মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

যে সমাজে নারীদের মুখ খুলে কিছু বলতে শুনলে সমাজ পতিরা রে রে করে দমন করতে চান সেখানে সেই নারী নিজের অসুখের বর্ণনা কতটা সাবলীল ভাবে চিকিৎসকের কাছে বলে উঠতে পারবেন, একটু ভেবে দেখার প্রশ্ন।

প্রথম লাইন পড়েই আপনারা বলে উঠবেন কী এমন কঠিন কাজ? এইতো মায়ের পা কন কন করে প্রতি অমবস্যা/ পূর্ণিমা তিথিতে আর তা তিনি প্রতিবার ডাক্তারবাবুকে তা জানান আর ডাক্তারবাবু ওষুধ লিখে দেন। মা খুশি মনে ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরে আসেন। সঙ্গে কাউকে একটা নিয়ে যায় সঙ্গে, হয় বউমা, নয়তো বাড়ির কেউ। বউ অসুস্থ হলে, সেরকম হলে সঙ্গে যেতে হয়, না হলে নিজেই দেখিয়ে নেয়। তারপর প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ দোকান থেকে ওষুধ বুঝে বাড়ি আসে।

এবার আমি বলব আপনি একদিন লক্ষ্য করবেন যেদিন এই ডাক্তার দেখানোর পর্ব চলে সেদিন সবাই কমবেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। এই থাকাটা শুধু অসুখের আগমন নির্ণয়কে নিয়ে নয়, চিন্তা নিয়ে থাকে ডাক্তারবাবুকে সঠিক ভাবে সমস্যাটা বলতে পারব কিনা তা নিয়ে। আমি বলব, এই চিন্তা শুধু বলতে পারবো কিনার মধ্যে সিমাবদ্ধ নয়, তার সঙ্গে যুক্ত থাকে অসুখ হয়েছে জানলে সমাজ আমাকে কীভাবে নেবে, পরিবার আমাকে কীভাবে দেখবে।
নারীদের যে অসুখ হতে পারে আর তা সারিয়ে তোলার জন্য পথ্য এবং যত্নের যে নিবিড় যোগাযোগ আছে, তা আমরা খুব বিস্তারিত ভাবে আলোচনা বা ভাবতে পারি না। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সামাজিক ভূমিকা যেমন ধরুন নারীর জন্য ধরাই আছে যে তিনি ঘরের কাজ করবেন, মায়ের ভূমিকা পালন করবেন অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। সেই সঙ্গে ধরে নেওয়া হয়, এই ভূমিকাতেই তার সমস্ত সত্ত্বা জড়িয়ে আছে। আর এখান থেকে তার বিচ্যুত হওয়ার কোনও সম্ভবনা থাকা যাবে না। এতটা কঠিন করে বলার কারণ, নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে নারীকে অসুস্থতা লুকিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে বলেও কাজ করে যেতে হয় যতক্ষণ না সে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়েছে বা মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর পর আবার নতুন করে মৃতের স্বামীকে বিয়ে করতে বলা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে। পুরুষের ক্ষেত্রে তার কাজের জায়গাতে তার অসুখের গোপনীয়তা কখনও প্রয়োজন হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিয়ে হয়ে না থাকলে বিয়ে করার উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। নারীকে তাই সেবাদাসী হয়ে থেকে জেতে হয় নিজের অসুস্থতাকে পাশে সরিয়ে রেখে বা হেয় করতে শিখে যে এই অসুখ এমন কী অসুখ এতসব গায় মাখলে চলে না, বলে। আবার অন্যদিকে সমাজে অসুখকে নিয়ে অন্য একটি বিষয়ের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তা হল অসুখ করে শয্যাশায়ী না হলে পরিবারের, স্বামীর মনোযোগ, পরিচর্যা, সহানুভূতি পাওয়া যায় না। তাই সেই প্রচেষ্টাও থাকে যে, আমার একটা কঠিন অসুখ করুক, তাহলে যদি এরা মনে করে আমি বেঁচে আছি। আমাদের সমাজে সেই অর্থে কারা কোন অসুখ নিয়ে ভাববে, আর কারা ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে তার একটা সুস্পষ্ট থাকবন্দি বা পিরামিডের মতো কাঠামো করা আছে। সুতরাং এই অসুখ এখন সামাজিক বিষয় এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ মিলে পরিণত হয়েছে একটি দর্শনে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

খুব সাধারণ ভাবে ভাবলে দেখব অসুখ আসলে শরীরের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে। আমাদের স্বতন্ত্রতা বাধা প্রাপ্ত হয়। আমরা কঠিন বা ক্রনিক অসুখ হলে প্রথমে হাল ছেড়ে দিয়ে থাকি। তারপর ধীরে ধীরে বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজতে থাকি। কিছু বিষয়কে পাশে সরিয়ে রাখি যেমন ডায়বেটিস হলে কিছু খাবারের বিধি নিষেধ চেপে বসে। তা ছাড়া বাকি কাজ সে ভালোভাবেই করে নিতে থাকে। কিন্তু সমাজ এই বিধিনিষেধের সঙ্গে জুড়ে রাখে আর একটি সীমা রেখা। সেটি খুব সূক্ষ্ম এবং ক্ষেত্র বিশেষে বেরিয়ে আসে প্রকাণ্ড রুপে। আমরা যদি দেখি নির্দিষ্ট বয়সের আগে বা বিয়ের আগেই মেয়েটি এরকম অসুখ করল যে তাঁর অস্ত্রোপচার করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে অনেক রক্ষণশীল পরিবার পিছিয়ে আসে। কারণ সেই শরীরে দাগ পড়ে যাওয়া, যদি হবু শ্বশুরবাড়ি মেনে না নেয়? তাই শরীরে, মুখে কোনও দাগ পড়তে দেওয়া যাবে না। আর যদি দাগ দেখা দেয় তাহলে লাখ লাখ টাকা খরচের সংগ্রাম চলতে থাকে। বাকি অসুখগুলকে বলা হয় লুকিয়ে রাখতে। সমাজে বলা যাবে না তোমার এরকম কোনও অসুখ আছে। আবার প্রকাশ্যে বললে শুনতে হবে, তুমি বিয়ে করে সংসার করবে কী করে? তোমার শরীর দাম্পত্য জীবন কাটানোর মতো উপযুক্ত নয়। ফলে নারীর অসুখ হলে তিনি কোন দিন মুখ ফুটে বলে উঠতে পারে না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

দশভুজা: ‘পুরুষ মানুষের কাজে হাত দিলে এমনই হবে, মহিলাদের এসব সাজে না’

নারীদের রোগ লুকিয়ে লাভ হয়েছে তাও নয়। বিয়ের পর রোগ প্রকাশ পেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি ফেরত দিয়ে গিয়েছে, নয়তো বাপের বাড়ি থেকে টাকা চাওয়া হয়েছে অসুখ সারানোর জন্য। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অসুখকেও টাকা পয়সা, বিয়ে টিকবে টিকবে কিনা, সব দ্বিমুখী, ক্ষমতা কেন্দ্রিক সম্পর্কের মাঝখানে রেখে দিয়েছে। আর তার ফলাফল? একটা ছোট্ট বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি মেয়ে সবে কলেজ পাশ করেছে। সে-সময় তার টিবি অসুখটি ধরা পড়ে। সরকারি কেন্দ্রে চিকিৎসা শুরু হয়। আমার দুটো লাইন লেখার মাঝে এক বছরের গ্যাপ আছে এটা ধরে নেবেন। যেহেতু মেয়ের বিয়ে হয়নি, মাথা ঢেকে কেশেছে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ফলে নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসা চলাকালীন যদি কাছের লোকজন জেনে যায়, এসব মেয়েটির বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয় তার অসুখকে লুকিয়ে। চিকিৎসা কেন্দ্রে এসে মিষ্টি খাইয়ে বলে গেল বিয়ে করে অন্য শহরে চলে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, চিকিৎসার কী হবে? উত্তর এল এখন ভালো আছি, সমস্যা হবে না। চিকিৎসা কেন্দ্রের লোকজন জানাল এ ভাবে টিবি অন্য একটি পরিবারে ছড়িয়ে পড়বে।

ভারতীয় দর্শন, পাশ্চাত্য দর্শন অসুখ নিয়ে আলোচনা করেছে। এই আলচনায় দুটি দিকের উল্লেখ জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত চিকিৎসক এবং দ্বিতীয়ত চিকিৎসালয়ের ভূমিকা। আধুনিক চিকিতসা ব্যবস্থা অনেকটাই রোগীকে দেখার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। আর চিকিৎসাকেন্দ্রগুলি পরীক্ষাগারে স্যাম্পল টেস্ট করে রিপোর্ট তৈরির পাশাপাশি মৃত্যু পথ যাত্রীর জন্য যাত্রাপথ তৈরি করে দেওয়া হয়। আর লেবাররুমে নতুন প্রাণের আগমন হয়। এই পুর বিষয়টির মধ্যে নারীর অবস্থান কোথায় আছে? অবস্থান নির্ণয় করার জন্য আবার কিছু কিছু বিষয়কে সামনে আনতে হবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

প্রথমত, নারী নিজের রোগের বর্ণনা কীভাবে করেন? দ্বিতিয়ত, চিকিৎসা কি তারা সম্পূর্ণ ভাবে করেন? তৃতীয়ত, চিকিৎসার জন্য তাঁরা কতটা পরিবার থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন? চতুর্থত, বিষয় গৃহ-অশান্তির কারণে যে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তার কি উপযুক্ত চিকিৎসা হয়?

নারী অসুস্থ হয়ে নিজের অসুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে যদি জ্বরজ্বালা বা ব্যথায় কাতর হয়ে নিজের অবস্থার বাড়াবাড়ি বর্ণনা করেন, তাহলে কি আমরা তার অন্য ব্যাখ্যা করব, নাকি চেষ্টা করব জানার আপাতভাবে উনি যা বলছেন আদপে সেই সমস্যা তাঁর হয়নি। চিকিৎসকের ভূমিকা সেখানে অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী সারা রাত মদ্যপান করে বাড়িতে হুজ্জতি করে। স্ত্রী সেই চাপ নিতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আবার স্বামীকে এ নিয়ে অনুযোগ করলে উত্তর আসছে তার মদ্যপানের কারণ কোনও নারীবাদী জানতে চাইছে না কেন? বর্তমানে বহু ক্ষেত্রেই শোনা যাচ্ছে এরকম ধরনের আক্রমণ জে নারীবাদীরা এক চোখা। তারা শুধু নারীদের উপর অত্যাচার দেখে কিন্ত পুরুষের উপরে হওয়া তারা দেখে না। তাই তিনি রাজি নন তার কৃতকর্মের দায় ভাগ নিতে। তিনি নিজেকে কোনও কারণের শিকার বলে মনে করছেন। স্ত্রী লজ্জায় ডাক্তারবাবুকে বলে উঠতে পারছেন না। ফলে স্ত্রী একটি প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসছেন, আর ক্রমশ অবসাদে তলিয়ে যাচ্ছেন। এরকম বহু বিষয় আছে, যেগুলির কারণে নারীকে সারাজীবন বিনা চিকিৎসায় ভুগে জেতে হয়। স্বামীর, ছেলের চিকিৎসায় টাকা খরচ হয়ে যায় কিন্তু নিজেদের কথা বলতেই পারেন না। স্ত্রীর সন্তান না হলে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে মহিলা চিকিৎসক হলে ভালো। কিন্তু চিকিৎসাকেন্দ্রে অপরিষ্কার বাথরুম নিয়ে আবার স্বামী অদ্ভুত ভাবে চুপ থাকেন।

তাই আজকের আলোচনার শেষে এসে বলতে হয়:
“এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে—সেই সব।”

— জীবনানন্দ দাশ, কবিতা: ‘বোধ’।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

ছবি: লেখিকা
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content