মাছেদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের এক অনুপম দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। যেমন একাধিক প্রজাতির মাছ একই সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে ও সাবলীলভাবে জলে থাকবে, কেউ কারও পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে না। অন্যের খাবারে কারও ভাগ বসানোর প্রশ্ন নেই, কোন প্রতিযোগিতাও নেই, টিকে থাকার জন্য পছন্দের জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই যে যার মতো সীমাবদ্ধ থাকবে ও আনন্দে বেড়ে উঠবে—এমন একটি মাছচাষ পদ্ধতি প্রয়োজন। এটি একমাত্র মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতেই সম্ভব।
এই যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এটিকে মূলধন করেই নানান রকমের মাছের একত্রিত চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে তা একটানা চলে আসছে। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু না কিছু উদ্ভাবনী প্রয়োগ হয়েছে, ফলে ফলন বেড়েছে আর বেড়েছে মাছের বৈচিত্রের সমাহারও। এর আগে মিষ্টি জলের মাছের এই মিশ্র চাষ তেমন ভাবে জানা ছিল না। ভারতীয় মেজর কার্প বা পোনা, কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবোস ও সঙ্গে বিদেশি কার্প-গ্রাসকার্প, রুপোলি রুই বা সিলভারকার্প এবং সাইপ্রিনাস বা কমন কার্প মজুতপুকুরে এই সব মাছ সঠিক সংখ্যায় ও অনুপাতে ছাড়া হয়। আর এর ফলে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, মূলত সালোকসংশ্লেষণের কারণে উৎপন্ন খাদ্যকণা যেমন উদ্ভিদ ও প্রাণীকণারচমৎকার সদ্ব্যবহার হয়।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৮: ড. হীরালাল চৌধুরীর আবিষ্কার আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’
মাছের খাওয়ার জন্যে জলের উপরিস্তরে যথাক্রমে সিলভার কার্প ও কাতলা মাছের খাদ্য যথাক্রমে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণা। কিছুটা পুকুরের ধারের দিকে মাছের খাবারের জন্য তেমন রুই, সেইসঙ্গে দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায় রুইয়েরই এক রকমফের ফিমব্রিয়েটাসর জন্যে খাদ্য হিসেবে থাকে পেরিফাইটন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শৈবালকণা। মৃগেল, কালবোস ও সাইপ্রিনাসের স্থান যেহেতু পুকুরের তলদেশে তাই প্রাকৃতিক খাবার থাকে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। সেখানে একাধিক প্রজাতির মাছ অনায়াসে থাকতে পারে। এমনকি এর সঙ্গে বাটা মাছও যোগ দিতে পারে।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’
গ্রাস কার্প জলের ওপরের স্তরে ও মাঝের স্তরে থাকা জলজ পানা, শ্যাওলা, ঝাঁঝি ও নিচের মাছ নানান রকম জলজ প্রাণীকন্যা, পচন ধরা উদ্ভিদের অংশবিশেষ, কাদামাটিতে থাকা পোকামাকড়ের ডিম, শূট কীট, মূক কীট ও আরও কত কি খেয়ে থাকে। এই সব প্রজাতির চাষের অনুপাত সাধারণত, কাতলা চল্লিশ শতাংশ, রুই পঁচিশ শতাংশ, গ্রাসকার্প পাঁচ শতাংশ, সাইবপ্রিনাস, মৃগেল, কালবোস, বাটা মিলিতভাবে তিরিশ শতাংশ। চাষের ক্ষেত্রে এই মাছেদের অনুপাত নির্ভর করে পুকুরের আয়তন ও জলের গভীরতার ওপর। একটু বড় পুকুর হলে জলের পরিমাণ থাকে বেশি। বাতাসের সংস্পর্শে বেশি পরিমাণ জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণও কিছুটা বেশি থেকে যায়। যার ফলে মাছের বেড়ে উঠতে কোন অসুবিধা হয় না।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?
সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি
শাশ্বতী রামায়ণী, শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪১: চরৈবেতি—গভীর বনপথে জীবন বহমান
মাঝারি গভীরতায় বিঘা প্রতি ১০০০টি চারা পোনা ১০০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার মাপে ছাড়া যেতেই পারে। মাছ মজুতের পরে সাধারণ যত্ন — পর্যায়ক্রমে জৈব সার প্রয়োগ, নিয়মিত সাধারণ কিছু খাদ্যমিশ্রণ, যেমন বাদাম খোল বা সর্ষেখোল বা তিলখোলের সঙ্গে চালের পালিশ কুঁড়ো মিশিয়ে সেমাই বা চাওমিন আকারে দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে মাসে একবার জাল টানার ব্যবস্থা হলে ও দু’ মাসে একবার কাঠা প্রতি এক কেজি হারে চুন দিতে পারলে এই মিশ্রচাষ পদ্ধতি থেকে বিঘা প্রতি এক থেকে দেড় টন মাছের ফলন নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়।
ভারত সরকারের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের আর্থিক আনুকূল্যে এবং তারও আগে কানাডার আইডি আরসি-র আর্থিক সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বরশূল, নবস্তা এবং সাঁকোতে ও মালদার হরিশচন্দ্রপুরে এবং উড়িশার কৌশল্যাগঙ্গার ফার্মে এই পদ্ধতির প্রয়োগে বছরে হেক্টর পিছু পুকুর থেকে ১৫ টনেরও বেশি মাছ বিশেষ করে কাতলা, রুই ও মৃগেল উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন চাষী এবং সমবায়ের কর্মীদের পর্যায়ক্রমে এই পদ্ধতির মাছচাষ দেখানো ও এতে প্রশিক্ষণ দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। মাছ ও পরিবেশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও এই পদ্ধতিতে জলের গুণমান অক্ষুণ্ণ রাখাও সম্ভব। এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদনও অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের রাজ্যে মিষ্টিজলের মাছচাষে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ছোট, মাঝারি ও বড় মাছচাষীও উপকৃত হয়ে চলেছেন।—চলবে
বিভিন্ন চাষী এবং সমবায়ের কর্মীদের পর্যায়ক্রমে এই পদ্ধতির মাছচাষ দেখানো ও এতে প্রশিক্ষণ দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। মাছ ও পরিবেশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব ও এই পদ্ধতিতে জলের গুণমান অক্ষুণ্ণ রাখাও সম্ভব। এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদনও অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের রাজ্যে মিষ্টিজলের মাছচাষে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ছোট, মাঝারি ও বড় মাছচাষীও উপকৃত হয়ে চলেছেন।—চলবে
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।