এ বছর আমাদের রাজ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে মাছ চাষের মরশুম শুরু হতে চলেছে। আর সপ্তাহ দু’ য়েকের মধ্যে আমাদের এখানে মাছ চাষের ক্রিয়া-কলাপ শুরু হয়। পয়লা ফাল্গুন বা ১৪ ফেব্রুয়ারি এবছর এটা সরস্বতী পুজোর দিনে শুরু হচ্ছে। আর চলবে আশ্বিনের শেষ অবধি। এখনও আমাদের রাজ্যে প্রান্তিক মাছ চাষির সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এবং মাছ উৎপাদনের খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছচাষের বা বলা ভালো পোনা জাতীয় মাছচাষের ক্ষেত্রে বেশ অসুবিধের মধ্যে চলতে হচ্ছে আমাদের এইসব চাষিদের। এর একটা কারণ, মাছ চাষের সিংহভাগ খরচ হয় তার খাবার কিনতে। চাষের মোট খরচের ৬০ শতাংশ চলে যায় মাছের খাবার কিনতে।
এক্ষেত্রে যাদের লগ্নি করবার সমর্থ্য নেই বা স্বল্প খরচে যিনি বা যাঁরা চাইবেন মাছ চাষ করতে অথবা যারা জৈব চাষের কথাও চিন্তা করবেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে মূলত আজকের এই লেখাটি। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই বলব, মাছ চাষ শুরু করবার পরিকল্পনার জন্য যেহেতু এখনও দিন পনেরো সময় আছে, তাই স্বল্প পরিসরে তথাকথিত চাষিদের কল্পতরু অ্যাজোলা যা একটি জলজ শ্যাওলার মতো দেখতে ভাসমান ফার্ণ-এর চাষ শুরু করবার এখনই আদর্শ সময়। এর অত্যন্ত সুবিধাজনক দিক হল, এই ভাসমান ফার্ণ-এর বাড়বৃদ্ধির হার খুব ভালো। অঙ্গজ জনন দ্বারা এর বৃদ্ধি হয়। অ্যাজোলা স্বাভাবিক অবস্থায় তিনদিনের মধ্যেই নিজের পরিমাণকে দ্বিগুণ করতে সক্ষম। প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রতি বর্গ মিটারে দেড় কেজি অ্যাজোলা পাওয়া যায়। এটি খুবই পুষ্টি সমৃদ্ধ। এর মধ্যে ২০ শতাংশেরও বেশি প্রোটিন আছে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৯০: মৎস্যজীবীদের সুরক্ষার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল
এ রকম একটি জলজ উদ্ভিদ চাষ করে নিতে পারলে মাছ চাষের অনেক সুবিধা হয়। শুধু সকাল বিকেল রোদ্দুর পায় এমন একটি জায়গা চাষের জন্যে বেছে নিতে হবে। এর চাষ একেবারে দেশীয় পদ্ধতিতে করা যেতে পারে। অ্যাজোলার সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপভাবে অ্যাজোলার মতোই অপুষ্পক শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ কণা হল স্পিরুলিনা। কিঞ্চিত নোনা ও ক্ষারযুক্ত জলে যেখানে পিএইচ ৮ থেকে ৯ এর মধ্যে থাকে, এরকম জায়গায় স্পিরুলিনার বাড়বৃদ্ধি খুব ভালো হয়।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!
দুটি প্রজাতি আছে। আর্থস্পিরা প্ল্যাটেনসিস ও আর্থস্পিরা ম্যাক্সিমা। প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে এতে প্রায় ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি। পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। একদম প্রাকৃতিক উপায়ে, স্বল্প জায়গায় ও স্বল্প পুঁজি নিয়ে এই চাষ করা সম্ভব। তবে অবশ্যই মনে রাখতে হবে এ ভাবে প্রাপ্ত স্পিরুলিনা হয়তো মানুষের খাদ্য উপযোগী হবে না। কিন্তু মাছ ও অন্যান্য ছোট প্রাণী পালনে দারুণ উপযোগী এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ এই প্রাকৃতিক খাবার। অ্যাজুলার নীচের দিকে, ছোট প্রকোষ্ঠে নীল-সবুজ সায়ানো ব্যাকটেরিয়া নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া বাস করে, যা বাতাসের নাইট্রোজেন ধরে রেখে জল এবং মাটিতে সহায়তা করে, উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ফলে নাইট্রোজেনযুক্ত সবুজ সার যেমন পাওয়া যাবে তেমন উৎকৃষ্ট মানের মাছের খাদ্য হিসেবেও বেশ গুরুত্ব পাবে এই অ্যাজোলা।
মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট
অ্যাজোলা এবং স্পিরুলিনা দুটিই অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন-বি১২ ছাড়াও ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ। এত গেল অ্যাজোলা এবং স্পাইরুলিনা চাষের কথা। এছাড়াও সাধারণ গোবর কম্পোস্ট,ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার, তৈলবীজের খোল, সবুজ সার ইত্যাদি পাশাপাশি করে নিতে পারলে অনেক সুবিধা হয়। ভার্মি কম্পোস্টে, এক কেজি কেঁচো তিন কেজি কেঁচো সার তৈরি করতে পারে। এগুলি ছাড়াও পুকুরপাড়ছ প্রাণীকণা, যেমন রোটিফার বা ব্রাকিওনাস চাষ করা করে নেয়া যায় অতি সহজে। হয়তো বা হাতেকলমে দু- তিন দিনের প্রশিক্ষণ দরকার হতে পারে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩০: গিরীশচন্দ্রের মা সারদা
এই প্রশিক্ষণ কাছাকাছি অবস্থিত কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র, মৎস্য গবেষণা ও সম্প্রসারণ সংস্থা, একাধিক এনজিও নিয়মিত বিনামূল্যে চাষীদের জন্য আয়োজন করে থাকেন। এ ভাবে যদি সহজ এবং প্রাকৃতিক উপায়ে কয়েকটি জিনিস হাতের কাছে সহজে পাওয়া যায়, মাছচাষিকে আর চাষ করবার জন্য খাবার কিনে দেবার দরকার পড়বে না। সেই সঙ্গে জৈবখাদ্য সরবরাহের মাধ্যমছ সতেজ মাছ উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব, যার বাজার দরও হয়তো সাধারণ মাছের তুলনায় তুলনায় কিছুটা তো বেশি হবেই। মাছচাষি বেশি দাম পাবেনই।
ফলে চাষির লাভের অংক অনেকটাই বাড়বে এবং সুনিশ্চিত হবে টেকসই মাছ চাষের এক সহজ পন্থা। কোনও মাছচাষি যদি মনে করেন এই জৈব খাবার সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে জৈব উপায়েও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে পারলে ওষুধপত্রের কেনার খরচ থেকেও নিষ্কৃতি পেতে পারেন। এই রোগবালাই নিবারণের জন্যে বীজামৃত মা নিম, হলুদ, তুলসী, রসুন, গুলঞ্চ এবং তামাকপাতা মিশিয়ে সন্ধান প্রক্রিয়ায় নির্যাস তৈরি করে রেখে দিলে এবং চাষ চলাকালীন মাছের রোগের প্রকোপ দেখা দিক বা না দিক, পনেরো দিনের ব্যবধানে বাতিলকৃত স্যালাইন বোতলের মাধ্যমে ড্রিপ পদ্ধতিতে ধীরলয়ে ২৪ ঘণ্টা প্রয়োগ করতে পারলে রোগের সংক্রমণ এড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে।
ছবি: লেখক
ফলে চাষির লাভের অংক অনেকটাই বাড়বে এবং সুনিশ্চিত হবে টেকসই মাছ চাষের এক সহজ পন্থা। কোনও মাছচাষি যদি মনে করেন এই জৈব খাবার সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে জৈব উপায়েও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে পারলে ওষুধপত্রের কেনার খরচ থেকেও নিষ্কৃতি পেতে পারেন। এই রোগবালাই নিবারণের জন্যে বীজামৃত মা নিম, হলুদ, তুলসী, রসুন, গুলঞ্চ এবং তামাকপাতা মিশিয়ে সন্ধান প্রক্রিয়ায় নির্যাস তৈরি করে রেখে দিলে এবং চাষ চলাকালীন মাছের রোগের প্রকোপ দেখা দিক বা না দিক, পনেরো দিনের ব্যবধানে বাতিলকৃত স্যালাইন বোতলের মাধ্যমে ড্রিপ পদ্ধতিতে ধীরলয়ে ২৪ ঘণ্টা প্রয়োগ করতে পারলে রোগের সংক্রমণ এড়ানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকবে।
ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।