মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আমাদের সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে আছে পরিবার গঠনের ইচ্ছের উপর। এই ইচ্ছের বড় অংশ হচ্ছে বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দানের মধ্যে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্মকে সমাজে সুনিশ্চিত করা। সমাজে এই মূল ভাবনার পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম ভাবনা জুড়ে গিয়েছিল, যেমন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ যখন লড়াই করেছে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠী তখন নতুন সৈনিকের প্রয়োজন হয়েছে। নারী তখন বাধ্য হয়েছে নতুন সৈনিকের জন্ম দিতে। অথবা অসুখের প্রকোপে কারণ পৃথিবীতে না না সময়ে বিভিন্ন মহামারী হওয়ার কারণে এবং সেই সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রলুতার কারণে যখন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, জন্মের সংখ্যার থেকে বেশি তখন মানুষ নামক প্রাণীটিকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার জন্য সন্তানের জন্ম দিতে নারীদেরকেই সমাজ বাধ্য করেছে, এগিয়ে দিয়েছে জন্ম দেওয়ার জন্য বারে বারে। এভাবে সমাজে নারীর সঙ্গে তার উর্বরতার বিষয়টি গভীর ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই নারী মানেই সমাজ ধরেই নেয় যে, তার মূল কাজ সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং তাকে মানুষ করে তোলা।

কাজেই সমাজ রুষ্ট হয়েছে সেই সব মেয়েদের উপর যাঁরা সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়াতে অংশ গ্রহণ করেনি এবং যাঁরা চেষ্টা করা সত্ত্বেও পারেনি সন্তানের জন্ম দিতে। এঁদের সমাজ স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি। আমাদের লোককথা, রূপকথার গল্পেও বারে বারে উল্লেখ করতে দেখা যায় যে, রানিদের সন্তান না হওয়ার কারণে রাজা বহু বিবাহ করে নিচ্ছেন। তারপর রাজা কোনও একজন মুনি বা ঋষির পরামর্শ মেনে বিশেষ কোনও মন্ত্রপূত ফল বা তাবিজ কিছু ক্ষেত্রে মুনি বা ঋষিরা নিজেরাই কোন পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাতেন। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সবসময় নারীর সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে বিশেষ তৎপরতা দেখিয়েছে। নারীদের সে ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ের যদি বলি তার মানসিক স্বাস্থ্য এবং শরীরের অবস্থা কেমন হয়েছিল তাই নিয়ে আমি কাউকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখিনি। সেই সঙ্গে সন্তান উৎপাদনে পুরুষের যে ভূমিকা থাকতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে অদ্ভুত একটা নিরবতা আছে। এই নীরবতা এখনও বর্তমান। পুরুষের শারীরিক কাঠামোর থেকে তার প্রতাপশালী মানসিক উপস্থিতিকে পিততন্ত্র যে ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে তার ফলে পুরুষের শারীরিক সমস্যাকে কখনই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কখনও দেখা গিয়েছে, পুরুষের শারীরিক অসুস্থতাকে নারীর অবহেলার কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। উলটে বাজার অর্থনীতির যুগে সন্তান হওয়ার আগে বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। মাতৃত্বকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা খুব সচেতন ভাবে করা হচ্ছে। বাজার অর্থনীতি এই উৎসব আয়জনের কথা বলে শুধু মুনাফা লুটছে তা নয়, চিকিৎসা গবেষণাতেও ভীষণ রকম ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ছে। যার ফলাফল আরও মারাত্মক।
নারীর সন্তান জন্মদিতে না পারার দুঃখে যখন সমাজ আরও বেশি বিরক্ত করা বাড়িয়ে দিয়েছে, উদার অর্থনীতির ঢেউয়ের প্রভাবে বড় পরিবার যখন ভেঙে ছোট পরিবার হয়ে গেল, তখন পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নারীদের উপর পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়ার চাপ বাড়তে লাগল। তখন চিকিৎসাশাস্ত্র নতুন করে গবেষণা শুরু করে দিল। এই গবেষণার আর একটি বড় কারণ হল পরিবেশ দূষণ এবং এর সঙ্গে যুক্ত আরও নানা কারণের ফলে পরিবর্তিত জীবনশৈলীতে ক্রমেই মানুষের সন্তানের জন্ম দেওয়ার হার কমে যাচ্ছে। আবার ঊষরতা বা বন্ধ্যত্ব দেখা দিচ্ছে। ফলে মানুষের মনে যে ভীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে, সেই ভীতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে এক প্রকার ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাকে জাগিয়ে দিয়ে আইভিএফ বা ইনভিট্র ফারটিলাইজেশান বা বলতে পারি রিপ্রডাকশন প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটান হচ্ছে। এই প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে নারী শরীর থেকে ডিম্বাণু নিয়ে স্বামীর শুক্রাণুর মধ্যে মিলন ঘটিয়ে এমব্রয় তৈরি করা হয় পরীক্ষাগারে। অর্থাৎ আমরা যে বিষয়টি শরীরের মধ্যে ঘটে বলে জানি সেই বিষয়টিকে শরীরের বাইরে করা হচ্ছে। এই ঘটনা যতটা মনে হচ্ছে সহজ, ততটা একদমই নয়। সেই কারণেই এই ‘বিরোধ-জবানি’ লিখতে বসা।

প্রথমত এই প্রক্রিয়া খুব ব্যয়সাধ্য। সাধারণ জ্বরের চিকিৎসা করার মতো নয়। বহুক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে কলকাতা শহরে মশাবাহিত রোগের চিকিৎসা করাতে চায় না বা করলেও ওষুধ মনে করে খেতে গিয়ে ভুলে যাওয়ায় সংখ্যা অনেক। সেখানে এই রকম চিকিৎসা করতে রাজি হওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই রকম ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ কিন্তু আপনাকে সব মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স বা বিমা কোম্পানি দেবে না। তাদেরকে কারণ জানাতে বললে তারা বলবেন, এই ধরনের সমস্যা খুব সাধারণ। তাই তারা চিরকালীন ভিত্তিতে ঊষরতা বা বন্ধ্যাত্ব এবং মাতৃত্ব বিষয়কে তাদের পলিসি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি: পর্ব-১৩: যৌন নিগ্রহের রোজনামচা এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া

ডায়েট ফটাফট: ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? কোন কোন খাবারে বশে থাকে এই সমস্যা? জেনে নিন কী খাবেন, কী নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?

এবার তাহলে প্রশ্ন ওঠে, পুঁজিবাদ একদিকে যখন চিকিৎসার খরচ দিতে অস্বীকার করছে, তখন তারা আগত বা সন্তানের জন্মের পর কী কী প্রসাধন লাগবে তাই জানিয়ে পন্য বিক্রি করে চলেছে কেন? ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলো ওষুধ নিয়ে গবেষণা এবং তৈরি দুটোই চালিয়ে যাচ্ছে কেন? কোথাও কি মনে হচ্ছে না, নারীরা আসলে সব দিক থেকেই বঞ্চিত। তাদের শুধুই সেবা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রাখা হচ্ছে। নারীদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাকে অতি সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। যেখান থেকে তাদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে, হয় নিজেদের কেরিয়ারকে পিছনে রেখে দ্রুত মা হও, না হলে যারা তোমার চিকিৎসার জন্য খরচ করছে তাদের কাছে চির ঋণী থেকে যাও। নারীর আসলে কোথাও নিজের সত্তা প্রকাশের অধিকার নেই। তাকে সবসময় কারও উপরে নির্ভর হয়ে থেকে যেতে হবে। একমাত্র সন্তানের জন্ম দিতে না পারার দায় নিজের ঘাড়ে নিতে হবে। বহু নারীকে আমি বলতে শুনেছি জে তারা খুব দুঃখিত কারণ তারা তার স্বামী কে সন্তান সুখ দিতে পারেনি। তারা জে মানসিক, শারীরিক ভাবে সাহায্য করে চলেছে তাদের স্বামী দের সেই বিষয়টির কোনও গুরুত্ব নেই। নারীদের যেহেতু কোনও সম্পদের মালিক হওয়া থেকে বিরত করা হয় সমাজে তাই সমাজের অর্থনীতির দাবী মত নারীদের কোনও শ্রমের মুল্য নেই।

বাড়ির অভ্যন্তরের বিষয়কে নিয়ে আসা হচ্ছে বাড়ির বাইরে চিকিৎসকের টেবিলে। আমাদের দেশে যেখানে যৌন জীবনকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আইন করে রেখে দেওয়া হয় সেখানে সন্তান না হওয়ার কারণ খুঁজতে চাওয়া চিকিৎসককেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয় আসল কারণগুলিকে প্রেসক্রিপশনে লিপিবদ্ধ করতে। কারণ স্ত্রীয়ের যেখানে কোনও ক্ষমতা নেই নিজের বিষয়ে বলার জন্য, সেখানে পুরুষ কোনওভাবেই চায় না তার অসুবিধেগুলোকে পরিষ্কার করে সামনে আনতে। অনেক বলার বা বলা ভালো কাউন্সেলিং করার পর যখন টেস্টগুলো করতে রাজি হয় তখন শুরু হয় এক অন্য অধ্যায়। কে চিকিৎসা করাবে আগে? পুরুষ কি কখনও বন্ধ্যাত্বের শিকার হতে পারে?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিষয় খুব তাৎপর্যময়, তা হল এই ঊষরতা বা বন্ধ্যত্ব কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে চিকিৎসাশাস্ত্র। আমরা চিকিৎসা ব্যবস্থার এই চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান বা কোন তথ্য সবার সামনে এলে কাদের লাভ বেশি হবে, সেই বিষয় যে ক্ষমতা ধরে তার কাছে সবাই কম বেশি নতজানু।কারণ শরীরের জটিল নক্সা, কিংবা রোগের উপশমের তথ্য চিকিৎসক কেই রাখতে হয়। এই শাস্ত্র বলে এক বছর ধরে সন্তান হওয়ার সব রকম প্রস্তুতির পরেও যদি সন্তান না হয় তখন বলা হবে বন্ধ্যত্ব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই এক বছরের সময়সীমা কতটা গ্রহণীয়? এখানে কার বন্ধ্যাত্ত প্রানিধান এ ক্ষেত্রে সেটাই বোঝার বিষয় কারণ সেখানেই লুকিয়ে আছে সমাজে ক্ষমতার সমীকরণ। এই সংজ্ঞার প্রভাবে দেখা যায় ২৪ থেকে ৩৪ সবাই ইনফেরটিলিটির চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। এর পর যে বিষয়টিকে তাঁরা সামনে নিয়ে আসেন সেটি হল, এই অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি-এর ব্যবহারের ফলাফল কী হতে পারে। যেহেতু শরীরের বাইরে এমব্রয় তৈরি করা হয়, তাই শরীরের মধ্যে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে প্রভাবিত করা হতে থাকে। এক কথায়, শরীরের স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে চিকিৎসাশাস্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই নিয়ন্ত্রিত হতে দেওয়ার ফলাফল আবার বহু বিস্তৃত। সন্তান যেমন হতে পারে এই প্রক্রিয়ার ৪০ শতাংশ সাফল্যের হারকে বজায় রেখে বারংবার চেষ্টা করে সন্তান নাও হতে পারে। এই না হওয়ার বিষয়টিকে আবার কিছু ডাক্তারবাবু সহজে ছেড়ে দিতে চান না। তাঁরা তখন বলতে থাকেন, ডোনার ডিম্বাণু বা শুক্রাণু নেওয়ার জন্য। আবার একদল মানুষ যাঁরা দাবি করেন, যে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে নিজের শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে দেবে। তাঁদের কথায়, ওই আইভিএফ-সহ বাকি পদ্ধতিগুলো সঠিক নয়। নিজের ঔরসজাত সন্তান হল আসল সন্তান। ফলে নারীদের উপর আরও একটু চাপ বাড়ল। নারীরা শরীর টাকেই আর বিশ্বাস করে উঠতে পারে না।
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসি: অযোধ্যা— প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১

বদলে গেল টুইটারের লোগো,পাখির জায়গায় এ বার কুকুর! কেন পরিবর্তন, নিজেই জানালেন মাস্ক

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

এমনিতেও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে গেলে দেখা যায় স্ত্রীদের পরীক্ষার পর স্বামীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ নির্দিষ্ট করতে হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এই সব মেয়েদের নেই।

ঘটি বাটি বেচে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব দেখে বিভিন্ন ডাক্তারবাবুদের বিভিন্ন ধরনের আশার বাণী শুনে, সমাজের চাপে নুয়ে পড়া নারীরা যখন এই ব্যয় সাপেক্ষ চিকিৎসার যন্ত্রণা, ভবিষ্যতে ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনাকে ঘাড়ে পেতে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান, সেই সময়ও সমাজ বলতে থাকে, যেন তিনি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।
পরিশেষে বলব সতীদাহ প্রথার পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা এখনও নারীদের বয়ে চলতে হচ্ছে। সেই যন্ত্রণা যা সীতা থেকে শুরু হয়েছে তার থেকে কীভাবে মুক্ত হবে মেয়েরা? না না রকম পন্থার সন্ধানে থাকতে হবে আমাদের।—চলবে

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content