মেলা বলতে আমরা জানি মিলন মেলা। পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত মেলা অনেক জায়গাতেই হয়ে থাকে। মেলার উদ্দেশ্য মূলত বিনোদন। কিন্তু প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো মৎস্য মেলার সন্ধান অনেকেই হয়তো জানেন না। এই মৎস্য মেলার উদ্দেশ্য, মূলত বিপণন ও বাণিজ্য। ব্যবসায়ীরা এই মেলাকে উপলক্ষ করে সমবেত হন। তাঁদের মাছের পসরা নিয়ে সমবেত হন এই মেলায়। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রদর্শন এবং বিক্রয় গত ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে।
প্রতিবছর পয়লা মাঘ এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্যান্ডেল স্টেশনের কাছে বা আরও কাছাকাছি আদি সপ্তগ্রাম রেল স্টেশন থেকে এক কিলোমিটারের সামান্য বেশি দূরে, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মনিবাস দেবানন্দপুর থেকে দু’ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণপুরে এই মেলাটি বসে। মগরা ব্লকের অধীনে সরস্বতী নদীর পাড়ে প্রায় আড়াই বিঘা এলাকা জুড়ে সকাল সাতটা থেকে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কথিত আছে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপাধন্য রঘুনাথদাস গোস্বামীর বাড়ির কাছে, তাঁর পিতা, এক সময় গ্রামে মহোৎসব আয়োজন করেন এবং ওই সময় পরিবারের সকলকে মাছের বিভিন্ন পদ খাওয়ানো হয়।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭৯: কম খরচে বেশি মাছ উৎপাদনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ জরুরি
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৬: রানি কৈকেয়ীর অযৌক্তিক প্রস্তাব—রাজা দশরথের বিষাদ কি রাজনীতির কোনও পাঠ?
নিরামিষাশী গোস্বামীদের এই মৎস্য ভক্ষণ যেন বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ। সেই সময় থেকেই ওই গ্রামে বিভিন্ন মাছ এবং শাকসবজি বিক্রয় জোর শুরু হয়ে যায়। জায়গাটি সরস্বতী নদীর পাড়ে। শীতকালীন আমেজে এটি মহোৎসবের আকার ধারণ করে। এই অঞ্চলের সমস্ত অধিবাসী এই মেলার আনন্দ উপভোগ করেন। সেই থেকেই প্রতিবছর এই মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে। প্রত্যেকবারই বেশ কিছু অবাক করা মাছের সন্ধান এখানে পাওয়া যায়। যেমন কখনও ৩০ কেজি ওজনের ভেটকি, ২০ কেজি ওজনের কোমলাস্থির শংকর মাছ, বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি, মিষ্টি ও এবং নোনা জলে বিশাল আকারের চিতল, বোয়াল, ট্যাংরা প্রভৃতি আরও কত কি।
এছাড়াও জলাধারের বিশাল সাইজের কাতলা, রুই, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, নোনা জলের মধ্যে আছে ভাঙ্গন,গুর্জালি, মিল্ক ফিস আরও কত রকমের সামুদ্রিক মাছের পসরা নিয়ে বসেন দীঘা মোহনা এবং বিশাখাপত্তনামের বহু মৎস্য ব্যবসায়ী। এই মেলা থেকে, কত ধরণের যে রঙিন মাছের সন্ধান পাওয়া যায়, তা বোধহয় আর কোথাও একসঙ্গে দেখা যায় না।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
এই মহোৎসবে কম করে হলেও হাজার মানুষের সমাগম হয়। এই বার ঘণ্টার মধ্যে দূরদূরান্তের গ্রাম এবং শহরতলি থেকে বহু মানুষজন এসে সোৎসাহে নানান মাছ ক্রয় করতে পারেন। সরস্বতী নদী এখন সংস্কার করা হয়েছে। ফলে জায়গাটির সৌন্দর্য এখন অনেক বেড়ে গেছে।এর ফলে মেলাটিতে বেড়াতে যেতেও ভাল লাগে।
সারাদেশে কেবল মাছকে কেন্দ্র করে এই মেলা,সত্যিই অভিনবত্বের দাবি রাখে। এই মেলায় কত রকমের যে ছোট মাছ আসে সেগুলো না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের রাজ্যের তো বটেই প্রতিবেশী রাজ্য, অসম, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও বিহারের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট মাছ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী আসেন।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু
ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির
এ বারেও আশা করা যাচ্ছে, পশ্চিমঘাট অঞ্চল থেকেও বেশ কিছু ব্যবসায়ী রঙিন মাছ নিয়ে এখানে আসবেন। এই রঙিন মাছ ক্রমশই আমাদের রাজ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এখনও পর্যন্ত রঙিন মাছের বেচাকেনার দিক থেকে এমন কি চাষের ব্যাপারেও আমরা সমস্ত রাজ্যের চাইতে এগিয়ে আছি। শুধু কি মাছ? মাছ চাষের সঙ্গে একান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীও নিয়ে আসেন বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রকৃতপক্ষেই আদি সপ্তগ্রামে আয়োজিত এই মেলা মৎস্যপ্রেমীদের কাছে, একটি বিশেষ আকর্ষণের দাবি রাখে।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।