সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

আজকাল একটি প্রশ্ন আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। প্রশ্নটি আর কিছুই নয়, খুব সাধারণ একটি বিষয়। আমাদের সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য কি সত্যি আছে? নাকি আমরা কতিপয় নারী ইচ্ছে করে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য পুরুষদের গোবেচারা মনে করে ছড়ি ঘোরাতে চাইছি। আমরা নাকি মানে নারীরা পুরুষদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে চাইছি। নারীরা চাইছে ঘরে একজন স্বামী থাকলেও বাড়ির বাইরে গিয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করবে। এই রকম নানা ধারণার বর্ণময় বর্ণনা প্রায় দিন শুনতে হচ্ছে। সঙ্গে এও শুনতে হল, সম্প্রতি যে এ ভাবে জঙ্গি আন্দোলনের ঢঙে নারীদের অধিকার চাইতে গিয়ে আসলে আমরা সমাজের ও পরিবারের শান্তি বিঘ্নিত করছি। আসলে নারীরা ‘ইউটপিয়ান’ সমাজ তৈরির কথা ভাবছে। আর এই করতে গিয়ে আসলে পুরো বিষয়টাই গুলিয়ে ফেলছে। মূল বিষয়টা মানে তার দৌড় কতটা হওয়া উচিত বা ক্ষমতা বকলমে সাম্যতা পাওয়ার জন্য কীভাবে এবং কতটা মানে মাত্রা জ্ঞানের সাম্যতা নারীরা বুঝে উঠতে পারছে না!

সম্প্রতি আমি নিজে এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। কোথায় জানেন? একটি রোগনির্ণয়কারী সংস্থায়, স্বয়ং ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে। এ বার একটু খুলে বলি, কেন এই কথা শুনতে হল। কিছু কিছু রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়াতে রোগীর পরিবারের সদস্যের সম্মতি লাগে। এই সম্মতির বিষয়টি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, রোগী নিজে সম্মতি দেবে তার উপর প্রক্রিয়াটি চালানোর জন্য। আর সম্মতির দ্বিতীয় ভাগে আছে রোগনির্ণয়কারী প্রক্রিয়াটি চলাকালীন রোগী অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়ির লোক চিকিৎসার জন্য দায়ী থাকবেন। আমাকে এরকম একটা সম্মতিপত্রে সই করতে যাওয়ার আগে বলা হল, আমার যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আমি যেন প্রশ্ন করে বিষয়টি বুঝে নিয়ে থাকি।

আমি প্রশ্ন করার অনুমতি পেয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। প্রথমেই বললাম, আমি তো চিকিৎসক নই, তাহলে রোগীর কিছু সমস্যা হলে আমি কীভাবে দায়িত্ব নেব? আমাকে বলা হল, তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর, যদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় তখন আপনাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। আমি জানতে চাইলাম, কেন আপনারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেবেন না, যখন ঘটনা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়ার মধ্যেই। ঘটনাটি বাড়িতে বা অন্য কোনও জায়গায় তো ঘটছে না। তখন বলা হল, সে-রকম হলে সঙ্গে দারোয়ানকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, তবে কোনও চিকিৎসক সঙ্গে যেতে পারবেন না। কারণ, তিনি তখন বাকি রোগীদের দেখতে ব্যস্ত থাকবে।
এর পরেই ধেয়ে এল আরও কিছু কথা। যেমন আমি কী করি, কী বিষয় নিয়ে আমার পড়াশুনো করেছি? সঙ্গে চূড়ান্ত বাক্য যে, আমি যে কথাগুলো বলছি, সেগুল বাস্তবসম্মত নয়। আমি যেন ‘ইউটপিয়া’ বইটা পড়ি। রোগ নির্ণয় ব্যবসাতে অনেক মানুষ জড়িত আছেন। তাদের সংসার চলে এই ভাবে। সেখানে আমার অবান্তর কথা সমস্যা বাড়াবে বই কমাবে না। আমি বললাম, আপনি প্রশ্ন করতে বলেছেন, তাই আমি প্রশ্নগুলো করেছি। এর পরের ঘটনা মারাত্মক। ডাক্তারবাবু রেগে গিয়ে বললেন, আপনার উকিলের মতো জেরা করার প্রশ্নে আমি অস্বস্তি বোধ করছি। এই বলেই বললেন, আমি আজকে এই টেস্ট করাতে পারব না। আপনার রোগীর কিছু হলে আপনি এই ভাবেই বিরক্ত করবেন।

আমার তখন মনে হল, প্রশ্নের তাহলে অনেক রকম-ফের হয়। আমার তাহলে কী রকম প্রশ্ন করা উচিত ছিল? একজন মহিলা যিনি রোগীর আত্মীয় তিনি কি ধরনের প্রশ্ন করবেন।খুব সরল না, মানে ওই প্রশ্ন যে রোগীর কী সমস্যা হবে বলে খানিক ঘ্যানঘ্যান করা নাকি প্রশ্নের বদলে এটা বলা আপনি যখন করছেন টেস্ট তখন অন্য কিছু হবে না। নারী আত্মীয় সেখানে প্রতিষ্ঠানের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে কি? প্রতিষ্ঠানের, ডাক্তারের দায়িত্ববোধের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার আমার মানে একজন মহিলা তায় ডাক্তার নই তার আছে কি? এই সব যখন মনে মনে ভাবছি, তখন ডাক্তারবাবু কী ভেবে আবার উঠে দাড়িয়ে বললেন যে, তিনি টেস্টটা করবেন। এখানেই বিষয়টি মিটে গেল না। এর পর টেস্ট চলতে চলতে কথা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন মেয়েরা যে বাসনগুলি ব্যবহার করেন রান্না করতে গিয়ে কী বলে যেন সেগুলোকে। আমার তখন মনে হল, ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের ব্যবহারের বাসন আলাদা হয় নাকি! আমি এতদিন কেন জানতে পারিনি? নাকি ডাক্তারবাবু বলতে চাইছেন যে, ছেলে এবং মেয়েদের কাজ আলাদা হয়?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩৫: ইজ্জত আসলে পিতৃতান্ত্রিক, তাই কি প্রাণঘাতী?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

এই প্রেক্ষাপটে আমার মনে হল, আমরা এখনও পরিষ্কার করে বুঝে উঠতে পারিনি, লিঙ্গ বলতে আমরা কোন ধারণাগুলোকে বুঝব। লিঙ্গের ধারণা স্পষ্ট না হলে কোনও ভাবেই আমরা লিঙ্গ বৈষম্যের ধারণা বুঝে উঠতে পারব না। লিঙ্গ ধারণা যে সমাজের নির্মাণ সেই বিষয়টিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ডাক্তারবাবু যখন ঘরভর্তি লোকের মাঝে বলছেন, মহিলারা যে বাসন দিয়ে রান্না করেন …এখানে একটু থেমে আরও কিছু বিষয় জুড়তে চাই, তা হল ডাক্তারর কথা বলছি ফলাও করে কারণ, তাঁদের সমাজে মনে করা হয় সবচেয়ে শিক্ষিত এবং তাঁরা প্রাণরক্ষা করতে পারেন। তাই তাঁরা ভগবানের সমতুল্য। তিনি মহিলাদের নিয়ে বলা মানেই সমাজ বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে, মহিলাদের ওটাই কাজ। মহিলারাই বাড়ির দায়িত্ব সামাল দেবেন। তিনি ক্লিনিকের নার্সদের আধুনিক প্রজুক্তি নিয়ে শিক্ষিত করবেন। কিন্তু সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেবেন যে, তাদের মূল ভূমিকা নিঃশব্দে সেবা দেওয়ার কাজ করে যাওয়া। পুরুষ সেখানে সিদ্ধান্ত নেবে যেমন তিনি নিচ্ছেন আমাকে নিয়ে, আমার প্রশ্ন কে নিয়ে, রুগীকে আমার প্রশ্নের ভিত্তিতে টেস্ট করবেন কি করবেন না।

সমাজের যাঁরা অন্য কাজ করে থাকেন, তাঁদের দায়িত্ব কম কিছু নয়। কিন্তু বর্তমান সমাজ কাঠামোর প্রেক্ষাপটে দায়িত্বের একটি অনুক্রম বা ছোট থেকে বড় বা পিরামিডের মতো কাঠাম থাকে। এই কাঠামোর উপরের দিকে যাঁরা আছেন যেমন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, শিক্ষক এদের সকলের সমান দায়িত্ব আছে লিঙ্গ বিষয়টি নিয়ে সমাজে আলোচনা করা এবং এই বিষয়য়ের মধ্যে কোথাও বৈষম্য আছে কিনা সেই বিষয়টি পরিষ্কার করার।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৪: হাজরা মোড়ে নাম না জানা কচুরিখানা

এই কথার পিঠেই যে কথাটা আসবে সেটা হল, হাজার হাজার বছরের তৈরি করা সামাজিক ব্যবস্থা কি এত সহজেই নির্মূল করা যায়? যায় না যে তাই বা আমরা ধরে নিলাম কীভাবে? সতীদাহ প্রথা নিবারণ করতে পারলাম, বিধবা বিবাহ চালু করতে পারলাম। আর একটু এগিয়ে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে পারব না। সমাজে কোনও ব্যবস্থা প্রশ্নাতীত নয়। সব কিছুকেই প্রশ্ন করতে শিখতে হবে। প্রশ্ন করলেই যদি বলি আমি অস্বস্তিবোধ করছি, তাহলে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা কঠিন হবে। ক্রমেই সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য বেড়ে যাবে। বৈষম্যের তারতম্যের ফাঁক দিয়ে তখন প্রবেশ করবে সেই সব ভাবনা, যেখানে সমতা আদায়ের আন্দলনের ভাষা থেকে শুরু করে তার পদ্ধতি নিয়ে একদল মানুষ আক্রমণ করতে শুরু করবে। কারণ, সমাজে সবাই ভাবতে চাইছে না যে, নারীদের বা প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের উপর বৈষম্য হচ্ছে মনে হলে কোনও না কোনও ভাবে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। এই নিয়ে কথা বলতে হবে।

এ কথা বলার অন্যতম কারণ হল, মানুষ নিজেদের মধ্যে বিষয়গুলি আদানপ্রদান করে নিচ্ছে। সংবাদ আদানপ্রদান মানুষকে বিষয়গুলি সম্পর্কে অবগত করায়। অবগত হলে সচেতনতা বাড়ে। সচেতন হলে তার মধ্যে এক নীতি-নৈতিকতার ধারণা গড়ে ওঠে। সেই ধারণার উপর ভর করে মানুষ নিজের অবস্থান, পরিচিতি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং গড়ে তোলে। কিন্তু আমাকে কি শুনতে হল সমাজের সবচেয়ে গন্যমান্য ব্যক্তির কাছে যে, আমরা মেয়েরা প্রশ্ন করলে পারিবারিক শান্তি বিঘ্ন হবে। সারাদিন যদি আমি প্রশ্ন করতে থাকি আর মানিয়ে না নিই, তাহলে সুখী জীবন হবে না।

আবারও আমার মনে হল, আমাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলা যাবে না। আমাদের দেশের প্রয়োজনে, দশের প্রয়োজনে কথা বলা নিষেধ। কারণ আমাদের কথা বলার মধ্যেই অশান্তির বীজ লুকিয়ে আছে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৩: মালিকা পরিলে গলে/ প্রতি ফুলে কে-বা মনে রাখে?…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

এ বারে আসি আর একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে। মেয়েদের যদি শারীরিক কারণে বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়, বা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কোনো সমস্যা হয় ,তাহলে তাদের চিকিৎসা খরচ কোনও বিমা সংস্থা দেবে না। কারণ, যদি জানতে চান প্রথমে আপনাকে অবজ্ঞা করা হবে। তারপর বিমা নিয়ন্ত্রক দফতরের নির্দেশিকা ধরিয়ে দেওয়া হবে। সেই নির্দেশিকা আসলে আপনি ঠিক কোন কোন অসুখের কারণে টাকা পাবেন না, আর কোন ক্ষেত্রে পাবেন তার একটি তালিকা। তালিকা তৈরির কারণ কোথাও বলা নেই।সেই তালিকা বলেছে, বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার জন্য টাকা দেওয়া হবে না। এ বারে এই নিয়ে ক্রেতাসুরক্ষা আদালতে গেলে দেখা গেল, এই নিয়ে আজ অবধি কোন মামলাই হয়নি। অর্থাৎ এই নিয়ে কেউ প্রশ্নই তোলেননি।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে কেন? উত্তরের দিশা পাওয়া সহজ। আমাদের দেশে এখনও বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা বা প্রশ্ন করার অধিকার একমাত্র শ্বশুরবাড়ির আছে। কারণ অপছন্দের বউমাকে টাইট দেওয়ার মোক্ষম বিষয় এটি। আবার নারীর বন্ধ্যাত্বের সঙ্গে পুরুষের বন্ধ্যাত্বের বিষয়টি যদি সামনে চলে আসে তাহলে আগ্রাসী পৌরুষ আর আগ্রাসী থাকতে পারবে না। তাই সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এ দিকে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার ক্লিনিকে ভিড় বেড়েই চলেছে। ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে খুব বেশি উত্তর আমি খুঁজে বের করতে পারিনি। তবে একটা বিষয় ভীষণ রকম ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই চেপে যাওয়ার রাজনীতিতে। বিষয়টি মানব অস্তিত্ব, এবং এটি নারীদের সন্তান উৎপাদন করার ক্ষমতার উপর অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন এবং নারীদের নিজেদের শরীরের কথা আরও বলতে দেওয়া উচিত।

শান্তি, সবার ভালো হওয়া, খুশি হওয়া এই বিষয়গুলি ভীষণ রকম ভাবেই সামাজ কেন্দ্রিক। আমাদের শরীর, মন, সত্ত্বা তৈরি হয় সমাজের লিঙ্গ ভাবনার আদর্শের মধ্যে দিয়ে। ক্রমেই সেই লিঙ্গ আদর্শ আমাদের আইনের সংজ্ঞার মধ্যে, চিকিৎসা-রাজনৈতিক-শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কাণ্ডারি হয়ে ওঠে। তাই বৈষম্যকে মনে হয় স্বাভাবিক, আর আমাদের কান্না, প্রতিবাদ হয়ে ওঠে বিভাজনকারীদের ষড়যন্ত্র!
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content