সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অন্য সব প্রাণীর মতো মাছের জীবনধারণ, স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রজননের জন্য নিয়মিত পুষ্টির প্রয়োজন হয়। আর সঠিক পুষ্টির যোগান হলে তবেই পাওয়া যায় মাছের ভালো ফলন। এতো সকলেরই জানা। মাছ চাষ করে আয় করতে গেলে মাছের খাবার জোগানো একটা প্রয়োজনীয় কাজ। মাছ প্রাকৃতিক খাবার থেকে পুষ্টি পায়। যেহেতু মাছের খাদ্যের ও পুষ্টির চাহিদা অনুযায়ী এটি সীমিত, তাই এই প্রাকৃতিক ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়ার অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। তাই সম্পূরক খাবার ও তার সঠিক সরবরাহের মাধ্যমে মাছের পুষ্টি যোগান সম্ভব হয়।

সফল মাছ চাষের জন্য যেমন দরকার নির্মল জলাশয়, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ এই উপযুক্ত খাবারের জোগান। পুকুরের উর্বরতা বজায় রাখবার জন্যে বিভিন্ন জৈব সার প্রায়শই পুকুরে দেওয়া হয়। এর ফলে বিভিন্ন আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ ও প্রাণীজাত খাদ্যকণা তৈরি হয় সালোকসংশ্লেষণের সহায়তায়। যাঁরা মাছচাষ করেন তাঁরা চান খুব দ্রুত মাছ বেড়ে উঠুক, নীরোগ মাছ উৎপাদন হোক। এর ফলে মাছেদের বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করতে দরকার হয় কিছু উদ্ভিদজাত, কখনও কখনও প্রাণীজাত উপাদানে তৈরি খাবার। এই খাবার খানিকটা নিয়ম মেনে যদি ঘরোয়া ভাবে তৈরি করে নেওয়া যায়, তবে তা সস্তা ও খাঁটি হয়। সর্বোপরি মাছের আবশ্যিক পুষ্টির যোগান ছাড়াও জলকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে এই পদ্ধতি।
প্রজাতিভেদে মাছের খাদ্যাভাসে ও পুষ্টি চাহিদার অল্পবিস্তার পার্থক্য থাকলেও পছন্দের দিক থেকে অনেক মিল থাকে। যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য সচরাচর আমরা ব্যবহার করে থাকি তার মধ্যে চালের কুঁড়ো একটি। অবশ্যই সেটি তুষমুক্ত হতে হবে। এছাড়াও চিঁড়ের গুঁড়ো, ভুট্টার গুঁড়ো, বিভিন্ন প্রকার তৈল বীজের খোল, ডালের খোসা ও গুঁড়ো—এই সব দিয়ে অল্প খরচে সুষম খাদ্য তৈরি করা যায়। একটু জেনে নেওয়া চাই কোন মাছের পুষ্টি এবং অণুপুষ্টির চাহিদা কী রকম। নির্বাচিত উপাদান পেষাই মেশিনে জাঁতা বা ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে নিয়ে অনুপাতে পরিমাণ মতো ওজন করে এবং ভালোভাবে মিশিয়ে, কোন উপাদান কত পরিমাণে দিতে হবে সে বিষয়ে একটু ধারণা নিয়ে এগলে সাধারণ চাষযোগ্য মাছগুলির খাবার ঘরোয়া ভাবে তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। তাই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি।

খাবার প্রয়োগের হার, দেওয়ার পদ্ধতি যথাযথ হওয়া দরকার। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থান থেকে খাবার খাবার প্রয়োগ করলে মাছ সহজে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মাছ প্রায় পুরো খাবারটাই চটজলদি খেয়ে নেয়। অর্থাৎ খাবার নষ্ট হয় না বললেই চলে। এর ফলে জলের গুণমানও ঠিকঠাক বজায় থাকে। পুকুরে যাঁরা মাছ চাষ করেন তাঁরা জানেন জলের তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের সঙ্গে খাবার প্রয়োগের একটা সহজ সম্পর্ক আছে। শীতকালে জলের তাপমাত্রা কমে যায়, মাছও খাবার কম খায়। তাই খাবারের পরিমাণও কমিয়ে দিতে হয়। গ্রীষ্মকাল মাছের বৃদ্ধির উপযুক্ত সময়। যতদিন জলে তাপমাত্রা একটু বেশির দিকে থাকে ততদিন মাছকে বাড়িয়ে নেওয়া যায় খুব তাড়াতাড়ি।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬১: এখন বাংলার মহিলারাও উন্নতমানের লার্ভা এনে চিংড়ি চাষ করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

তবে মনে রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে এবং তা বেশ কয়েকদিন স্থায়ীও হচ্ছে। আজকাল বায়ুর তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে জলের তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। জলের তাপমাত্রা দেখা গিয়েছে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে মাছের স্বেচ্ছায় খাবার গ্রহণ ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। এটা মনে রাখতে হবে যে, মাছও অন্য যে কোনও প্রাণীর মতো একই পরিমাণ খাবার খায় না রোজ। শুধু তাই নয়, একটু রকমফের করে খাওয়ালে বা খাবারে সামান্য পরিবর্তন আনলে খাবার গ্রহণে পরিমাণে তারতম্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়।

এও মনে রাখা দরকার, সুষম খাবারই যথেষ্ট নয়। সামান্য হলেও খাবারের প্রতিদিন পরিবর্তন করলেও ভালো ফল পাওয়া যায়। যেমন, যদি গন্ধের তারতম্য ঘটানো যায়। এমনকি প্রাকৃতিক রঙের সংযোগ করা সম্ভব হয়, তাহলে দেখা যায় খাবার গ্রহণের মাত্রা এবং ইচ্ছা দুইই বেড়ে যায়। মাছের এই বৈচিত্র্য খাবার আত্তীকরণের জন্য অপরিহার্য। সাধারণত মাছ যখন ছোট থাকে প্রোটিনের প্রয়োজন তার কিছু বেশি হতে পারে। কিন্তু জেনে রাখা দরকারযে, প্রোটিন বেশি দিতে গিয়ে প্রোটিন এবং এনার্জির ভারসাম্য যেন নষ্ট না করে ফেলি। সেই সঙ্গে মাথায় রাখুন, খাবার প্রয়োগ করা শুধু মাছেদের ভালোমত খাওয়ানোর জন্য। জলকে খাওয়ানোর জন্য নয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৭: শিক্ষায় বা জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, ত্যাগ সেবার চমৎকারিত্ব কোথায়?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

একেবারে বেশি পরিমাণ না দিয়ে ধৈর্য ধরে, ধীর লয়ে, মাছকে খাবার দিলে সহজে অভ্যস্ত হয়ে যায তারা। সেই কারণে খাবারের অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। জলও থাকবে নির্মল। তাই যিনি খাবার দেবেন তাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। মাছেদের প্রাক-প্রজনন পরিচর্যার সময় বিশেষভাবে প্রস্তুত খাবারের প্রয়োজন আছে। যেমন এই সময়ে খাবারে কিঞ্চিত বাড়তি ভিটামিন-সি এবং ই এবং অতি অল্প মাত্রা হলেও দীর্ঘশৃংখল ফ্যাটি অ্যাসিডের যোগান খুব কার্যকরী। এই খাদ্যপ্রাণের ঘাটতি এই সময়ে ক্ষতি করতে পারে। কিছু কিছু সময় আছে যেমন যখন একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে বা পুকুরে সদ্য জাল টানা হয়েছে কিংবা কোনও কারণে জলের তাপমাত্রা বেশি বা কম হয়ে গিয়েছে, দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়েছে, এইরকম সময়ে খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো। মাছের আকার, প্রকারভেদ, খাবারের গুণমান, জলের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। খাবার জলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন গুলে না যায়, এটা লক্ষ্য রাখা বিশেষ দরকার। এই জন্যে খাবার তৈরির সময় একটু বাঁধন সৃষ্টিকারী বা বাইন্ডার অল্প পরিমাণে যোগ করলে ভালো হয়। যেমন খুব পাতলা সাবুর জল, ভাতের ফ্যান, একটু চিটেগুড় ইত্যাদি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: বাড়িতে চন্দন আছে? কমতে পারে অনেক অসুখ-বিসুখ

চাষির আয় বাড়াতে কম খরচে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। মাছ উৎপাদন জনসাধারণের অপুষ্টি দূরীকরণের এক অন্যতম হাতিয়ার। আমাদের দেশ এখনও কৃষিভিত্তিক, কৃষকভিত্তিক। মাছচাষ কৃষির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মাছ চাষ ও তার আনুষঙ্গিক অন্যান্য ছোট শিল্প যেমন মাছের খাবার প্রস্তুত প্রয়োগ কৌশল খুব প্রাসঙ্গিক। চাষির নিজ নিজ গ্রাম, পরিবার, সমাজ তথা রাজ্য এবং দেশ উপকৃত হবে তখনই, যখন আমরা সার্বিকভাবে এই এই প্রচেষ্টাকে সফল রূপ দিতে পারব। অধিক চাষের ফলন, উন্নত মানের টেঁকসই চাষের মাধ্যমেই সম্ভব। আর এর সাহায্যে বিশেষত গ্রামের মানুষের পুষ্টি সুনিশ্চিত করা ছাড়াও মাছের গুণগতমানের পৌষ্টিক সমৃদ্ধিও সম্ভব।
একটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাছকে পরপর দু’ দিন বেশি প্রোটিনযুক্ত খাবার দিয়ে পরে দু’দিন খুব কম প্রোটিনযুক্ত খাবার দিলেও মাছের বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে। আবার খাবারের খরচেও অনেকটা সাশ্রয় হয়। আরও যে উপকারটি হয় সেটি হল, মাছের বর্জ্য পদার্থ বিশেষত অ্যামোনিয়া কম পরিমাণে নির্গত হয়। অর্থাৎ পুকুরের জল ভালো থাকে। মাছ সুস্থ থাকে। খাবার সুষম হলেও যদি মাছের পোনা বিশ্বস্ত বা ভালো অনুমোদিত হ্যাচারি থেকে সংগ্রহ করা না হয় তাহলে রোগবালাইয়ের সম্ভাবনা থেকে যায়।

আপাতভাবে সুস্থ দেখালেও চাষের শেষের দিকে রোগবালাই এসে মাছের উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। তাই পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মাছের পোনার গুণমান এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারলে নিশ্চিতভাবে মাছ চাষ থেকে যথেষ্ট আর সুনিশ্চিত আয় করা সম্ভব। এই মাছ চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভর কর্মসংস্থান একটি সাফল্যের দিশা দেখাতে পারে‌।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content