আবার নিজের বাপের বাড়িতে বলা হতে থাকে বিয়ের জন্য যখন অনেক খরচ বাবা করেছেন, তাহলে আর কেন মেয়েটি চাইবে সম্পত্তির ভাগ? এর ফলে মেয়েটির মধ্যে ছোট থেকে এই ধারণা জন্মাতে থাকে যে তার বিয়ের খরচ জোগান দিতে গিয়ে বাবা ফতুর হয়ে যাবে। আবার সমাজের মধ্যে বিয়েতে খরচ না করলেও নয়, তাহলে পরে ভাই বা দাদার জন্য যা থাকবে (যতই সেই সম্পত্তি বাবার কষ্টের অর্জন হোক না কেন) তাতে কিছুতেই নিজের প্রয়োজন আছে বা অধিকার আছে বলা যাবে না। এই কারণে, সমাজে কতজন মেয়ে নিজের বাবার সম্পত্তিতে নিজের অধিকার আছে বলতে পারে তা সমীক্ষা সাপেক্ষ। সামান্য কন্যাশ্রী’র টাকাই অনেকে নিজের পড়ার জন্য বা প্রয়োজনে খরচ করতে পারে না।

এ রকম অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত মেয়েরা কয়েকটি গয়নাকে স্ত্রীধন ভেবে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যায়। সেখানেও এই স্ত্রীধনের উপরে নানা সময়ে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এই নারীরা নিজেদের কর্ত্যব্যে অবিচল থেকে নিজের পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে থাকেন। দু’ বেলা যদি সেই নারী দশ জনের রান্না না করেন তবুও তিনি বাড়িতে থেকে যতটা করেন তাই সেই পরিবারের রোজগারে সহায়ক হয়ে থাকে। তার মানে সরাসরি টাকা রোজগারে নিয়োজিত না থেকেও তিনি কিন্তু অন্যতম পার্শ্ব চরিত্র।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

এখানে নারীকে পার্শ্ব চরিত্রে রেখে আইনি ভাবে বিচ্ছেদ না করে অন্য একটি বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে সেই বিয়ের আগে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশ প্রবল। অথচ ভারতীয় হিন্দু বিবাহ আইনে একজন নারী বা পুরুষ একজন পুরুষ বা নারীকে বিবাহ করতে পারে। সেখানে একাধিক বিয়ে করার আইনি অধিকার নেই। এ ভাবে আমাদের হিন্দু বিবাহ বা সম্পত্তির অধিকারকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে এই বিধিবদ্ধকরণ এখনও হয়নি। আমাদের হিন্দু ধর্মে বিধিবদ্ধ করার পরেও একাধিক বিয়ে আটকান যায়নি। কিছুদিন আগেই ঝাড়খণ্ডের একজন অধ্যাপক এবং আইনজীবীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। দু’ জনেই জানালেন প্রথম বিয়ের থেকে আইনি বিচ্ছেদ নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তারপর দ্বিতীয় স্ত্রীকে না জানিয়ে তৃতীয় বিয়ে করেছে। ৫ লাখ টাকা পণও নিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের চিত্র খুব আলাদা কিছু নয়। এই সব বিয়ে করে আনন্দ করে, পরিষেবা নিয়ে আরাম করে কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে খোরপোষ চাইলে কিন্তু আনন্দ করে দেয় না। কোর্টে ভুল অঙ্ক লেখা পে স্লিপ দিতে দেখা যায়, যাতে খোরপোষ কম দিতে হয়। অনেক পুরুষ চাকরি ছেড়ে দেয়। আরও কিছু পুরুষ নিজেকে গরিব সাজিয়ে পীড়িত পুরুষ বলে প্রচার করতে থাকে। এরকম এক পুরুষের বক্তব্য ছিল, নিজের দুটি ফ্ল্যাটের একটায় থাকতে দিয়েছি যখন, তখন খোরপোষ বেশি দিতে যাব কেন? আর একজনের বক্তব্য, স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে যে বাড়ি পেয়েছে তার মূল্য কোটি টাকা, তাই খোরপোষ দেব না। কারণ, তিনি নিজে এরকম কিছু সম্পদ নিজের বাবার থেকে পাননি। তাই তিনি স্ত্রীর থেকে গরিব। তখন সেই স্ত্রী বলেছিলেনম তিনি যে নিজে কাজ না করে সন্তান মানুষ করেছেন, স্বামীকে কেরিয়ার তৈরি করতে সাহায্য করেছেন তার কোনও মূল্য নেই? তিনি আজ মধ্য বয়েসে পৌঁছেছেন। তাই তার ভেঙ্গে যাওয়া শরীরের কোনও দাম নেই। স্বামী তাই অন্য নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাই নিয়ে প্রতিবাদ করা যাবে না। আবার খোরপোষও চাওয়া যাবে না। সন্তান এই পরিস্থিতিতে কী করবে অনেক সময় বুঝতে পারে না। ফলে পরিস্থিতি আরও ঘোরাল হতে থাকে। সন্তান যতই বড় হয়ে যাক না কেন তার কাছে মা-বাবার যৌথ জীবন অনেক স্বস্তি এনে দেয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

আমাদের আইনি ব্যবস্থা কিন্তু বলে না যে নারী সম্পত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, তাকে শুধু খোরপোষ দেওয়ার মধ্যে স্তিমিত না রেখে সেই সম্পত্তির ভাগিদার করা হোক। কারণ, নারীর অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাকে যতটা অসহায় করে তোলে, বাকি আর কিছু করে না। বহু নারী এই কারণে বিচ্ছেদ চাইতে পারে না। সন্তান নিয়ে সে কোথায় যাবে? নিজের বাড়িতে বলা হচ্ছে বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়েছে, তাহলে আবার কেন ফিরে আসতে চাইছে। কে দায়িত্ব নেবে। অনেক সময় বাবা-মা সাহায্য করতে চায়। কিন্তু তারাও বয়সের কারণে পারে না। এই অসহায় ব্যাপারটি থেকেই যায়, যখন তার নির্ভরশীলতা থেকেই যায়, আইনের কাছেও খোরপোষের উপর নির্ভরশীলতা। আমরা কোথাও যেন ধরেই নিচ্ছি নারী একা সম্পত্তি হিসেব করে রাখতে পারবে না। ধরেই নিচ্ছি নারীকে সাহায্য করতে হবে সারাজীবন। তার নির্ভরশলতা সমাজে পিতৃতন্ত্রকে বজায় রাখবে।

আমাদের এই খোরপোষের বাঁধন থেকে বেরোতেই হবে। বলতে হবে—দিলে অর্ধেক সম্পত্তির অধিকার দিন। মাসে মাসের খুচ খুচ টাকা দেওয়া আর ভয় দেখান যে তুমি অন্যকে বিয়ে করলে, ভালোবাসলে কিন্তু সব কেড়ে নেব। স্বামী এবং তার বাড়ির লোক গোয়েন্দা লাগিয়ে বসে থাকবে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া তার বউ সতী থাকতে পারছে কি না। নারীকে যদি সারাজীবন সতী থাকার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়, তাহলে আর যাই হোক দেশের প্রগতি হওয়া সম্ভব নয়। আর মানুষের হুঁশ-যুক্ত মানুষের বদলে দুই পেয়ে জীব হয়ে হয়ে থেকে যাওয়াটাই ভবিষ্যৎ।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content