পোনা জাতীয় মাছ বিশেষ করে কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবোস, বাটা ইত্যাদি সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মে প্রজননক্ষম হলেও স্থির জলাশয়ে এরা বংশবিস্তার করতে পারে না। যদিও বহমান জল যেমন নদীতে এদের কোন অসুবিধে হয় না। স্থির জলাশয়ে যেমন পুকুরে স্ত্রী মাছের ডিম আসে এবং পুরুষ মাছও পরিণত হয়, তাদের স্বাভাবিকভাবেই বীর্য তৈরি হয়। কিন্তু স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়তে পারে না, ফলে পুরুষ মাছের কিছু ভূমিকাও থাকে না। আর স্ত্রী মাছের এই ডিম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে শোষিত হয়ে যায়।
পুকুরের মাছকে প্রজনন করাবার জন্য বাইরে থেকে যোগাড় করা হরমোন ইনজেকশন করে তবে এদের প্রজনন করানো হয়। মাছের মুড়োর ভিতরে মস্তিষ্কের ঠিক নিচে একটি ছোট্ট সুরক্ষিত স্থানে থাকে পিটিউটারি গ্রন্থি। আমাদের দেশে মাছচাষে এই গ্রন্থি সংগ্রহ করে এবং স্যালাইন দ্রবণ তৈরি করে সেই দ্রবণকে হাত চালিত সেন্ট্রিফিউজ মেশিনে ঘুরিয়ে নিয়ে ওপরের স্বচ্ছ দ্রবণ থেকে নিয়ে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণে ইনজেকশন দেওয়া হয়। মাছের ডিম পাড়ানো সম্ভব হয়। এই প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে মাছের ডিম ফোটানোর এই অভিনব পদ্ধতিটি আমাদের দেশের প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৭ সালে। সঠিক দিনটি ছিল ১০ জুলাই ১৯৫৭।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৭: অ্যাকোয়াপোনিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগে উৎকৃষ্টমানের মাছ এবং গাছ বেড়ে উঠতে পারে
হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’
গবেষণায় এই পদ্ধতিটি হল প্রথম প্রযুক্তির প্রয়োগ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতেই মাছের ডিম ফোটানো একনাগাড়ে চলেছে সারা দেশব্যাপী। এই প্রযুক্তি জানার আগে প্রথমে নদী থেকে মাছের ডিম পোনা সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়া হতো।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি
পরবর্তীকালে পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার কিছু বাঁধে অবিরাম বৃষ্টির সময়ে প্রজননক্ষম মাছ ছেড়ে দিয়ে ডিম ফোটানো এবং নিষিক্ত করা হতো। এই পদ্ধতিটিও আমাদের দেশে চাষীদের আবিষ্কৃত এক অভিনব প্রযুক্তি, যেটি বাঁধ ব্রিডিং নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল
খাই খাই: গরমে বিকেলের টিফিনে চটপট তৈরি করে ফেলুন ডিমের কাবাব
এই পিটুটারি গ্ল্যান্ডের ভিতর এফএসএইচ এবং এলএইচ নামে দুটি হরমোন এই প্রজনন ক্রিয়ার মূল হোতা। আজকাল যদিও কৃত্রিমভাবে এই হরমোন অর্থাৎ এফএসএইচ এবং এলএইচ তৈরি করা হচ্ছে এবং বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। তথাপি পিটুইটারি গ্রন্থির দ্রবণ ইঞ্জেকশন করে মাছের ব্রিডিং করানো বা ডিম ফোটানোর পদ্ধতি সারা বিশ্বে এক স্বীকৃত পদ্ধতি।
প্রাণীবিজ্ঞানে খুব কমই এইরকম সহজ পদ্ধতি দেখা যায়। এই রকম পদ্ধতি নেই বললেই চলে। বিশ্বে জনপ্রিয় এই অভিনব পদ্ধতিটির আবিষ্কর্তা ড. হীরালাল চৌধুরী। যিনি ব্যারাকপুরের কেন্দ্রীয় মত্স্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত কটকে অবস্থিত গবেষণাগারে এই আবিষ্কারটি করেন। এই আবিষ্কার মাছ চাষের এক দিগন্তের উন্মোচন হয়। এই পদ্ধতি আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।