সেচের প্রয়োজনে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কারণে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পৃথিবীর সর্বত্রই এবং স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দেওয়ার প্রচলন আছে। এই নদীবাঁধের (ড্যাম বা ব্যারেজ) প্রয়োজনীয়তা তাই অনস্বীকার্য। এখন নদীতে তো মাছ থাকেই। আর এই বাঁধ দেওয়ার ফলে জলে তাদের স্বাভাবিক বিচরণ খানিকটা তো বিঘ্নিত হয়ই, কখনও প্রবাহমান এইসব জলাশয়ে জৈব শৃঙ্খলেও কিছুটা পরিবর্তন হয়। হয়তো নদীর স্থায়ী মাছগুলি এই সমস্ত প্রভাব কাটিয়ে উঠলেও উঠতে পারে।
সমস্যা হয় অন্য মাছেদের বিশেষ করে পরিযায়ী মাছের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে একমাত্র পরিযায়ী মাছ হল ইলিশ। জীবনের অধিকাংশ সময়টাই সমুদ্রে, বঙ্গোপসাগরে কাটালেও নদীবক্ষে তাকে আসতেই হয়, বর্ষার আগমনে। এরপর কয়েক মাস নদীর মিষ্টি জলেই এরা থাকে। ডিম দেয়, ধীরে ধীরে শিশু ইলিশ ক্রমে খোকা ইলিশে পরিণত হয় এবং লবণের সহনশীলতা অর্জন করে। তারপর মোহনার স্বল্প লবণাক্ত জলে কিছুদিন কাটিয়ে আবার সমুদ্রপথে অগ্রসর হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকে ও পরে নদী বক্ষে অগ্রসর হয় প্রজনন ক্রিয়ার তাগিদে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?
প্রাকৃতিক খাদ্যের সন্ধানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে নিজেদের সামলে নিতেও এরা পরিভ্রমণ করে থাকে সমুদ্র থেকে নদীতে। এটাই মাইগ্রেশন। এই চলাচল যদি ব্যাহত হয় কোনওভাবে তাহলে নিশ্চিতরূপেই তাদের প্রজননের ওপর এর প্রভাব পড়বে এবং এই মাছের যোগানও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯: নুনিয়া
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১২: বাইরের দরজা ঠেলে দু’ জন মাঝবয়সী অচেনা লোক ঢুকে পড়লেন
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন
সাম্প্রতিককালে ইলিশ নিয়ে এইরকমই আমাদের অভিজ্ঞতা। আগে যখন বাঁধ নির্মাণ হয়েছিল তখন হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, বাঁধ বিশেষজ্ঞ, দেশের নীতি-নির্ধারক আধিকারিকগণ এই দিকটি নিয়ে হয়তো তেমন কোন ভাবনাচিন্তা করেননি। যে কারণে আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় নির্মিত গঙ্গার উপরে ফারাক্কায় ২০০০ মিটারের কিছু বেশি দৈর্ঘ্যের বাঁধটি তৈরি হয় এবং তা চালু হয় ১৯৭৫ সালে,তার মূল উদ্দেশ্য ছিল জলপ্রবাহের একটি অংশকে হুগলিনদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে সদা সজীব রাখা।
আরও পড়ুন:
বিমল মিত্র: এক অসামান্য প্রতিভার অবমূল্যায়ন
মাছের ডিম খেতে ভালোবাসেন? তাহলে ঝটপট তৈরি করে ফেলুন মাছের ডিমের ঝুড়ো
এই শিক্ষকের ছাত্ররা তাদের জীবন নিয়ে খেলেছিল
এনটিপিসি দ্বারা পরিচালিত প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ফারাক্কা সুপার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলও এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। একশোরও কিছু বেশি গেটবিশিষ্ট বিরাট এই বাঁধটির ওপর দিয়ে গিয়েছে রেলপথ এবং ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। বাধাহীন ভাবে এই বাঁধ থাকা সত্ত্বেও এক ধরনের পরিকাঠামো নির্মাণের সাহায্যে মাছের চলাচল অব্যাহত রাখার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। এই রকম পরিকাঠামোকে সাধারণত ফিশ পাস বা ফিস ল্যাডার এবং ফিস লিফ্টও বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:
পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৪: সমাজে নারীর বন্ধ্যাত্ব এবং পিতৃতান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা
এটি এমনই এক পরিকাঠামো যা কোন জলাশয়ে কৃত্রিম বা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূর করে মাছ চলাচলের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। বাঁধ দেওয়ার ফলে দু’ দিকে যে জলাশয় সৃষ্ট হয় তাতে এর মাধ্যমে প্রবাহমান জলস্রোত নিয়ন্ত্রণ করা হয় এমন ভাবে যে মাছ এই নিয়ন্ত্রিত স্রোতধারায় ক্লান্তিহীনভাবে একদিক থেকে অন্যদিকে যাতায়াত করতে পারে। ফারাক্কাতে এই রকম এক ব্যবস্থা সম্প্রতি নেওয়া হয়েছে, যার দায়িত্বে রয়েছেন ব্যারাকপুরে অবস্থিত ভারত সরকারের সংস্থা আইসিএআর /সিআইএফআরআই-এর পরিচালক এবং এই সংক্রান্ত বিজ্ঞানীসহকর্মীগণ।
অনুরূপভাবে তিস্তা নদীতেও স্নো ট্রাউটের অবাধ চলাচলের জন্যেও এই ব্যবস্থা শীঘ্রই কার্যকরী হবে। সেখানেও দায়িত্বে রয়েছেন ব্যারাকপুরের এই একই সংস্থা। আশা করা যায় ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে পরিযায়ী মাছ অভ্যস্ত হয়ে গেলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে। এর ফলে ইলিশের প্রাপ্তিও আমাদের কাছে অনেক সহজ হবে এবং বাজারে আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় ইলিশ দেখতে পাব।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।