বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সুন্দরবন বলতেই মনে আসে ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ কথাটি। প্রবাদ বাক্যটি কিন্তু যথার্থ নয়। বরং বলা উচিত ছিল— ‘জলে মাছ ডাঙ্গায় বাঘ’। তার কারণ সুন্দরবনের কত যে নদী খাঁড়ি ইত্যাদি রয়েছে, মাছ বৈচিত্র্যের নিরিখে যার বিশ্ব জোড়া খ্যাতি আছে। যদিও সুন্দরবনে ব্যাঘ্র প্রকল্প ও কুমির প্রকল্প চলছে। সুন্দরবনকে বায়োসফেরিক রিজার্ভ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে ১৯৮৯ সালে।
এখানকার নদী, খাঁড়িতে নানান প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক ইত্যাদি রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মাছ যেমন: মিল্ক ফিস, খরসুলা, পায়রাচাঁদা, মুক্তগাছা এবং তোপসে এই পাঁচটি মাছ কিন্তু খুবই জনপ্রিয়। গত কয়েক বছর ধরে এই মাছগুলি আর তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এর পিছনে হয়তো অনেক কারণ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে মাছ চাষে প্রক্রিয়াকর, বাজারজাতকরণ রপ্তানি ইত্যাদি যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি সামগ্রিক দূষণ, অপরিকল্পিতভাবে মাছ এবং জলজ ফসল উত্তোলন সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৪১: মৎস্যজীবীদের মীন সংগ্রহে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে প্রচুর অপচয় কমবে, রক্ষা পাবে মাছের জীব বৈচিত্র্যও

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১: একটি ক্লান্তিকর বাসযাত্রা এবং…

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৪: শুধু কি পিতৃবিয়োগব্যথা লাভ ভরতের, না কি আরও দুঃখ অপেক্ষমাণ…

যে কোনও কারণেই হোক না কেন, আমাদের এই পাঁচ রকমের মাছকে কিন্তু সহজলভ্য করতেই হবে। এর পেছনে অনেকগুলি কারণ আছে। যেমন মিল্ক ফিস এমন একটি মাছ যার তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা এবং সহনশীলতার মাত্রা অনেক বেশি। দ্রবীভূত অক্সিজেনের কমবেশিতেও এই মাছটি কোনও অসুবিধা বোধ করে না। এমনকি এই মাছটির প্রায় কোনও রোগবালাইয়ের সমস্যা নেই। অথচ এই মাছের স্বাদ আপামর বাঙালির কাছে খুব প্রিয়। এর ধবধবে সাদা নরম মাংস যা উন্নত মানের প্রোটিনে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ভিটামিন-বি টুয়েলভ এবং পটাশিয়াম অন্য যে কোনও মাছের তুলনায় বেশি থাকায় এটি স্বাদের দিক থেকেও অতুলনীয়।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

এই বইমেলা জানে আমার প্রথম অনেক কিছু…

শুধু যে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ তা নয়, এমন একটি মাছকে কৃত্রিমভাবে চাষ করা হচ্ছে কিছু কিছু জায়গায়। কিন্তু কিছুদিন আগেও সুন্দরবনের সর্বত্রই এই মাছটি পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণে। একইভাবে খরসুলা বা রাইনো মিউগিল খুবই সুস্বাদু মাছ। পার্শে ও ভাঙ্গন বা মালেক শ্রেণিভুক্ত এই মাছ মোহনায় প্রচুর পরিমাণে আগে পাওয়া যেত। যেকোনও কারণেই হোক, এই মাছকে আমরা এখন কম পাই। এর চাষ যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা একেবারেই নগণ্য। এই মাছ পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে বিশেষত দীর্ঘ শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতির কারণে হার্টপেশেন্টদের খুব পছন্দের মাছ। বর্তমানে এই মাছটিকে প্রায় বিপন্ন মাছের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। হয়তো আগামী দিনে এই মাছ সংরক্ষণ নিয়ে বিশেষ চিন্তা ভাবনা হবে।
আরেকটি মাছ হল পার্ল স্পট বা মুক্তগাছা। এটি আকারে ছোট কিন্তু খুবই সুস্বাদু। এটি কেরালার রাজ্যের রাজ্য মাছ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সমাদৃত হয়ে আসছে। মূলত নোনা জলের মাছ হলেও মিষ্টি জলেও এটির সুন্দর চাষ হয়। ভিটামিন-ডি, ক্যালশিয়াম, সিলেনিয়াম এবং পুফাসমৃদ্ধ এই মাছটি সেরা পুষ্টির অন্তর্গত।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়লে অনেক খাবারই বাদ দিতে হয়, তা হলে কী কী খেতে পারেন?

দশভুজা: স্বাতী মোহন— এক এবং অন্যতমার আখ্যান…

চতুর্থ মাছটি স্ক্যাটো ফেগাস বা পায়রাচাঁদা। ইংরেজিতে অনেকে একে বাটার ফিশও বলে থাকেন। বাংলায় যদিও একে পায়রাচাঁদা বলা হয়। কিছু কিছু জায়গায় পায়রাতালি নামেও পরিচিত এটি। এই মাছটির কাঁটাতে কিন্তু বিষ থাকে এবং এই মাছকে ধরা একটু মুশকিল। রঙিন মাছ হিসেবে বিদেশের বাজারে এর মূল্য আছে। এর গায়ে স্পটগুলি বিভিন্ন রঙের হয়। স্বাদের বিচারে এটিও খুব উচ্চ পর্যায়ে পড়ে।
আরেকটি মাছের নাম করতেই হয় যেটি তোপসে নামে পরিচিত। বাঙালির কাছে এই মাছ বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। মাছটি দেখতে কিছুটা অদ্ভুত। গায়ের রংটি হলুদ। পাখনা থেকে স্ট্রিং বেরিয়ে থাকে। এরা মিষ্টি জল এবং সমুদ্রের জলে অনায়াসে যাতায়াত করে, যদিও এটি প্রজননের কারণে নয়। যেমনটি হয় ইলিশের ক্ষেত্রে। এই মাছটির আজ প্রায় সমস্ত বাঙালির কাছেই গ্রহণযোগ্য। কিছু কিছু জায়গায় এই মাছটির চাষ হচ্ছে কিন্তু এর ফলন খুব ভালো নয়। কখনও কখনও নদীর জল থেকে এটি পাওয়া যায়। সমুদ্রতেও মেলে। কিন্তু এই পাঁচটি মাছ নিয়মিত যদি বাজারে পাওয়া যেতো তাহলে মৎস্যরসিকরা অন্তত মাছবৈচিত্রের কিছুটা হলেও স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতেন না।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content