শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

খবরের কাগজে কিংবা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের পরিসরে একটু উঁকি দিলে কিছু কিছু বিষয়, কথা বারে বারে উঠে আসে। এই বিষয়গুলির সিংহ ভাগ থাকে সমাজে মেয়েদের কী ভাবে থাকতে হবে এবং কীভাবে তারা পরিমিত খরচে সংসার চালাবেন। স্বামীকে এবং স্বামীর পরিবারের খেয়াল রাখবে নিঃস্বার্থ ভাবে। বলা হতে থাকবে নারীদের যে তাদের ভাত কাপড়ের জোগান যখন স্বামীর হাত থেকেই আসবে তাহলে সেখানে নারী কোনও প্রশ্ন না করে নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে মৃত্যুর আগের দিন অবধি পরিষেবা দিয়ে যেতে হবে। মেয়েদের জীবনের অভীপ্সা বা লক্ষ্য থাকবে কীভাবে পরিষেবা দিয়ে যেতে হবে সারাজীবন সঙ্গে থাকবে সঙ্গী হয়ে পরিবারের পছন্দের বউ, বউমা বা মা হতে না পারা।

তারপরেই নারীদের অভীপ্সা থাকে বা রাখতে বলা হয় কীভাবে এই সব নারীরা সন্তান মানুষ করবেন যাতে তাদের সন্তানরা বা মূলত পুত্র সন্তানরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কিছু নির্দিষ্ট পেশা গ্রহণ করে। আর নিজের মেয়েদের এবং সমাজের বাকি মেয়েদের মানুষ করার সময় আমরা বলব সেই মেয়েরা যদি গৃহিণী হতে চায়, তারা হতেই পারে। কারও ব্যাক্তিগত ইচ্ছে হতেই পারে গৃহিণী হওয়া। তারপর বলব, দেখ এমন কিছু চাকরি জোটাতে পার কিনা, যেটা করলে সংসার টিকে থাকে। তারপরেও বলে জেতে থাকব যে সন্তানকে মানুষ করা বেশি জরুরি চাকরি করে পদন্নতি পাওয়ার থেকে।

এরপর আমরা দেখতে থাকব কিছু মেয়েরা যারা গ্রামে থাকেন তারা গৃহপালিত প্রাণীদের দেখভাল করে কিছু উপার্জন করছেন কিন্তু সেখানেও দেখব সেই ছোট পরিসরের চেষ্টা কে বড় করার উৎসাহ নেই। স্কুল ছুট হয়ে কিংবা কলেজের পড়া শেষ করেই বিয়ে করে নেওয়া মেয়েদের নিন্দা করব কিন্তু মূল কারণ নির্ণয় করে সমাধানের উপায় খুঁজতে চাইব না। উলটে বলব অভীপ্সার বড় অভাব। এরা দেখে শেখে না। কেন দেখে শিখতে পারছে না?
কেন আমরা সমাজে নারীদের ছোট চেষ্টাকে বড় করার উৎসাহ দিতে পারছি না? তাহলে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কী একটি ছোট পরিসরে আটকে রাখার বিষয়? নারীর আকাঙ্ক্ষা, আমি মনে করি এই আকাঙ্ক্ষা সমাজ নির্মিত এবং এই আকাঙ্ক্ষা বা অভীপ্সাকে খুব সীমিত গণ্ডির মধ্যে রাখার মধ্যে সমাজের কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। আমরা কোন ভাবেই এই অভীপ্সার গণ্ডিকে বড় করতে পারছি না। তাহলে কি নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সোনার পাথর বাটি হয়ে থেকে যাবে?

আমরা ছোট করে দেখাতে থাকি জীবনে প্রতিষ্ঠিত নারীদের বলেই নারী সামনে এগোনোর রাস্তায় সুড়ঙ্গ পথ, কঠিন, পিচ্ছিল পথ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে দেশের দশের, সাহিত্য কিংবা বিজ্ঞানের না না ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নারীদের সংগ্রামের কথা বা ছবি খুব বেশি জনসমক্ষে আনি না বা প্রচার করতে চাই না। আমরা তাঁদের পোশাক নিয়ে কথা বলি বেশি। তাদের পরিবার এবং কাজের জগতের মধ্যে রাখা সাম্যতার প্রয়াস অনেক বেশি শোনার কান পায় কিন্তু তাদের যৌন হেনস্থা মোকাবিলার গল্প এমন ভাবে প্রচার করা হয় মনে হয় সেই নারীরা হয় নিজেরা হেনস্থা হতে আগ্রহী ছিলেন নয়তো তাদের নিজেদের ভুলেই হেনস্থা হতে হয়েছে।

আসলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মুল বক্তব্য থাকে বাড়ির বাইরে বেরলে এবং পুরুষের সাহায্য ছাড়া চলতে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। নারীর অভীপ্সা কোনও ভাবেই ডানা মিলতে চাইবে না এই দুর্যোগের ভোগান্তির ভয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা বাড়তে দেখেছি। ১৯৯০ সালের বানতলা ধর্ষণ কাণ্ড যেখানে তিন জন মহিলা স্বাস্থ্য কর্মীকে যারা অফিসার র‍্যাঙ্ক কর্মী ছিলেন তাদের প্রকাশ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় কারন তারা শিশুদের পোলিও খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়েছিলেন।
১৯৯০ সালে ভানওয়ারি দেবীকে ধর্ষণ করা হয় কারণ তিনি নিচু জাতের নারী হয়ে গুজ্জর জাতের মহিলাদের মধ্যে বাল্য বিবাহ রুখতে গেছিলেন। এই দুই ঘটনার প্রেক্ষিতে দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার। নারীদের শারীরিক এবং অবশ্যই যৌন শারিরিক অত্যাচার সেই সঙ্গে মানসিক ভাবে অত্যাচার (যা তাকে বলবে সে সমাজের কাছে আর গ্রহণীয় নয়) করে বুঝিয়ে দিতে হবে তার সমাজের হয়ে কাজ করার এক্তিয়ার নেই। বরং তার একটাই পরিচয় সে যৌন আনন্দ দিয়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে যাবে যতদিন না তাকে সমাজ থামতে বলছে। আর আমাদের দেশে এখনও জাত পাতের নিরিখে ধরা হবে নারীর কাজ কি হবে। ভারতীয় পরিবারের স্বাস্থ্য সমীক্ষা৫ (২০১৯-২০২১) এর রিপোর্ট বলছে ৬১ শতাংশ মহিলা আমাদের দেশে ২১ বছর বয়েসে বিয়ে করেন। তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের মধ্যে ১৮ বছরের বিয়ে করার প্রবনতা বেশি এবং শতাংশের হিসেবে তা ২৬ শতাংশ।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪১: রিল জীবিকা বনাম জীবিকার বাজারে মেয়েরা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

আর একটি বিষয় জড়িত এখানে সেটা হল অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল পরিবারের মেয়েদের মধ্যে ১৮ বছরের নীচে বিয়ে করে নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কী বুঝলেন? যত দুর্বল তত এগিয়ে যাওয়ার জেদ তৈরি হচ্ছে না কেন? পারিবারিক চাপ এত বেশি যেখানে বাড়ির ছেলেদের লেখা পড়া করানো যাচ্ছে না। এখানে দুটি বিষয় আসছে যাদের এক সময় আর্থিক সচ্ছলতা ছিল কিন্তু চাকরি চলে যাওয়া বা কোন দুর্যোগের কারনে আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে উচ্চ অবস্থান আছে যা জন্মসুত্রে পাওয়া গিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়ার প্রবনতা বেশি।

ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু তার প্রভাব অন্যভাবে দেখা যায়। কিন্তু যাদের বংশ পরম্পরায় দেখছে অভাব অনটনের জীবন সেখানে মেয়েদের অনেক ছোট বয়েসেই পরিপক্ক হয়ে যেতে হয়। ছোট ভাই বোনদের মানুষ করতে হয়। বাড়ির সংসারের কাজ করে যেতে হয়। সেই সব মেয়েদের কাছে বাড়ি হয়ে ওঠে শোষণের কল। মেয়েরা এই কলের সাঁড়াশি থেকে মুক্তি পেতে চায়। মুক্তির উপায় হয়ে ওঠে পালিয়ে বিয়ে করা বা বাবা মায়ের দেখে দেওয়া বয়েসে বড় বা দোজবরকে বিয়ে করে নেওয়া। তার কাছে স্কলারশিপের টাকা মানেই বিয়ের খরচ কিছুটা জোগাড় করতে পারা বা ভাই বা দাদা বা বাবা মায়ের মাথার ছাদটা পাকা করে দেওয়ার বিনিময়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বেড়াতে এলে কিছু আদর আপ্যায়ন পাওয়ার সংস্থান করা।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৪: মাটি তোদের ডাক দিয়েছে…

চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-৩: অবশেষে অভাবনীয় প্রাপ্তি ও স্বপ্নপূরণ

মেয়েদের সব সময় দিয়ে যেতে হবে, এই সব পাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে আর যাই হোক চাকরি পরিক্ষার জন্য বা নিজের পড়ার জন্য বই কেনা হয়ে ওঠে না। আমরা যারা বাবা বা মায়ের হুমকি, ‘না পড়লে বাসন মাজতে হবে’ শুনে চাকরি করছি তারা যখন অভীপ্সা কেন হচ্ছে না বলে লাফালাফি করি তখন এই মেঠো ঘরের মেয়েদের ঘরের অবস্থান টা বুঝে উঠতে পারছি না।

এই পিচ্ছিল পথকেই বলা হয় কাঠামো গত বাধা। কালকেই লঞ্চে করে গঙ্গা পার হওয়ার সময় দেখলাম একজন মেয়ে নতুন স্কুটি চালানো শিখেছে এবং সে সেই স্কুটিকে লঞ্চে করে পার করতে চাইছে। প্রথমবার লঞ্চে তুলতে গিয়ে বাধার সম্মুখিন হয়েছেন। লঞ্চে উপস্থিত বাকি মহিলাদের আমি কোনও মন্ত্যব্য করতে শুনিনি কিন্তু উপস্থিত পুরুষদের নানা রকম কটূক্তি যার মধ্যে অন্যতম ‘স্কুটি নাড়াতে পারে না আবার চালাছে!” করতে শুনলাম। তার মধ্যেই একজন পুরুষকে দেখলাম কোনও কিছু না বলে মেয়েটিকে স্কুটি তুলতে সাহায্য করলেন। এই একটি ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ বিষয় বলে অনেকের মনে হতে পারে কিন্তু আদপে তা নয় একদম। কেন একথা বলছি?

আমাদের পৃথিবীর বহু অর্থনীতিবিদ তদের গবেষণা র মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন মহিলাদের কাছে যত বেশি প্রযুক্তি এসে পৌঁছবে ততই তাদের মধ্যে আখাঙ্খা জন্মাবে নিজে এবং পরিবারের সন্তানদের নিয়ে এগিয়ে যেতে। এই পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সহজাত এবং প্রযুক্তি সেই সহজাত বিষয়কে একটু পরিশীলিত করবে। কিন্তু ক্ষমতায়ন বা নারীর নিজের কিছু বলার বা করার অধিকার না থাকলে এই গতি বা প্রযুক্তি খানিকটা ফ্রি লাঞ্চ বা দয়ার দান হয়ে থেকে যাবে। দয়ার দান নিয়ে মেয়েরা সন্তুষ্ট হয়ে যাচ্ছে কারণ কাজের জায়গার হয়রানিও বাড়ছে। লড়াই ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। তাহলে উপায়?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

ভালো রাস্তা সবসময় দরকার হয় অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য। আসলে গতিময়তা মানব জীবন এবং সমাজকে বদলে দিয়েছে। সেই গতির রেশ কি মহিলাদের মধ্যে প্রভাব ফেলবে বা ফেলছে? কিংবা তাদের মধ্যে অভীপ্সার পরিসরকে বাড়িয়ে দেবে বা দিচ্ছে কি? কিছুটা জায়গা তৈরি হচ্ছে মেয়েদের মধ্যে সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। মোবাইল ফোন কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাত পাতের বিভাজন নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা যেমন বাড়াতে হবে তেমনই মধ্যে জীবন শৈলী, এক কামরার ঘরের মধ্যে গরীব মানুষ থাকবে, এই সব ভাবনা প্রসূত প্রকল্প গুলিও একটু বদলাতে হবে।

মেয়ে কিংবা ছেলে সন্তান যখন একটি ঘরের মধ্যেই বাবা মার যৌন জীবনের দর্শক হয়ে থাকতে বাধ্য হয় তখন তাদেরও মানসিক সমস্যা হয়। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সহজ মুক্তি বিয়ে করে নেওয়ার মধ্যেই থাকে কারন আমাদের দেশে সন্তানের পাগলামি সারানোর ওষুধ বলে যখন বিয়ে দিয়ে দেওয়ার নিদান দেওয়া হয় সেখানে এই সব অসহায় মেয়েদের কাছে আর কি উপায় থাকবে।

আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন এক দিদি। তার মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ সে একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধু পাতিয়ে ছিল। আইনি বয়েস হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেই শুনে যদি সরকারি হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাই সেই দিদি বিয়ের পরে পরেই শাঁখা পলা খুলে নিয়ে নিয়েছিলেন। এদের কাছে বিয়ের চিহ্ন লোকান দরকারি, সরকারি হোমে নিয়ে চলে যাওয়ার বদলে।

এদের কাছে বউ হাত পেতে টাকা চাইবে অনেক দরকারি বিষয় কিন্তু বউ নিজে টাকা রোজগার করুক সেটা ক্ষতিকারক বিষয়। সরকারি প্রকল্পের জন্য যে সমস্ত মহিলা টাকা পাচ্ছেন আর যাঁরা পাচ্ছেন না তাদের মধ্যে একটি বিভাজন রেখা টানা হচ্ছে। বিভাজনের একদিকে ভালো মেয়ে আর একদিকে গরিব এবং খারাপ মেয়ে। এ বার আমাদের কী করতে হবে?
* বৈষম্যের বিরোধ-জবানি (Gender Discourse): নিবেদিতা বায়েন (Nibedita Bayen), অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, পি আর ঠাকুর গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content