সাম্প্রতিককালে কৃষি ও অন্যন্য চাষের বিষয়গুলিতে, বিশেষ করে মাছচাষে আধুনিকতার ছোঁয়াচ এবং সামগ্রিকভাবে যথেষ্ট উন্নতি দেখা যায়। সরকারিভাবেও মাছ চাষ ক্রমাগত গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ, সরকার প্রায় আইন তৈরি করে ফেলেছে যে, জলা যার মাছ তার।
সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কোনও জলাশয় পতিত রাখা যাবে না, কিংবা ভরাটও করা যাবে না। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে, প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, পুকুরগুলি থেকে মাছের ফলন কমসময়ে আগের থেকে অনেক বেশি হচ্ছে। এটি যথেষ্ট আশা ব্যঞ্জক।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৯: ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু খরশুলা মাছ
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?
বিঘা প্রতি অন্তত এক টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছেই। এর ফলে মাছের দামও বাজারে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে যেতে পারেনি। এই যে বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষের উল্লেখ করা হল, সেখানে একটা জিনিস খুবই গুরুত্ব পেয়েছে, তা হল মাছকে নিয়মিত খাবার যোগান দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগে খাবার দেওয়ার পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা সহজ। এখন তো কম্পিউটারের প্রয়োগের মাধ্যমে, একজন ঘরে বসেই পুকুরের খাবার দেওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কী রকম খাবার দেওয়া হবে, কখন তা দেওয়া হবে, কতক্ষণের ব্যবধানে দেওয়া হবে, ইত্যাদি আরও খুঁটিনাটি প্রযুক্তি প্রয়োগে নিখুঁতভাবে করা সম্ভব হচ্ছে।
এই যে নিয়মিত খাবার দেওয়া ব্যাপারটি ছাড়াও নিয়মিত পুকুরে জালটানা এবং এবং দেখে নেওয়া, পুকুরে মাছের বৃদ্ধি কেমন হল বা মাছেদের রোগবালাই সংক্রমণ হল কিনা—এ সবের জন্যও পনেরো দিনে না হলেও, মাসে একবার জাল টানাতো পুকুরে একান্ত দরকার। এতে যথেষ্ট উপকার হয়, লাভ তো হয়ই। আর এই মাছচাষ করতে এসে এই লাভ ক্ষতির ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই এতটাই গুরুত্ব পেয়ে যায় যে, এটা খুবই দুঃখজনক যে মৎস্যজীবী যারা আছেন, তাঁরা বলতে গেলে দারিদ্র্যসীমার নীচেই বসবাস করেন। তাঁদের মধ্যে আবার কিছু জন নিয়মিত জাল টেনে মাছ ধরেন কেউ বা জাল বোনেন বা জাল মেরামতি করেন। এঁদের অনেকেরই আয় খুবই কম। তা সত্ত্বেও তাঁরা, বংশভিত্তিক এই জীবিকাটিকে ত্যাগ করতে পারছেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
জালটানার কাজ তো প্রায়ই করতে হয়। মাছ তোলার সময়টাই হল ভোর রাতের দিকে। নচেত বাজারে ভোরবেলায় মাছের যোগান সম্ভব হবে না। এছাড়া আগেও বলেছি, মাছ বাড়ানোর জন্য দিনের বেলাতেও জাল টানার দরকার হয়। যাতে মাছের ব্যায়াম হয়। মাছের বৃদ্ধি একটু বাড়ে। এত যে প্রযুক্তির প্রয়োগ হচ্ছে এই প্রান্তিক মানুষগুলি যাঁরা শীতের রাত্রে জলে নেমে জাল টানেন এবং যখন দেখেন তাঁদের পরিচ্ছদ বলতে অঙ্গে হাফপ্যান্ট গামছা ও বড়জোর একটি গেঞ্জি থাকে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ
নিজেদের সুরক্ষার জন্যে উপযুক্ত পোশাক এবং শীতকালে শীত নিবারণের জন্য যে পরিচ্ছদ দরকার তা প্রায়ই থাকে না। অনেক সময় পুকুরের তলদেশে পড়ে থাকা ধারাল কোনও জিনিস থাকতে পারে তাতে পা কেটে যেতে পারে। উপরের জগতে তো থাকেই বিপদের নানা সম্ভাবনা। যেমন, অনেক সময় থাকে জোঁকের উপদ্রব। তাদের কামরের দরুণ, শারীরিকক্ষতির সম্ভাবনা থাকেই। এছাড়া জলঢোঁড়া সাপ,বড় হাইব্রিড মাগুরের উপদ্রব। এগুলি অনেক সময় অঙ্গহানিও করে থাকে।
ন্যূনতম আইনের তোয়াক্কা না করে প্রায় স্বেচ্ছাচারিতা চালান পুকুর মালিকদের একাংশ। তাঁরা বাধ্য করেন, এই মৎস্যজীবীদের, খালি পায়ে ঠান্ডা জলে পুকুরে মাছ ধরার কাজে নামতে। সুস্থ মানবিকতা দরুণ হয়তো আমাদের সকলেরই এই দায় কিন্তু থেকেই যায়। তাই আশা করব, এই মানুষগুলির সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বাজারে পাওয়া যায়—এমন লম্বা জুতোসহ পোশাক পরে যদি তাঁরা জলে নামেন তাহলে এই বিশয়ে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায়। আর ঠান্ডা জলে ঠান্ডানিবারণের জন্য কোনও পরিধেয় বস্ত্র, যেটা জলে ভিজে গেলেও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে না, রাবারের তৈরি, ছবিতে দেখানো এমন কোনও পোশাক যদি তাঁদের সরবরাহ করা যায় তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা এই অসুবিধাগুলি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। মৎস্যজীবী ভাইদের জন্য এটি আমাদের সামাজিক কর্তব্য বলে আমার মনে হয়।—চলবে।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।