শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বাটা মাছ। ছবি : লেখক

বাঙালির জীবনে যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র পুরাণগাথা থাকুক না কেন, একটি পুরাণ ছাড়া কিন্তু বাঙালিজীবন এক্কেবারে অচল, আর সেটি হল বাঙালির মৎস্যপুরাণ। এই একটি পুরাণই দেশ-বিদেশে বাঙালির মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের মৎস্যপুরাণে মাছের যাবতীয় পুরাণগাথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে থাকবেন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়

পর্ব – ১

মাছ খেতে ভালোবাসেন না এমন বাঙালি মেলা ভার। ছুটির দিনে থলে হাতে মাছের বাজারে ভিড় জমাতে বাঙালির মতো ওস্তাদ আর কেই-বা আছে, কিন্তু আপনি যে মাছ কেনার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন সেই মাছই আদৌ কিনে আনছেন তো? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সূত্রে অনেক মানুষকে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে দেখেছি৷ তাঁরা মাছ সঠিকভাবে চিনতে পারছেন না, যার ফলে অনেক সময়ই কিন্তু মাছবিক্রেতারা একটি মাছের জায়গায় অনেকটা সেইরকম দেখতে হয়তো বা সেই জাতেরই কোনও মাছ ক্রেতাকে দিচ্ছেন কিন্তু যে মাছটি দিচ্ছেন সেটি হয়তো হাইব্রিড কোনও ব্রিড যা গুণগত মানের দিক থেকেও অনেকটা কম পুষ্টিকর এবং দামের ক্ষেত্রেও হয়তো অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। সাধারণত রুই-কাতলা চেনার ক্ষেত্রে খুব একটা ভুল করেন না। ভুল হয় যে মাছগুলো প্রতিদিন মানুষ কেনেন না, সেই সমস্ত মাছ তাঁরা চিনে উঠতে পারেন না। এই রকম এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয় মাগুর মাছ কেনার সময়।

বাজারে মাগুর মাছ কিনতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই দেশি মাগুরের নাম করে হাইব্রিড মাগুর বা রাক্ষুসে মাগুর মাছ বিক্রেতারা ক্রেতাদের দিয়ে দেন এবং ঠিকমতো চিনতে না পারার ফলে ক্রেতারা সেই মাছগুলিই দেশি মাগুর মনে করে কিনে নেন। এই ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠে আসবে তাহলে এই দুই প্রকার মাছের মধ্যে এমন কী পার্থক্য রয়েছে যা দেখলে বোঝা যাবে এটা রাক্ষুসে মাগুর বা হাইব্রিড মাগুর আর এটা হল দেশি মাগুর? সত্যি কথা বলতে গেলে যথাযথভাবে মাছ চিনতে হলে প্রথমেই আপনাকে মাছে চোখ দেখে বোঝার অভ্যেস তৈরি করা যে মাছগুলির মধ্যে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পার্থক্যগুলি রয়েছে সেই পার্থক্যগুলি ঠিক কীরকম হতে পারে। সেভাবে বলতে গেলে এই পার্থক্য ভাষায় লিখে বোঝানো অত্যন্ত কঠিন কাজ, প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে বলা যেতে পারে যে হাইব্রিড মাগুর বা রাক্ষুসে মাগুর আকারে একটু বড় হয় এবং দেশি মাগুর আকারে একটু ছোট হয়ে থাকে।

আপনি ঠিকমতো মাছ চিনতে না পারার ফলে খানিকটা কম দাম দিয়ে হাইব্রিড মাগুর হয়তো কিনে নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু মনে রাখবেন এতে আপনার টাকা কিছুটা সাশ্রয় হলেও গুণমান বা পুষ্টিগত দিক থেকে আপনি পুরোপুরি একশো শতাংশ পুষ্টি তো পাচ্ছেনই না, পাশাপাশি হাইব্রিড মাছ দীর্ঘদিন ধরে খেলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীনও হতে হবে।
কেবল মাগুর নয় পারশে মাছ কেনার সময়ও কিন্তু আপনাকে সাবধান থাকতে হবে। পারশে মাছ আকারে ছোট এবং দাম বেশি, পাশাপাশি ভাঙন মাছ ছোট অবস্থায় অনেকটা পারশের মতো দেখতে৷ তাই বিক্রেতারা অনেক সময়েই এই মাছটিকে পারশে মাছের নাম করে বিক্রি করে দেন৷ সুতরাং কম দাম দিয়ে পারশে ভেবে আপনি ভাঙন মাছ কিনে নিয়ে গেলেন অথচ পারশের যথাযথ স্বাদটুকুও আস্বাদন করতে পারলেন না।

জাপানি পুঁটির নাম তো অনেকেই শুনেছেন? কিন্তু জানেন কি জাপানি পুঁটি বলে আদতে কোনও মাছের অস্তিত্বই নেই। এই জাপানি পুঁটি আসলে জাভা পুঁটি যার উৎপত্তি ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে৷ ফলে এই নামকরণ করা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে কোন এক অজানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই জাভা পুঁটির লোকমুখে নাম হয়ে উঠেছে জাপানি পুঁটি। জাভা পুঁটি অথবা জাপানি পুঁটি এবং সরল পুঁটি অনেকটা একরকম দেখতে হওয়ায় চিনতে অসুবিধা হয়। এছাড়া নীলনদ থেকে উৎপাদিত নাইলোটিকা যা চলতি কথায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নাইলন্টিকা, সেই নাইলোটিকা এবং তেলাপিয়া মাছ চেনার ক্ষেত্রেও ক্রেতারা সমস্যায় পড়েন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তেলাপিয়া কিনতে গিয়ে নাইলোটিকা কিনে নিয়ে যান।

আসলে মাছ চেনার ক্ষেত্রে বাঙালির এই সমস্যা বহুদিনের। হয়তো মাছ খেতে আমরা যতটা ভালোবাসি ততটা ভালোবাসা বা বলা ভালো রসনাতৃপ্তির বাইরে গিয়ে মাছের প্রতি আলাদা করে তেমন একটা অনুসন্ধিৎসা বা আগ্রহ কোনওটাই তৈরি হয়নি। এর একটি অন্যতম কারণ কিন্তু আমাদের এখানকার মাছের বাজারগুলির নোংরা পরিবেশ। কোনও বিষয়ের প্রতিই ভালোবাসা বা আগ্রহ তৈরি হওয়া সম্ভব নয় যদি না তার সঙ্গে আপনি পর্যাপ্ত সময় কাটান, কিন্তু আমাদের শহরে বা দেশের অন্যান্য মাছের বাজারগুলিতে, যেখানে সাধারণ মানুষ নিয়মিত যান মাছ কিনতে সেখানকার পরিবেশের মার্জনা করার কোনওরকম উদ্যোগ সরকারি তরফ থেকে বা পঞ্চায়েতের তরফ থেকে দেখা যায় না, ফলত মানুষ মাছের বাজার থেকে মাছ কিনে বেরিয়ে আসতে পারলে বাঁচে। তাই মাছের সঙ্গে রসনার বাইরে গিয়ে আলাদা করে কোনও সখ্য তৈরি না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ কিন্তু মাছ বাজারের অপরিমার্জিত পরিবেশও বটে।

মাছ খাওয়া নিয়ে বাঙালির যে চিরকালীন এক গভীর আবেগ ও উৎসাহ রয়েছে তার বিন্দুমাত্রও যদি মাছের অন্যান্য যাবতীয় খুঁটিনাটি নিয়ে থাকত তাহলে কিন্তু আজ এই ভুল মাছ চিনে অহরহ ঠকে যাওয়ার হাত থেকে বাঙালি নিজেই নিজেকে বাঁচাতে পারত। মাছের সঙ্গে বাঙালির সখ্য তৈরি হওয়াটা কেবল আবশ্যক নয়, উচিতও আর এই ঔচিত্যের জায়গাটাকে আরও পাকাপোক্ত করে তোলার জন্য কিন্তু উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের এবং আমাদের পারিপার্শ্বের সমস্ত মানুষজনকে। এই উদ্যোগই কিন্তু একমাত্র আমাদের এক সুস্থ-সুন্দর পরিবেশে যথাযথভাবে মাছ কেনার এক সৎ ও সুনিশ্চিত পন্থা তৈরি করে দিতে পারে।

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস

 


Skip to content