বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অন্য সকল প্রাণীর মতো মাছেরও স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রজনন ইত্যাদির জন্য নিয়মিত পুষ্টি প্রয়োজন। আর সঠিক পুষ্টির যোগান হলে তবেই তো পাওয়া যাবে মাছের ভাল ফলন। প্রকৃতিতে, মাছ, জলে থাকা উদ্ভিদকণা এবং প্রাণীকণা থেকে পুষ্টি পায়। এই সীমিত ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তাই প্রয়োজন হয়, বাইরে থেকে যোগান দেওয়া খাবার।
আবার ব্যবসায়িকভাবে যাঁরা মাছ চাষ করছেন তাঁদের ক্ষেত্রে পরিপূরক খাওয়ার যোগান দেওয়া সেখানে অত্যন্ত জরুরি। আর এই খাবার যদি খামারেই বানিয়ে নেওয়া যায় তাতে সস্তাও হয় খাঁটিও হয়। খাবারের উপাদান সামগ্রীর উৎস, স্থানীয় ও সহজলভ্য হওয়া দরকার। অবশ্যই তাদের পুষ্টিগত গুণমান ভালো হওয়া দরকার। বিভিন্ন উপাদান, যেমন, নানা ধরনের তৈলবীজের খোল, চালের কুঁড়ো, চিড়ার গুঁড়ো, ভুট্টাছাতু, বিভিন্ন ডালের খোসা, কলমি পাতা বা মরশুমি শাক পাতা, জোয়ার গুঁড়ো, খনিজ লবণ, ভিটামিন মিশ্রণ, চিটাগুড় ও আরও কত কি আছে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮০: পয়লা মাঘে সরস্বতী নদীর পাড়ে ৫০০ বছরের জমজমাট মাছ মেলা কখনও দেখেছেন?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

এ ছাড়া অবশ্য অনেকে মাছকে আকৃষ্ট করবার জন্য, বিটের নির্যাস, পালং-এর নির্যাস, কমলালেবুর খোসাগুঁড়ো, মেথি ভাজা, আম আদার গুঁড়ো ইত্যাদি দেওয়া হয়। মাছের বয়স, ঋতু ও চাহিদা অনুযায়ী খাবারের মাত্রা নির্ধারণ করতে হয়। জলের তাপমাত্রার একটা ভূমিকা আছে। ১০০ কেজি একটি মিশ্র পরিপূরক মাছের খাবার বানাতে যদি মনে করি, ব্যবহার করা হবে ৪০ কিলো চালের কুঁড়ো, বাদাম বা তিল বা সর্ষের খোল ৩০ কেজি, ভুট্টা ছাতু ১০ কেজি, সয়াবিন গুঁড়ো ১০ কেজি,ভোজ্য সাদা তেল ২ কেজি, ভিটামিন খনিজ মিশ্রণ ১ কেজি, মেথি আম আদা এবং খাবার লবণ সমেত ১ কেজি, আটা কিংবা সাবু ২ কেজি, চিটা গুড় ২ কেজি, কলমি পাতার নির্যাস ২ কেজি, নেওয়া হয়।
শ্রম, সময় ও যন্ত্রপাতির খরচ বাদ দিয়ে যদি হিসাব করা যায় তাহলে দেখা যাবে কেজি পিছু দাম হবে ৩০ টাকা বা তার সামান্য কম। যদি মনে করা যায় ২ কেজি এই খাবার প্রয়োগের ফলে মাছের ওজন ১ কেজি বৃদ্ধি পাবে তাহলেও ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে খাবারের খরচ ৬০ টাকা। অন্যান্য যাবতীয় খরচ ৩০ টাকা ধরা হয় তাহলেও ১ কেজি মাছের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৯০ টাকা। এতে মাছ উৎপাদক যথেষ্ট ভাল লাভ আশা করতে পারেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির মাছের যে সমস্ত খাবার পাওয়া যায় তার সর্বনিম্ন দাম কিলো প্রতি ৬০ টাকা। তুলনামূলকভাবে নিজেদের তৈরি খাবার ব্যবহারে আয় দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব, বাজারে প্রাপ্ত খাবারের তুলনায়। মাছের খাবার তৈরিকে ব্যবসা হিসেবে যদি নেওয়া যায় তবে, এর থেকে শুধু যে কর্মসংস্থান হতে পারে তাই নয়, খাদ্যপ্রদান পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগের ফলে বাড়তে পারে খাবারের সদ্ব্যবহার ও মাছের উচ্চ ফলন।
এতে সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদনের খরচও এতে কমতে পারে। আবার বাজারে মাছের যোগানও সারা বছর ধরে অব্যাহত থাকতে পারে। একটি ছকের মাধ্যমে দেখানো হল কীভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাছের খাবার তৈরির পদ্ধতিটিকে এগোনো যায়। আমাদের রাজ্যে মাছের খাবারের বিশেষ চাহিদা আছে এবং সেই তুলনায় যোগানও যথেষ্ট নয়। সিংহভাগ মাছের খাবার আসে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। তাই এই উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আরও পড়ুন:
বাঙালির খাদ্য তালিকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মাছ। তাই বোধহয় নিশ্চিত ভাবে বলা যায় গ্রামে, মফস্বলে, শহরে, সর্বত্রই মাছচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে আমরা যদি মাছের যোগান অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর হই। তবে বহু ছেলে মেয়েরা তাদের আয়ের সুনিশ্চিত বিকল্প পথ খুঁজে পাবেন। মাছচাষে স্বনির্ভর হবে আমাদের রাজ্য এবং বাজারে মাছের কোন ঘাটতি থাকবে না, অন্য কোনও রাজ্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না আমাদের।

ছবি: লেখক।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content