শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

দাম্পত্য কলহের একটি চেনা বিষয়, পরস্পরকে না পোষালে যেন আইনি বিচ্ছেদ নিয়ে নিতে পারে। তারপর না না কিছু চলতে থাকে। যেমন কিছুদিন কথা বন্ধ কিংবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও থাকা প্রভৃতি চলতে চলতে আবার কথা বলা শুরু করা। বিবাহ এমন একটি বন্ধন যেখানে মানুষ ইচ্ছে প্রকাশ করে কখনও একসঙ্গে থাকতে, আবার কখনও একসঙ্গে থাকা থেকে বেরিয়ে আসা। বিবাহের মধ্যে একসঙ্গে থাকা বা না থাকা, তাই অনেক কিছু প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির ইচ্ছে অনিচ্ছার উপর দাঁড়িয়ে থাকে।

এই প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির ইচ্ছে অনিচ্ছার বিষয় যতই আমাদের মধ্যে দার্শনিক মার্কা নেতিবাচক ধারনার জন্ম দিক না কেন, কারণ আমরা ধরে নেই প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি অনেকটাই আমাদের আশক্তি কিংবা প্রত্যাশার আকাঙ্খার কথা বলে।
তাই বলতে পারি, বিষয় অনেক জটিল এবং সেখানে হিংসার উপস্থিতি অনেক বেশি। অনেক সময় এই হিংসাকে জয়ী হতে দেখা যায়, আবার কখনও নিজেদের ভুলগুল এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে নতুন করে শুরুর চেষ্টা হয়।

কিন্তু যেখানে এই শুরু আর হয় না? সেক্ষেত্রে সম্পর্কের আইনি বিচ্ছেদ যখন চেয়ে নিয়ে থাকি তখন আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয় আলোচনা, পর্যালোচনা আর সমাজের নিদান। এই নিদান ধেয়ে আসে নারীর দিকে সবার আগে আর চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ ,হতে থাকে বারং বার ব্যবচ্ছেদ এই বিচ্ছেদের কারণ নিয়ে।
বিবাহবিচ্ছেদকে আমাদের সমাজে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। আসলে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে সমাজে টিকিয়ে রাখতে গেলে এই আইনি বিচ্ছেদকে খুব সহজলভ্য করলে চলবে না। এই বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক দর্শন বজায় থাকে সমাজে। আমার মনে পড়ল, একবার পরীক্ষার খাতা দেখছি, দেখলাম পঁচাত্তরটি খাতার প্রত্যক পরিক্ষার্থী দুটি প্রশ্নের উত্তর খুব মন দিয়ে লিখেছে।

একটি প্রশ্ন হল বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব পরিবার কাঠামোর উপর এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন হল পরিবারের কাজ কী? পাতার পর পাতা পরিক্ষার্থী লিখে গিয়েছে যে, বনিবনা হয় না বলে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং এই বিচ্ছেদের জন্য বেশির ভাগ লিখেছে মেয়েদের মানিয়ে নিতে না পারাটাকেই দায়ী করেছে। কিন্তু এর পরের ধাপে যা লিখেছে সেই বক্ত্যব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

পরিক্ষার্থীরা লিখেছে যে, এই বিচ্ছেদের ফলে বৃদ্ধ বাবা-মা এবং ছোট শিশুদের খুব কষ্ট হয়। আমার মনে হয়েছে, এই কষ্টের অনুভুতির মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ যেমন হয়েছে, তেমনই উল্টোটাও সত্যি যে যেখানে বিচ্ছেদের বড় কারণ গার্হস্থ্য হিংসা সেখানে সব পক্ষ কি পারত না এই হিংসাকে দূরে সরিয়ে রাখতে? পরিক্ষার্থীদের কথা বলার কারণ এরা সমাজের সব স্তর থেকে আসে এবং ভাবনার বহিঃপ্রকাশ এদের উত্তরের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে। পাঠ্যবইয়ের উত্তরের সঙ্গে নিজেদের মনের কথাও কিছুটা এরা বলে ফেলে, বিষয় সেই বলে ফেলাকে অনুমতি দেয় বলে।

পরিক্ষার্থীরা বিবাহকে নিয়েও খুবই সুন্দর করে ব্যাখ্যা করেছে। কেউ বলেনি বিবাহ প্রতিষ্ঠানটিকে তুলে দেওয়া হোক। তাদের মনে হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটি খুব প্রয়োজনীয়। এই ভাবনার কারণ খুঁজে দেখার আগে আমরা একঝলক দেখে নিতে পারি সমাজ থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞান, বিবাহকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২২: সামাজিক প্রতিবন্ধকতার দ্বিচারিতা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

বিবাহকে সমাজ একটি আইনি ও ধর্মীয় বন্ধন একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে দেখেছে। সঙ্গে এই বন্ধনের সঙ্গে উভয়ের জন্য কিছু দায়িত্ব, সমাজে তাদের ভূমিকা কী হবে সেই সব বিষয় যোগ করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে এই দায়িত্ব আলাদা আলাদা হয়। তবে এই দায়িত্বের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হল, পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দেওয়া। পরিবার গঠন করা এবং মানব সমাজকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখা।

বিয়ে শুধু একজন নারী বা পুরুষের মধ্যে হচ্ছে সেটা নয়। নির্বাচিত নারীর সঙ্গে নির্বাচিত পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া ‘অ্যারেঞ্জ’ বা ‘লাভ ম্যারেজ’ যে ভাবেই হোক না কেন —উভয় পক্ষকে উভয় পক্ষ নির্বাচন করে থাকে। ঐতিহ্যগত ভাবে এই নির্বাচনের পিছনে জ্যোতিষ কুন্ডলী বিচারের থেকেও সামাজিক এবং রাজনৈতিক বা ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে, কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

ভালোবাসার টানে বিয়ে করার মধ্যেও এই ক্ষমতা, অর্থনীতির ভূমিকা কম না। অসুস্থ বা বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষকে বিয়ে করার পিছনেও এরকম অর্থনৈতিক, যেমন কোনও ভালো চাকরি করা, মাথার উপরে ছাদ আছে মানে বাড়ি আছে বা ক্ষমতার বিষয় যেমন উচ্চ জাতের ছেলে কিংবা মেয়ে, এই সব বিষয় বিয়ে করতে চলা ছেলে এবং মেয়ে আর তাদের পরিবারের মধ্যে সমাজে আলাদা সম্মানের জায়গা তৈরি করে দেয়।

কারণ বিবাহ নির্দেশ করে দীর্ঘ মেয়াদি সম্পর্ক। দীর্ঘ সম্পর্ক না থাকলে সন্তানদের মানুষ করা যায় না। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের সন্তানকে বড় করে সমাজের উপযুক্ত করতে কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর লেগে যেতে পারে। এই দীর্ঘকালীন সময়ের মধ্যে বিয়ে বিষয়টি তাই কোনও সমাজেই খুব সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখা হয় না। পরীক্ষার খাতায় তাই আঠেরো থেকে কুড়ি বছরের পরীক্ষার্থীরা যারা এখনও অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হয়ে ওঠেনি তারা বিবাহবিচ্ছেদকে মেনে নিতে পারেনি। সেই কারণে পরিবারের ভূমিকা কি এই প্রশ্নের উত্তরে আবার এই পঁচাত্তর জন লিখেছে সন্তানদের বড় করা, অর্থনৈতিক ভাবে যারা দুর্বল তাদের সাহায্য করা। আবারও এই উত্তরগুলো থেকে বুঝলাম, *বিবাহের মানে যেমন আলাদা এক একটি বয়েসে তেমনি পিতৃতান্ত্রিক দর্শন খুব অল্প বয়স থেকেই আমাদের সমাজে শিশুদের মনে গেঁথে যেতে থাকে। আর তার ফলাফল?
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

সমাজমাধ্যমের পাতায় কেউ পোস্ট করেন, মা-বাবার মেয়েদের প্রতি আবেদন যে, তারা বেঁচে থাকতে কিছুই হবে না। তারা যেন বিয়ের আইনি বিচ্ছেদ নিয়ে তাঁদের কাছে ফিরে আসতে পারে। এই সব কথা নাকি বিবাহ বিচ্ছেদের মূল কারণ। এবার আসি বিবাহ পরবর্তী সময়ে নারীদের কোন কোন বিষয়গুলি বাধ্য করে আইনি বিচ্ছেদ নেওয়ার জন্য।

নির্বাচত নারী এবং পুরুষ বিয়ের আগে থেকে ভেবে নিতে থাকে তাদের কাছে বৈবাহিক জীবন কেমন হতে পারে। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন রাখে তাদের আগামী দিনের যৌন জীবন। যে বিষয়গুলো পিছনের সারিতে থাকে সেগুলো হল কাকে কী দায়িত্ব নিতে হবে। যেহেতু বিয়ের পুরো ধর্মীয় প্রক্রিয়া পুরোহিতের হাত ধরে হতে থেকে, যার ভাষা সংস্কৃত তাই কেউ আর সেদিকে মন দেয় না। ভাষা না জানার জন্য।

অন্য দিকে, যে সব আচার করা হয় যেমন গায় হলুদ থেকে শুরু করে ভাত-কাপরের দায়িত্ব, খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে সবটাই নির্বাচিত পাত্র আর পাত্রীকে তৈরি করা হচ্ছে পরবর্তি জীবনের জন্য। সেই সঙ্গে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হল, পুরো আচার অনুষ্ঠানটি পিতৃতান্ত্রিক দর্শনকে অনুসরণ করে। ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব হল সেই অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেওয়া, যা পরীক্ষার্থীর লেখাতেও স্পষ্ট।

অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন না থাকা থেকেই শুরু হয় বৈবাহিক জীবনের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার খেলা। সেই খেলাতে পড়ে নারীর কাছে প্রতিটি অনুশাসন মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থেকে না। আমাদের সমাজে প্রতিটি পরিবারে মানুষের বেড়ে ওঠার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকে। কিন্তু বিয়ের পর নারীকে বলা হবে, নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে। ডাক্তারি পরিভাষায় বেড়াতে গেলেও যেখানে ‘স্ট্রেস’ হয়, সেখানে এই ভাবে স্থান পরিবর্তন করে নতুন আদবকায়দা রপ্ত করতে কতটা ‘স্ট্রেস’ হতে পারে।

একটু অনুভব করার চেষ্টা করুন। সবার পারাটা সমান গতিতে হয় না। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে সময় দিতে চায় না। সেখানে সবাই অঙ্কে একশো পায় কিনা, তাই বলা হয় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ রপ্ত করে নিতে হবে। যে নারী আমি সব পারি বলবে, সে প্রকৃত নারীর পুরস্কার পাবে। আর যিনি পারবেন না তিনি গঞ্জনা শুনে যাবেন। ভালো বৌমার পুরস্কার কোনওদিনই পাবেন না। এই আমি সব পারি করতে গিয়ে কত নারী শেষ হয়ে গিয়েছেন তার হিসেব নেই। তাদের সতী তকমা দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

এর পর আসে পুরুষের নেশা করা। পারলে স্ত্রীয়ের টাকা নিয়ে নেশা করে। বউ প্রতিবাদ করলে খারাপ আর পুরুষের মা-বাবা চুপ। কারণ, তাদের খাওয়াবে ছেলে। আর বৌমার পয়সাতে খেতে হলেও ছেলেকে দিয়ে চাপ দিতে হবে। তাই ছেলের সব দোষ খণ্ডন এক কথায় পুরুষ মানুষ নেশা না করলে চলে। তাই তারা বৌমাকে বলে, অন্য মেয়ে মানুষের সঙ্গে একটু সম্পর্ক না থাকলে হয়। তুমি তো সারাদিন খোঁটা দাও, চেহারা এই, ছেলে তো অন্য দিকে তাকাবেই। এর প্রদিবাদে হয় মার জোট, নয়তো অমানুষিক মানসিক অশান্তি।

প্রভাব এমন হয় যে অনেকেই রান্নায় ভুল করে অথবা বাচ্চাকে ভুল করে শপিং মলে ফেলে চলে আসে।অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুমতি নেই। অন্য দিকে, নিজের বাড়িতে বলে চলা হয় এত খরচ করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে তারপরও সারাজীবন দেখে যেতে হবে। তাই বাণী আসে ধৈর্য ধর ঠিক হয়ে যাবে। এই ধৈর্য ধরা কোনওদিন শেষ হয় না। কারণ যারা অত্যাচারকে ধর্ম মনে করে তারা কোনও দিন শুধরাবে না।

বিবাহ প্রতিষ্ঠান যদি রাষ্ট্রের কাছে সামাজিক সুরক্ষার মূল স্তম্ভ হয়, তাহলে নারীদের বিচ্ছেদ দেওয়া বা না দেওয়ার দোলাচলে কাটিয়ে দিতে হবে সারা জীবন। রাষ্ট্র নারীর প্রতি হওয়া অত্যাচার গুলি কে সরলীকরণ করে দেয়। শারীরিক সমস্যার কারণে বারংবার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে। স্বামী ডাক্তারের কথা শুনবে না।

কারণ তাঁর মান থাকছে না সমাজে। ফলে বার বার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নারী কে গর্ভ ধারণ করতে হবে। কেউ কিছু বললে বলবে স্বামী বউ গেলে বউ পাওয়া যাবে। নারী বিচ্ছেদ নিলেও দোষের ভাগী হতে হবে। আর উকিলবাবুদের কারসাজিতে আরও বেশি অর্থনৈতিক দুর্ভোগে পড়তে হবে। তারা বিয়ের সময়ে দেওয়া যৌতুক ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে আরও আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দিতে পারে। পুরুষরা এই পরিস্থিতে পড়ে তখনই, যখন তিনি বা তার পরিবার ক্ষমতাশালী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন। আসল দোষ-গুণের বিচার করে বিচ্ছেদ খুব কম ক্ষেত্রে হয়।

যতদিন আমরা হার-জিতের নিরীখে সম্পর্ক এবং ভাবনা চিন্তাকে দেখবো, ততদিন তিক্ততা রয়ে যাবে। আর সাম্যের ধারণা থেকে যাবে আইন আদালতে আর পাঠ্যবইতে।

* প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content