মাকড়সার জালের মতো অসংখ্য নদী খাল খাঁড়ি, অগুণতি আঁকাবাঁকা জলস্রোত ঘিরে রেখেছে সুন্দরবনকে। এই সমস্ত নদীতেই পাওয়া যায় প্রচুর মাছ। যদিও সব প্রজাতির মাছই খাদ্যগুণের নিরিখে খুব উঁচু মানের তা কিন্তু নয়। তা সত্ত্বেও মাছ বৈচিত্র্যৈ সুন্দরবন অনন্য সুন্দর।
এখানে একশোরও বেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। যার মধ্যে বেশ কিছু বিচিত্র মাছও আছে। সঙ্গে আছে নানা প্রজাতির চিংড়ি, কাঁকড়া, শুশুক এবং বিপন্ন তালিকাভুক্ত কচ্ছপ। আর আছে মজার এক উভচর মাছ ‘মাড স্কিপার’। স্থানীয় মানুষ একে বলে থাকেন, ‘মেনা মাছ’। ভাটার সময় সব নদীর চরে সুন্দরবনের সর্বত্রই দেখা যায় এদের। এরা পাখনাগুলিকে পায়ের মতো ব্যবহার করে হেঁটে বেড়াতে পারে। বিশেষ করে পুরুষ ‘মেনা মাছ’ শক্তিশালী হওয়ায় এরা লেজে ভর করে নাচতেও পারে। দারুন এক অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের কিছু মূল্যবান মাছ যেগুলো আজ লুপ্তপ্রায়
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৭: কুডার ছুঁয়ে শিরপুর
সুন্দরবনের মাছ হয়েও ‘মেনা মাছ’ জলের পৃষ্ঠতলের ওপরে মাথা তুলে বাতাস থেকে অক্সিজেন টেনে শ্বাসকার্য চালাতে পারে ভালো মতো। মৎস্য বিজ্ঞানে এদের পরিচিতি পেরিয়পথ্যালমাস্। এরা মুখ দিয়ে জল টেনে পাকস্থলীতে প্রবেশ করানোর সময় সেই জলের দ্রবীভূত অক্সিজেন যেমন টেনে নেয় তেমনি জলে মিশে থাকা বিভিন্ন প্রাণীকণা এদের পুষ্টির যোগান দেয়।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?
স্বাদে-আহ্লাদে: সকালে জলখাবারে থাক নতুনত্ব, বানিয়ে ফেলুন সুস্বাদু পালক পনির পরোটা
এদের দেখতে সরু লম্বাটে। সামনের দিক থেকে দেখলে মাথাটি কিছুটা ব্যাঙের মতো লাগে। মাথার ওপরে দুটি বড় পুঁতির মতো জ্বলজ্বলে চোখ। বিভিন্ন মাছ কাঁকড়া, পোকামাকড়ের ডিম, কীট, বিভিন্ন প্রাণীকণা এদের পছন্দের খাবার। প্রজননের সময় পুরুষদের পাখনার রং এবং শরীরের ঔজ্জ্বল্যও দর্শনীয় হয়। এক পুরুষ মাড স্কিপারকে অন্য পুরুষ মাড স্কিপারের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখা যায় প্রায়ই, বিশেষ করে প্রজননকালে। পুরুষরা কিন্তু পেরেন্টাল কেয়ার বা সন্তান-প্রতিপালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। সেই সঙ্গে নিজের গর্তে এই সন্তানদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিষ্ঠাভরে পালন করে।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩০: গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মনের বাঁক যাবে তো?” ঠাকুর বললেন, “যাবে, ঠিক যাবে”
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে, সামনে পরীক্ষা? চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য রইল ১০টি জরুরি পরামর্শ
শুধু এই বৈশিষ্ট্যের জন্যেই মাড স্কিপার উল্লেখযোগ্য। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদের বায়বীয় মূলের গায়ে লেগে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির অণুজীব এদের পছন্দের খাবার। ম্যানগ্রোভ ঠাসাঠাসি ঝোপঝাড়ে জোয়ারের জল যখন তীব্র ভাবে বয়ে যায়, তখন সেই ডালপালার ওপরেও আশ্রয় নেয় এই মাছ। বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিভিন্ন মাছেদের খাবার এবং আশ্রয়স্থল। তাই এদের বাঁচিয়ে রাখা জীববৈচিত্র্যের দিক থেকেও খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
ছবি: তুষার গায়েন
ছবি: তুষার গায়েন
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।