শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

এই বিরোধ জবানি লিখতে গিয়ে আমি বেশ ভালো মতোই অনুভব করতে পারছি আপনাদের মনে না না রঙের প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। না না ধরনের, না না স্তরে থাকা মানুষজন বলতে চাইছেন আমাকে যে, সব দোষই কি পুরুষের? আপনি জানতে চেয়েছেন কেন পুরুষ মদের নেশাতে আসক্ত হয়? তারা যে প্রতি নিয়ত নারীর দ্বারা অত্যাচারিত হয়, সেটা কি আমি জানি? আরও প্রশ্ন ধেয়ে আসছে, এই যে আপনি বলেছেন পুরুষের শরীর নেই, অথচ তাকে সিক্সপ্যাক বানাতে হচ্ছে, ফর্সা হওয়ার ক্রিম মাখতে হচ্ছে, সেই বিষয়টিকেই বা কীভাবে দেখবেন?

আচ্ছা, তাহলে এই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি। কিন্তু যে ভাবে প্রশ্ন উঠেছে সেই সরল পথে উত্তর খোঁজা যাবে না। কারণ, সেই পথে এগলে গলি পেরিয়ে সেই চৌ মাথার মোড়ে অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যা চায়, নারীরা খারাপ বলে পুরুষ গালমন্দ করুক আর নারী পুরুষ খারাপ বলে ধিক্কার জানাক, কিন্তু ফাঁক গলে পুরুষতান্ত্রিক বিপরীতকামিতা থেকে যাবে। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ জিতে গিয়েছি বলে আনন্দ করবে। অর্থাৎ কাঠামোর মধ্যে কার ফাঁক না ধরতে পারলে সারাজীবন কে কতটা স্বাধীনতা পেল তার লড়াই হতেই থাকবে। অর্থাৎ আর একটু গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে।
আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এই নারী পুরুষ লিঙ্গ বিভাজন কীভাবে করে সেই কারখানার হিসেব দেখতে হবে। এই সংখ্যায় আমি অষ্টবক্র মুনির কথা দিয়ে বলতে চাই। কারণ, খুব পরিষ্কার আমার কাছে। এই সমাজ কীভাবে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে কতগুল মুল্যবোধের আবরণ তৈরি করেছে। সেই আবরণ পুরুষ এবং নারী কারওই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। যে মুহূর্তে এড়িয়ে যেতে চাইবেন সেই সময়ে আক্রমণ নেবে আসবে শরীরে। শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করলে মনেরও ক্রমশ মৃত্যু হয়।

আমরা সবাই পুরাণ বর্ণিত এই মুনির কথা শুনেছি। মুনির জন্মবৃত্তান্ত থেকেই শুরু করছি কারণ রহস্য সেখানেই লুকিয়ে আছে। মুনির পিতাও মুনি ছিলেন। মুনির পিতা মুনি তাঁর মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মাকে বিভিন্ন শাস্ত্র শোনাতেন। অনেকেই ব্যাখ্যা করেন যে, মুনি কে শাস্ত্রজ্ঞ্য পণ্ডিত করে তুলবেন বলে পড়ে শোনাতেন। কোথাও আবার বলা হয়েছে, স্ত্রীকেই শোনানর জন্য পড়তেন। এই শোনাতে গিয়ে বিপদে পড়লেন মুনি। ভুল হয়ে গিয়েছিল কিছু বিষয় বলতে গিয়ে। যে ছেলের জন্ম হয়নি তাকে আরও বেশি পণ্ডিত করার মাসুল দিতে হল। সেই না জন্মানো ছেলে বাবার ভুল ধরে বসলো। পণ্ডিত বাবার পাণ্ডিত্যের ভুল ধরা মেনে নিতে পারলেন না। এখানে ভুল ধরার আগেও যে ঘটনাটা আগে পর্যালোচনার টেবিলে আসে সেটা হল জন্মের আগে থেকেই আমরা সেই সন্তানের লিঙ্গ কী হবে সেই নিয়ে চিন্তিত হয়ে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৮: মাতৃভাষায় লিঙ্গ বৈষম্য-বিরোধ জবানি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

এই গল্পে মুনি পিতা একদম নিশ্চিত ছিলেন তাঁর পুত্র সন্তান হবে। এই ধরনের গল্প সমাজে জিইয়ে রাখে আমাদের আকাঙ্খা যে বংশ রক্ষা করার জন্য, নিজের বুদ্ধিমত্তা বা যাকে আমরা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বলে থাকি সেটাকেও বংশ পরম্পরায় বজায় রেখে সমাজে ক্ষমতাবান হিসেবে রয়ে যাব। এটাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ঘেরা টোপের মধ্যে তাই নারী, পুরুষ এবং অন্য লিঙ্গের মানুষ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তারা কেউ বেরিয়ে আসতে পারছে না, এই বিষমকামী চাহিদা থেকে। ফলে কোথাও একটা এই বিরোধ জবানিগুলো স্বকীয় আওয়াজ তুলে ধরতে পারছে না। পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণের মধ্যেই আমরা বলছি নারী মুক্তি চাই, পুরুষ অত্যাচারিত হয়ে চলেছে, সমকামীদেরও বিয়ে করার অধিকার দিতে হবে।

আবার আমরা গল্পে ফিরে যাই। জন্মের আগেই পিতার ভুল ধরার অপরাধে পিতা অভিশাপ দিলেন এই শিশুর শরীর বিকৃত হবে। মুনির শরীরে আটটি বাঁক থাকবে এই ছিল অভিশাপ। আবার রাজা ভগীরথের শরীরে অস্থি ছিল না, কারণ তিনি মাতা এবং বিমাতার সাহায্যে জন্মেছিলেন। কোনও পুরুষের ঔরসে জন্মাননি বলে তাঁর শরীরে অস্থি ছিল না। এই দুই জন্ম ইতিহাস দুই পুরুষের অস্বাভাবিক শারীরিক গঠনের কথা বলছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, শরীরের সঙ্গে পৌরুষ অর্থাৎ বিষমকামী সম্পর্ক ছাড়া বিবাহ সমাজে গ্রহণীয় নয়। আর নারী একা দুর্বল। তাই তার একা হাতের সন্তান শারীরিক ভাবে দুর্বল। নারীকে সমাজ দুর্বল রূপেই আবার প্রতিষ্ঠা করল।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

আরও তলিয়ে ভাবলে ভাবনায় উঠে আসে যে, পুরুষকে কীভাবে শরীরের ভয় দেখালো সমাজ। এখানে দুটি ভয় দেখানো হয়েছে আসলে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মূল্যবোধ যে পিতার ভুল কখনও ধরতে পারবে না। তুমি পুরুষ যখন সেই পিতার জায়গায় পৌঁছবে তখন তুমিও একই রকম আচরণ করবে। অবশ্য নারী কখনওই কোনও পুরুষের ভুল ধরবে না। সে বয়সে ছোট হোক বা বড় হোক। এই ক্ষেত্রেও অষ্ট্রবক্র মুনির মায়ের কথা আমরা কোথাও শুনতে পাই না। সন্তান তো তাঁরও। তবুও তার বলার কোনও জায়গা নেই। তিনি পিতার অভিশাপ কেই শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাই নিজেকেই চুপ করিয়ে রাখতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর শরীরকে কামনার ক্ষেত্র মনে করল। তাই পুরুষদের নিজেদের শরীরকে নির্দিষ্ট কামনাকে বাস্তবায়িত করার মাধ্যম হিসেবে মনে করল।

বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদীরা এই বিষমকামী বিষয়টিকে বাজি ধরে পুরুষকে বলতে শুরু করল তোমরা নিজেদের শরীরকে গড়ে তোলো বিভিন্ন প্রোডাক্ট দিয়ে। প্রকৃতিতে অন্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায় যেমন ময়ূর বিশাল পুচ্ছ ধারি, মনোময়, কিন্তু ময়ূরী কিন্তু এ রকম সুন্দর নয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

মানুষের ক্ষেত্রে উল্টো বিষয় দেখা যায়। নারী মানুষের রূপের বর্ণনা লিখে গিয়েছেন কবিরা বারে বারে। পুরুষের বাহু কত লম্বা, সেটার বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে পুরুষ মানুষের বর্ণনা। ব্যতিক্রম আছে কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় কম। এখন শরীর হয়ে গিয়েছে পণ্য। তাই উভয় নারী ও পুরুষের শরীরের কাঠামো নিয়ে উভয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মজার কথা এই দুই লিঙ্গের বাইরে কিন্তু শরীরকে নিয়ে যেতে চাইছে না কেউ।

এ বার ফিরে আসি গল্পের পরিণীতির দিকে। অষ্টবক্রের নাম তাঁর শারীরিক গঠনের সমরূপ রাখা হয়েছে। এ ভাবে সমাজে আমরা অভ্যস্ত হলাম যে, শারীরিক গঠন নিয়ে সমাজে পরিচিত করবো মানুষদের। তাদের গুণের থেকেও এই গঠন কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমাদের পরিচিতি তৈরি করবে সমাজ নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য। তাই মানুষ অসুখ করেছে এই বিষয়টি চট করে সামনে আনতে পারে না। সমাজ অসুস্থ শরীরকে পছন্দ করে না।
আরও পড়ুন:

তোমরা কি জানো cakewalk বা icing on the cake —এই idiom গুলোর মানে কি?

হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?

অষ্টবক্র যদি সারাজীবন এই সমাজ নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াই থাকতেন তাহলে আমরা অন্য বার্তা পেতাম। কিন্তু আমরা কী বার্তা পেলাম?
অষ্টবক্র নিজের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারলেন। সেই সঙ্গে জানতে পারলেন যে, তার পণ্ডিত পিতা, তর্ক যুদ্ধে হেরে গিয়ে জলের তলায় রয়েছেন শাস্তি হিসেবে। অষ্টবক্র তারপর নিজে গিয়ে সেই পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক করলেন এবং হারিয়ে দিলেন। হারিয়ে দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ পিতাকে জল থেকে উদ্ধার করলেন। পিতা তখন গর্ব অনুভব করলেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, একটি নির্দিষ্ট নদীতে স্নান করে সমাজ নির্দিষ্ট চেহারার হওয়ার জন্য।
সমাজে সন্তানের ভূমিকা কী হবে সেটাও বলে দেওয়া হল। সন্তান অর্থাৎ পুত্র সন্তান বাবা-মাকে সব রকম পরিস্থতিতে রক্ষা করবে কিন্তু ভুলে যাবে তার সঙ্গে কী খারাপ ব্যবহার তাঁরা করেছিলেন।

ভারতীয় সমাজে এ ভাবে এক পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে একটি আদান প্রদানের ব্যবস্থাকে স্থায়ী করা হয়েছে। এই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে পুরুষের শরীরকে দেখা হয়েছে উৎপাদনক্ষম হিসেবে। যখন শরীর বিশেষ ভাবে সক্ষম হয়, তখনও তাকে সক্ষম বলা হচ্ছে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ, একটি মেয়ের তুলনায় পুরুষ শক্তিশালী এই বিষয় টি যাতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত থেকে যেতে পারে। বাস্তবে যতই সেই মেয়ে টিকে সারাজীবন পরিষেবা দিয়ে যেতে হোক না কেনো। সমাজ সামনে বলবে একটি মেয়ে কে সম্প্রদান করে উদ্ধার করা গেছে আর পিছনে বলবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ রক্ষা পেয়েছে। সমাজ বন্ধুত্ত্ব, ভালোবাসা প্রভিতি বিষয় কে পাত্তা দিতে চায় না কারণ এই বিষয়ের মধ্যে আইনি ধারা আরোপ করা মুশকিল।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content