বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আমাদের রাজ্যের উপকূলবর্তী জেলাগুলি যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনার আংশিক এলাকা এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় নোনা জলের মাছ বিশেষ করে পারশে, ভাঙ্গন ভেটকি, গুরজালি ছাড়াও গ্রুপার, কোবিয়া, সিলভার পম্পানোর মতো মাছ আবার বাগদা চিংড়ি, ভেনামি চিংড়ি, কাঁকড়া চাষ ইত্যাদি বেশ ভালোই হচ্ছে। কারণ, এই মাছগুলির চাহিদা সারা বছর ধরেই তুঙ্গে থাকে।
এই সব মাছ পুষ্টিগুণের দিক থেকেও মিষ্টি জলের মাছের চাইতে অনেকটা উন্নতমানের। প্রায় প্রতিটি বাঙালি পরিবারে এই মাছগুলি খুব সুস্বাদু মাছ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে বহুকাল আগেই। সেই চাহিদার কোনও কমতি দেখা যায় না। জেলাগুলির, বিভিন্ন ব্লকে এইসব মাছ এবং চিংড়ি মাছ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া চলেছে প্রায় সারা বছর ধরেই। উদ্দেশ্য একটাই, মাছচাষিরা এই মাছের চাষপদ্ধতি ভালো করে শিখে নিয়ে, পরিবেশবান্ধব উপায়ে এই মাছগুলি চাষ করবেন ফলনও ভালো পাবেন। আবার পরিবেশেরও কোনওরকম ক্ষতি হবে না।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৭: পুকুর থাকলে বিকল্প আয়ের জন্য চিতল মাছ চাষের কথা ভেবে দেখতে পারেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৪: রামচন্দ্রকে ঘিরে যুগান্তরেও কেন উন্মাদনা? একজন কথকঠাকুরানির সাধারণ সমীক্ষা

পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী সমুদ্র এলাকা, নদীমোহনা, খাঁড়ি, সুন্দরবন এলাকার ভেতরে আনাচে কানাচে প্রসারিত নানা শাখা প্রশাখা যুক্ত খাল—এইসব মাছ এবং চিংড়ির আদর্শ বাসস্থানের পরিবেশ। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জলদ্বারা প্লাবিত হবার পরে, নদীর নিম্নগতিতে মিষ্টি জলের সংমিশ্রনে সৃষ্ট জলরাশিকে নোনা জল বা ব্র্যাকিস ওয়াটার বলা হয়। বিভিন্ন মরশুমে এই জলের লবণাক্ততার হ্রাস বৃদ্ধি হয়। জলের লবণাক্ততা এক পিপিটি বা এক গ্রাম পতি প্রতি লিটার থেকে তিরিশ পিপিটি বা তিরিশ গ্রাম প্রতি লিটারে বা তার থেকেও একটু বেশিও হতে পারে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: যে মানুষ চেয়ে চেয়ে / ফিরিতেছি পাগল হয়ে

আমাদের দেশীয় বাজারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও চাহিদার কারণেও নোনা জলের মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার চাষের প্রসার হচ্ছে। জৈব সুরক্ষাবিধি সঠিকভাবে মেনে চলতে পারলে সুখ্যাত ও ভালমানের কোনও হ্যাচারি থেকে এদের মীন জোগাড় করে নিয়ে চাষ শুরু করলে রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে চিন্তা থাকার কথা নয়। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বীজ পাওয়া যায় এদের। বিশেষ করে পার্শে ও ভাঙ্গনের বীজ, হুগলি ও মাতলা অববাহিকায়, জুন জুলাইতে প্রচুর পাওয়া যায়। এই মাছগুলিকে মালেটস্ বলা হয়। বিশেষত পার্শে এবং ভাঙ্গনকেই বলা হয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

এই মাছগুলির বিশেষত্ব হল, এরা খুব স্বল্প লবণাক্ত জলে, এমনকি মিষ্টি জলে আবার একটু বেশি লবণাক্ত জলে, সব জায়গাতেই মানিয়ে নিয়ে থাকতে পারে। আমিষভোজী ভেটকি মাছের বীজ সিবার কাকদ্বীপস্থ গবেষণাগার অর্থাৎ ফার্মে পাওয়া যেতে পারে। প্রজননের জন্য এই মাছ সাধারণত গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেয়। ভেটকির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল, এই মাছ উভলিঙ্গ হতে পারে। চার কেজি ওজনের একটি পুরুষ ভেটকি হঠাৎ স্ত্রী ভেটকিতে রূপান্তরিত হতে পারে। ভেটকির ডিমপোনা স্রোতের মাধ্যমে মোহনায় চলে আসে। সেখান থেকে ভেটকি পোনা সংগ্রহ করেও চাষ করা যায়।
এইসব অঞ্চলে, বেশ কিছু চাষি, এই মাছচাষে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছেন যে মনে হয় প্রশিক্ষণকালে তাঁদের ডেকে এনে শিক্ষাগুরুস্থানে বসিয়ে, হাতে কলমে এই সমস্ত মাছচাষের প্রজনন এবং আনুষঙ্গিক কাজকর্মের বিষয়ে পরামর্শ পেলে, বর্তমান প্রজন্মের নতুন চাষিরা উদ্বুদ্ধ হবেন। ফলে এইসব মাছ চাষে আগামী দিনে চিন্তার কোনও অবকাশ থাকবে না। ভারত সরকারের এবং রাজ্য সরকারের নোনা জলের মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির এইরকম একটি চিন্তা কার্যকরী হলছ, মনে হয় সর্বতোভাবেই তা মঙ্গলজনক হবে।—চলবে।

ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content