মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে, মেলামেশার বৈচিত্রের বলে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে যায় সেই সংস্কৃতি পালনকারী মানুষরাই। পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া সবই সংস্কৃতির অধীন।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হল চিতল মাছ। এই মাছ আমাদের কাছে বা বাঙালিদের কাছে অতীব প্রিয়। সারা বছরই এবং সর্বত্রই এই মাছের চাহিদা থাকে। এই মাছের চাহিদা থাকার কারণে এর ঘাটতি দেখা যায়। যার ফলে এর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। মিষ্টি জলের নানা প্রজাতির মধ্যে চিতল মাছ এক নীলমণির মতো। এই মাছ মূলত নদীর মাছ হলেও আমাদের রাজ্যের পুকুর, খাল ও বিলের প্রকৃতি ও পরিবেশ শুধু যে তার বাসোপযোগী তাই নয়, চাষেরও অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কার্প জাতীয় মাছের সঙ্গে মিশ্রভাবে চাষ বা এককভাবে চাষ করাও সম্ভব। এই মাছ পুকুরের পোকা-মাকড় খেয়ে পুকুরের জলকে পরিষ্কার রাখে।
জলজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার প্রিয় এই মাছটির সংরক্ষণ ও এর সঙ্গে জোগান সুগম করা ছাড়াও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় কিছুটা হলে নিশ্চিত হতে পারে।
এই মাছটি শুধু আমাদের রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই রাজ্যের বাইরেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এই মাছ উত্তরপ্রদেশের ‘রাজ্য মাছ’ হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘চিতলা চিতলা’। এই মাছ উত্তরপ্রদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কারণ এরকম দেখা গেছে যে বাড়িতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এলে তাঁকে সমাদর করা হয় এই চিতল মাছের রেসিপি দিয়ে।
চিতল মাছের বৈশিষ্ট্য
● এই মাছের দেহ উভয় দিকেই চ্যাপটা হয়।
● এদের মাথা ও শরীর ছোট ছোট আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে।
● পৃষ্ঠদেশ গাঢ় কালো বর্ণের এবং পেট উজ্জ্বল রুপালি বর্ণের হয়।
● এটি সাধারণত ১০০-১২০ সেমি দৈর্ঘ্যের হয়।
● এদের মাথা দেহের তুলনায় ছোট হয়।
● পৃষ্ঠপাখনা রয়েছে, পুচ্ছপাখনা, পায়ুপাখনার সঙ্গে যুক্ত। সেখানে ৪টি গোলাকার সাদা স্পট দেখা যায়।
● শ্রোণী পাখনা লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত।
চিতল মাছের খাবার
স্বভাবে শিকারি-ছোট মাছ, পোকামাকড় পছন্দের খাবার হলেও ফিশমিল যুক্ত তৈরি করা পরিপূরক খাবার গ্রহণে এর কোনও বাঁধা নেই।
প্রজননের সময়
বর্ষার মরশুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে এই মাছ ডিম পাড়ে। এদের ডিমগুলো গোলাকার ও হলুদ রঙের হয়। খুব আঠালো ডিম। এগুলি সংগ্রহ করতে বিশেষ কিছু ব্যবস্থার অবলম্বন করার দরকার হয়। স্ত্রী ও পুরুষ মাছ এই ডিম পাহারা দেয়। ডিমের পরিমাণ সাধারণত বেশ কম থাকে। ডিম ফুটতে ও লাভা বেরোতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
চিতল মাছের গুণাগুণ
চিতল মাছে পটাশিয়াম খুবই বেশি থাকে। এই মাছের মধ্যে দীর্ঘ শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি খুব ভালো। দীর্ঘ শৃঙ্খল পুফা ফ্যাটি অ্যাসিড বা আমাদের প্রয়োজনীয় পুফা ফ্যাটি অ্যাসিড এই মাছে বর্তমান। ক্যালশিয়াম এবং জিঙ্কে সমৃদ্ধ এই মাছ। এই মাছ থেকে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাতব মৌল পেতে পারি। যেমন, জিঙ্ক, ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস। এই জিঙ্কের উপস্থিতি অন্যান্য মাছে সেরকমভাবে দেখা যায় না, কিন্তু এই মাছে তা থাকে।
অন্যান্য মাছে যে ধরনের প্রোটিন থাকে সেই তুলনায় এই মাছে প্রোটিন সামান্য হলেও বেশি রয়েছে। স্বাদের দিক থেকে এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দুই বাংলার মানুষের কাছে অতীব প্রিয় এই মাছ। সেই কারণেই হয়তো এই মাছকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রেসিপি রয়েছে। এই মাছের পেটিকে কেন্দ্র করে যে ধরনের রেসিপি রয়েছে অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। চিতল মাছ দিয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পদ হল ‘চিতল মাছের মুইঠ্যা’।
চিতল মাছের চাষ
এখনও পর্যন্ত কয়েকটি ফার্মে চিতলের প্রণোদিত প্রজনন করানো হয় গোনাডোট্রপিন হরমোন প্রয়োগ করে। এই ইনজেকশন প্রয়োগের ১৫-২৬ ঘণ্টা পর এদের ডিম ছাড়া শুরু হয় ও আঠালো ডিমগুলিকে ট্যাঙ্কে রাখা হয়। জলের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং জলের প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ২৫০-৩০০ মিলিমিটার রাখা হয়। লাভার পরিমাপ সাধারণত ১ সেমি যা ২০-২২ দিন পরে ৩ সেমির মতো হয়ে যায়। ডিম ফুটে বেরোনোর সাত দিন পর্যন্ত কুসুমথলি দশা থাকে। এই সময় মাথা নীচের দিকে ঝোঁকানো ছাড়া আর বিশেষ কিছু পরিলক্ষিত হয় না। এর পরের অবস্থাটি প্রি-ফ্লেকশন দশা নামেও পরিচিত। কুসুমথলি নিঃশেষিত অবস্থা দৈর্ঘ্যে ১২ মিমি, চোখের লেন্স দেখা যায়, মুখ উন্মুক্ত হয়। এই অবস্থায় এরা বাইরে থেকে খাবার নেওয়া শুরু করে ও আরও কয়েকদিনের মধ্যেই পায়ুপাখনা ও পুচ্ছপাখনা আলাদা হয়।
এরপর চলে ফ্লেক্সেশন দশা। ডিম ফোটার পর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। কেটোকর্ড ছোট হয় ক্রমশই, পাখনার রঞ্জিতকরণও শুরু হয়। এই পর্যায়ে দ্রুত বৃদ্ধি নজরে পড়ে। আঁশ তৈরি হতে আরও পনেরো দিন সময় লাগে। জলের তাপমাত্রা, পি এইচ প্রাণীকণার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে এই সময়গুলি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
যাঁরা পোনা মাছের সঙ্গে চিতল মাছ চাষ করতে ইচ্ছুক তাঁরা যেন বেশ কিছু সময় আগে পুকুরে পোনা মজুত করেন এবং তা প্রায় দু মাস মতো হলে তবেই কিন্তু চিতল মাছ ছাড়তে হবে।
এই মাছকে সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য। আগামী দিনেও এই মাছ যাতে থাকে তা দেখা আমাদের দায়িত্ব। এই মাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে এরা যাতে বংশবৃদ্ধি করতে পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হল চিতল মাছ। এই মাছ আমাদের কাছে বা বাঙালিদের কাছে অতীব প্রিয়। সারা বছরই এবং সর্বত্রই এই মাছের চাহিদা থাকে। এই মাছের চাহিদা থাকার কারণে এর ঘাটতি দেখা যায়। যার ফলে এর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। মিষ্টি জলের নানা প্রজাতির মধ্যে চিতল মাছ এক নীলমণির মতো। এই মাছ মূলত নদীর মাছ হলেও আমাদের রাজ্যের পুকুর, খাল ও বিলের প্রকৃতি ও পরিবেশ শুধু যে তার বাসোপযোগী তাই নয়, চাষেরও অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। কার্প জাতীয় মাছের সঙ্গে মিশ্রভাবে চাষ বা এককভাবে চাষ করাও সম্ভব। এই মাছ পুকুরের পোকা-মাকড় খেয়ে পুকুরের জলকে পরিষ্কার রাখে।
জলজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার প্রিয় এই মাছটির সংরক্ষণ ও এর সঙ্গে জোগান সুগম করা ছাড়াও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় কিছুটা হলে নিশ্চিত হতে পারে।
এই মাছটি শুধু আমাদের রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই রাজ্যের বাইরেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এই মাছ উত্তরপ্রদেশের ‘রাজ্য মাছ’ হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘চিতলা চিতলা’। এই মাছ উত্তরপ্রদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। কারণ এরকম দেখা গেছে যে বাড়িতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এলে তাঁকে সমাদর করা হয় এই চিতল মাছের রেসিপি দিয়ে।
স্বভাবে শিকারি-ছোট মাছ, পোকামাকড় পছন্দের খাবার হলেও ফিশমিল যুক্ত তৈরি করা পরিপূরক খাবার গ্রহণে এর কোনও বাঁধা নেই।
বর্ষার মরশুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে এই মাছ ডিম পাড়ে। এদের ডিমগুলো গোলাকার ও হলুদ রঙের হয়। খুব আঠালো ডিম। এগুলি সংগ্রহ করতে বিশেষ কিছু ব্যবস্থার অবলম্বন করার দরকার হয়। স্ত্রী ও পুরুষ মাছ এই ডিম পাহারা দেয়। ডিমের পরিমাণ সাধারণত বেশ কম থাকে। ডিম ফুটতে ও লাভা বেরোতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
চিতল মাছে পটাশিয়াম খুবই বেশি থাকে। এই মাছের মধ্যে দীর্ঘ শৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি খুব ভালো। দীর্ঘ শৃঙ্খল পুফা ফ্যাটি অ্যাসিড বা আমাদের প্রয়োজনীয় পুফা ফ্যাটি অ্যাসিড এই মাছে বর্তমান। ক্যালশিয়াম এবং জিঙ্কে সমৃদ্ধ এই মাছ। এই মাছ থেকে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাতব মৌল পেতে পারি। যেমন, জিঙ্ক, ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাস। এই জিঙ্কের উপস্থিতি অন্যান্য মাছে সেরকমভাবে দেখা যায় না, কিন্তু এই মাছে তা থাকে।
অন্যান্য মাছে যে ধরনের প্রোটিন থাকে সেই তুলনায় এই মাছে প্রোটিন সামান্য হলেও বেশি রয়েছে। স্বাদের দিক থেকে এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দুই বাংলার মানুষের কাছে অতীব প্রিয় এই মাছ। সেই কারণেই হয়তো এই মাছকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রেসিপি রয়েছে। এই মাছের পেটিকে কেন্দ্র করে যে ধরনের রেসিপি রয়েছে অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। চিতল মাছ দিয়ে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় পদ হল ‘চিতল মাছের মুইঠ্যা’।
এখনও পর্যন্ত কয়েকটি ফার্মে চিতলের প্রণোদিত প্রজনন করানো হয় গোনাডোট্রপিন হরমোন প্রয়োগ করে। এই ইনজেকশন প্রয়োগের ১৫-২৬ ঘণ্টা পর এদের ডিম ছাড়া শুরু হয় ও আঠালো ডিমগুলিকে ট্যাঙ্কে রাখা হয়। জলের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং জলের প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ২৫০-৩০০ মিলিমিটার রাখা হয়। লাভার পরিমাপ সাধারণত ১ সেমি যা ২০-২২ দিন পরে ৩ সেমির মতো হয়ে যায়। ডিম ফুটে বেরোনোর সাত দিন পর্যন্ত কুসুমথলি দশা থাকে। এই সময় মাথা নীচের দিকে ঝোঁকানো ছাড়া আর বিশেষ কিছু পরিলক্ষিত হয় না। এর পরের অবস্থাটি প্রি-ফ্লেকশন দশা নামেও পরিচিত। কুসুমথলি নিঃশেষিত অবস্থা দৈর্ঘ্যে ১২ মিমি, চোখের লেন্স দেখা যায়, মুখ উন্মুক্ত হয়। এই অবস্থায় এরা বাইরে থেকে খাবার নেওয়া শুরু করে ও আরও কয়েকদিনের মধ্যেই পায়ুপাখনা ও পুচ্ছপাখনা আলাদা হয়।
এরপর চলে ফ্লেক্সেশন দশা। ডিম ফোটার পর তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। কেটোকর্ড ছোট হয় ক্রমশই, পাখনার রঞ্জিতকরণও শুরু হয়। এই পর্যায়ে দ্রুত বৃদ্ধি নজরে পড়ে। আঁশ তৈরি হতে আরও পনেরো দিন সময় লাগে। জলের তাপমাত্রা, পি এইচ প্রাণীকণার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে এই সময়গুলি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
যাঁরা পোনা মাছের সঙ্গে চিতল মাছ চাষ করতে ইচ্ছুক তাঁরা যেন বেশ কিছু সময় আগে পুকুরে পোনা মজুত করেন এবং তা প্রায় দু মাস মতো হলে তবেই কিন্তু চিতল মাছ ছাড়তে হবে।
এই মাছকে সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য। আগামী দিনেও এই মাছ যাতে থাকে তা দেখা আমাদের দায়িত্ব। এই মাছের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে এরা যাতে বংশবৃদ্ধি করতে পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।