রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


মাছ নিয়ে এ যাবৎ যত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার একটা অংশ হয়তো সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীকে নিয়ে লেখাকেও ছাপিয়ে যাবে। হয়তো বা মাছ প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণী কিংবা পৃথিবীতে মোট মেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যায় অর্ধেকেরও বেশি হবে! মৎস্য শ্রেণিভুক্ত প্রাণী কোথায় বা না পাওয়া যায়? আন্টার্কটিকার হিমশৈলের কোলে, মরুভূমির নিকটবর্তী তপ্ত জলাশয়ে, সুউচ্চ পর্বতের হ্রদেও এরা আছে। আবার আছে গভীর সমুদ্রেও, জলের চাপ সহ্য করে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমুদ্রের তলদেশে।
জলজ পরিবেশ থেকে সাময়িকভাবে গাছ কিংবা ডাঙায় উঠে বা শুষ্ক ঋতুতে মাটির গর্তে বাতাস থেকে অক্সিজেন টেনে গরমের মধ্যেও সময় কাটানোর ক্ষমতা এদের আছে। এ যাবৎ প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। শুধু যে সংখ্যাতেই এত তা নয়, আকার আয়তনেও যে এদের কত বৈচিত্র্য আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। অতি পরিচিত ঘোড়ামুখো মাছ বা সিহর্সকে, মাছ বলেই মনে হবে না প্রথম দর্শনে। কি আশ্চর্য সুন্দর এদের জীবন প্রণালী। স্বামী-স্ত্রী এরা একসঙ্গে সারা জীবন অতিবাহিত করে। নিজের সঙ্গীটি ভিন্ন অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার একটিও উদাহরণ নেই এদের মধ্যে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৫: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবপ্রজন্ম-মীনমিত্রের পরামর্শে গ্রামগঞ্জেও মাছচাষ বিকল্প আয়ের দিশা দেখাতে পারে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং কয়েকটি প্রশ্ন

অজানার সন্ধানে, অঙ্কই ধ্যানজ্ঞান, মোটা বেতনের চাকরি নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেন আইআইটি-র শ্রবণ

লেজের দিকে একটি থলি থাকে। ওদের নিষিক্ত ডিম সেখানেই বড় হয় এবং ডিম পোনা তৈরি হয়। সব দায়িত্ব পুরুষ মাছের। এই প্রজাতির স্ত্রী মাছের ডিমের জন্ম দেওয়া পর্যন্তই কাজ। তারপরে পুরো দায়িত্ব পুরুষের। এই কারণেই এই মাছের পুরুষকে ‘মিস্টার মম’ বলা যেতে পারে। ইল মাছ দেখতে সাপের মতো হয়। শংকর মাছ চ্যাপ্টা শাপলাপাতার মতো। পাফার ফিস বলের মত গোলাকার। শোল বা ফ্লাউণ্ডারের দুটো চোখই এক দিকে, পাশাপাশি থাকে। অন্য প্রাণীর যেমন পাশাপাশি দুটো চোখ থাকে, মাছেরও কিন্তু দু’ দিকেই দুটো চোখ। মাছ দুটি চোখ দিয়েই সব কিছু দেখতে পায়। মাছের দেহগঠনও এত সুন্দর যে, বাতাস থেকে প্রায় সাড়ে ৮০০ গুণ বেশি ঘনত্ব যুক্ত জলেও অতি সাবলীলভাবে অল্প শক্তি ব্যয় করে চমৎকার সাঁতার কেটে চলে। শক্তি সাশ্রয় করে প্রতি মুহূর্তে।
ম্যাকারেল মাছ তো ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার সাঁতরে যেতে পারে। প্রাণ রসায়নের দিক থেকেও মাছ খুব ভাগ্যবান। প্রোটিনের বিপাকে তৈরি হওয়া বর্জ্য অ্যামোনিয়া অবস্থায় রূপান্তরিত হলেই নির্গত করতে পারে। আমাদের মতো অ্যামোনিয়ার পরে ইউরিয়া তৈরি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না বা এর জন্যে অকারণে বাড়তি শক্তিও নষ্ট হয় না। মাছ তাই অ্যামনোটেলিক প্রাণী‌। আমরা বা অন্য প্রাণী আছে ইউরিওটেলিক, আবার কিছু আছে ইউরিকোটেলিক প্রাণীও আছে। মাছ অ্যামোনিয়া নিশ্চিত করে বলে শক্তি বাঁচাতে পারে অনেক, প্রতিটি অণুর প্রোটিন পরিপাকে। সে দিক থেকে মাছেদের তুলনায় আমরা শক্তি অপচয় করি অনেক বেশি।

আমাদের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনাইট বজায় রাখতেই হয় সততই। অর্থাৎ খাদ্য থেকে পাওয়া শক্তির একটা অংশ দেহের তাপমাত্রা বজায় রাখতেই চলে যায়। মাছের কিন্তু এ ভাবে শক্তি অপচয় হয় না। কারণ তার এই দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার দরকার নেই। এই জন্যে ওদের বলা হয় কয়কিলোথার্মিক। আর আমরা হলাম হোমিওথার্মিক।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৫: আর্য কোথায়?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

একটি পরিণত স্ত্রী রুই বা ইলিশ মাছ একবারে এক লক্ষ ডিম ছাড়তে পারে। মনে করা যেতে পারে একটি রুই বা ইলিশ যদি এক লক্ষ ডিম ছাড়ে এবং তাদের মধ্যে কুড়ি হাজারও মরে যায়, তাহলেও একটি মাছ থেকে সংখ্যায় আশি হাজার মাছ বছরে পাওয়া সম্ভব। এহেন সুযোগ সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও এদের এমন কিছু সমস্যা আছে যার জন্য কিছুটা অন্য প্রাণীর থেকে কম সুবিধা পায় মাছেরা। যেমন এদের শরীরে ভিটামিন সি তৈরি করার জন্য সমস্ত উৎসেচকই বর্তমান‌। প্রথমে গ্লুকোজ ও পরে গ্লুকিউরোনিক অ্যাসিড থেকে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বা ভিটামিন সি তৈরির জন্য যে সব ধাপ আছে তার প্রতিটির জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক থাকলেও কেবল শেষ উৎসেচক জিএলও-এর অনুপস্থিতির কারণে মাছ ভিটামিন সি তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ খাবার থেকে যোগান দিতেই হবে ভিটামিন সি। নচেত এই খাদ্যটি না হলে চলবে না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২০: রায়পুর থেকে রাজিম

অনুরূপভাবে বিভিন্ন উদ্ভিদজাত পদার্থ যা খেয়ে মাছ মূলত জীবন ধারণ করে সেই সমস্ত উদ্ভিদে ফসফরাস সাধারণত ফাইটেট আকারে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত প্রায় কোনও মাছের মধ্যেই ফাইটেস নামক উৎসেচকটি নেই বললেই চলে। অর্থাৎ উদ্ভিজ্জ খাবার খেলেও সে ফসফরাস আহরণ করতে পারে না। ফলে সম্পূর্ণ ফসফরাস জলে বর্জ্যের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এরকম আরও বেশ কিছু অসুবিধে আছে, যেগুলি বিজ্ঞানীরা ক্রমশ জানছেন এবং মাছচাষে উত্তরোত্তর বিজ্ঞানের প্রয়োগ হচ্ছে।
তবে এই অসুবিধাজনিত কারণে মাছের উৎপাদন অবশ্য ব্যাহত হচ্ছে না। কারণ বিজ্ঞানের ন্যায়-নীতি এবং প্রযুক্তির প্রয়োগে মাছ চাষ সারা পৃথিবীতেই বাড়বাড়ন্ত। আর আমাদের দেশ সেদিক থেকে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আমাদের ধারে কাছে চিন ছাড়া আর কোনও দেশ আসতেও পারছে না‌। মাছচাষে এবং মাছের বৈচিত্র্যে আমরা সারা বিশ্বে এগিয়ে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content