গিফট (GIFT: Genetically Improved Farmed Tilapia) জাতের এই উচ্চ ফলনশীল মাছটি তদানীন্তন (১৯৮৭-৮৮) আইসিএলএআরএম (ICLARM) (ম্যানিলা ফিলিপিনস) আবিষ্কৃত হয়েছিল। বর্তমানে এই সংস্থাটি ওয়ার্ল্ড ফিশ নামে পরিচিত। এখন এর সদর দপ্তর ম্যানিলা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে স্থানান্তরিত হয়েছে। এর বিজ্ঞানীরাই ছিলেন এই মাছটির রূপকার। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড. আম্বেকার একনাথ, যিনি পরবর্তীকালে ভুবনেশ্বরে আইসিএআর-আইসিএফএ (ICAR-CIFA)-র ডিরেক্টর পদে প্রায় পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন।
তেলাপিয়া মাছটির অনেক সুবিধা বরাবরই ছিল। যেমন, এর রোগবালাই সংক্রমণ হয় না বললেই চলে। যে কোনও জলাশয়েই যখন খুশি চাষ করা যায়। খাদ্য শৃঙ্খলের নিচের দিকের খাবার যেমন—বিভিন্ন উদ্ভিদ কণা প্রাণী কণা, নানা জলজ কীটের লার্ভা, পিউপা এসব খেতে অভ্যস্ত। এমনকি, যে কোনও পরিপূরক খাবার দিলেই যে কোনও সময়ে এরা গ্রহণ করে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৫: খাল-বিলে কিছু পরিমাণ পুঁটি পাওয়া গেলেও, এখন আর সব কটি প্রজাতির মাছের দেখা মেলে না
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর
এত সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এতদিন এই মাছটির চাষ, তেমন ব্যাপক প্রসারলাভ করেনি। মূল সমস্যাটি ছিল, এদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি। একাধিকবার বিভিন্ন তেলাপিয়ার মধ্যে সংকরায়ণ করেও অবাঞ্ছিত প্রজননের সমস্যাটির সুরাহা করা যায়নি। পরবর্তীকালে স্টেরয়েড হরমোন প্রয়োগ করে, সব পুরুষ তেলাপিয়া করা গেলেও মানুষের স্বাস্থ্যের উপর হানিকর প্রভাবের কথা চিন্তা করে এটিকেও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩১: গুরুদক্ষিণাদান, প্রতিহিংসার সুদূরপ্রসারী পরিণাম
বিভিন্ন উৎস থেকে তেলাপিয়ার বাছাই করা কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে নির্বাচিত প্রজননের (Selective Breeding) মাধ্যমে কেবল পুরুষ মাছই (mono sex) উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে পুরুষ মাছের বৃদ্ধি অনেক বেশি এবং দ্রুত। মাছটি চাষের অনুমোদন পেতে হলে মৎস্য দপ্তরের নির্ধারিত পুকুরের নকশা তৈরি করে এবং বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও হ্যাচারিতে বিশেষ নিরাপত্তা বজায় রেখে অনুমোদন সাপেক্ষে ও বিশেষ শর্ত বজায় রেখে তবেই এর চাষের অনুমতি পাওয়া যায়।
যেহেতু এটি একটি Genetically modified species বা প্রজাতি, তাই এই মাছটি চাষের অনুমোদন কেবলমাত্র সেইসব চাষিরাই এখন পাবেন যাঁরা বিশেষভাবে সুরক্ষিত ও নির্মিত ফার্মে জৈব নিরাপত্তার ব্যবস্থা যথোচিতভাবে বজায় রেখে চাষ করতে পারবেন। সেই সঙ্গে চাষ প্রক্রিয়া চলাকালীনও ভারত সরকারের Department of Fisheries, Animal Husbandry and Dairying-এর নিয়ম অনুযায়ী চাষ হবে। অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়াতে অবস্থিত রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর এগ্রিকালচার থেকে পোনা সংগ্রহ করে চাষ ব্যবস্থা এখন চালু হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৮: ও দয়াল! বিচার করো!
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১০: কী উপহার সাজিয়ে দিলে…
এ রাজ্যের বেশ কয়েকজন চাষি এটির চাষের অনুমোদন পেয়েছেন। কলকাতার কাছেই জয়নগরে (দক্ষিণ ২৪ পরগনা) অবস্থিত সইফুল্লা মন্ডলের ফার্মে এই তেলাপিয়া চাষ হচ্ছে। এখন তিন মাসেরও কম সময়ে দেড়শ গ্রামের বেশি ওজন পাওয়া যাচ্ছে এই মাছটির। আশা করা যায়, আগামী দিনে এই মাছটি আমাদের দৈনন্দিন পুষ্টি যোগানোর ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।