বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে যে হরমোনটির ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল ‘গোনাডোট্রপিন’। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে এটি নির্গত হয়‌। খুব সংক্ষেপে এর ক্রিয়াকলাপ চার্টে দেখানো হল। মাছের মস্তিষ্কে থ্যালামাসগ্রন্থির ঠিক নীচে হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থি থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন যার নামক ‘গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন’ বা ‘জিএনআরএইচ’ নির্গত হয়ে তা পিটুইটারি গ্রন্থিকে ‘এফএসএইচ’ এবং ‘এলএইচ’—এ দুটির নির্গমনে সহায়তা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণেরও কিছু ভূমিকা পালন করে।
আজকাল বাণিজ্যিকভাবে এই ‘জিএনআরএইচ’ পাওয়া যায়। আসলে এটি ছোট মাপের একটি প্রোটিন, মাত্র দশটা অ্যামিনো অ্যাসিডে তৈরি বলে এটিকে ডেকাপেপটাইড বলাই শ্রেয়। যদিও ছোট প্রোটিন বলতে কোনও অসুবিধা নেই। প্রণোদিত প্রজননের সাহায্যে রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছের বদ্ধ জলাশয়ে ডিম উৎপাদনের প্রযুক্তি এখন আমাদের রাজ্যের কৃষকদের এতটাই করায়ত্ব হয়ে গিয়েছে যে ছবিতে দেখানও গোলাকার হ্যাচারির সাহায্যে আনুমানিক দু’ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ব্রিডিং পুল, হ্যাচিং পুল ও সেই সাথে উঁচু জলাধার তৈরি করে অনেকেই শুধু যে নিজের কর্মসংস্থানের সম্ভব করছেন। শুধু তাই নয়, বছরে ছয় থেকে আট মাস ২০ থেকে ২৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান একটি হ্যাচারি থেকে সম্ভব হচ্ছে। যদি অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণ থাকে তবেই। বেশি মাছ উৎপাদনের জন্য অনেকটা পরিমাণ ডিমপোনা, ধানিপোনা বা চারা পোনা লাগবে, এটি সহজেই অনুমান করা যায়।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৭: ডিম থেকে বেরনোর পরে বাচ্চাগুলি তিন দিন কিছুই খায় না, এই কদিন দেহলগ্ন কুসুমেই চলে যায়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৩: কুরুপাণ্ডবদের দুই পিতামহের একজন — ভীষ্ম এবং তাঁর মা গঙ্গা

এখন মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাছের প্রজনন করানো সম্ভব হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই কেবল উত্তরবঙ্গের পার্বত্য এলাকা ছাড়া। গ্রামীণ কর্মসংস্থানের নিরিখে এটি যে একটি বিশাল সুযোগ আমাদের কাছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, এখন গ্রামীণ মহিলারাও এগিয়ে এসেছেন এবং অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে হ্যাচারিতে কাজ করে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করে চলেছেন। পারিবারিক আয়বৃদ্ধিতে তারা শামিল হয়েছেন।
ইদানীং মৎস্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার জন্যে গ্রামীণ মহিলাদের যে উৎসাহ দেখছি তা অত্যন্ত আশার কথা। রুজি রোজগারের কারণে গ্রাম থেকে অনেক পুরুষই দূরবর্তী এবং অদূরবর্তী শহরে যাচ্ছেন। ফলে মাছচাষে মহিলারা এখন এখন অনেকবেশি সক্রিয়। এই কারণে মাছচাষে লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা পালটে গিয়েছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

অন্তর্দেশীয় মৎস্য উৎপাদনে সারাদেশের মোট প্রয়োজনের অর্ধেকেরও বেশি ডিমপোনা ও ধানীপোনা উৎপাদন করে পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষিরা একাদিক্রমে রাজ্যকে বছরের পর বছর ধরে মাছ উৎপাদনে দেশের সেরা শিরোপাটি এনে দিচ্ছেন। এখনও কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

কেন্দ্রীয় সরকারি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, রুই, কাতলা উৎপাদনের চাহিদা পঞ্চাশ শতাংশও এই উৎপাদন এখনও মেটাতে পারেনি। এত মাছের পোনা উৎপাদন করার সত্ত্বেও। প্রণোদিত প্রজনন ও সেই সঙ্গে হ্যাচিং পুলে নিষিক্ত ডিম ফুটিয়ে ডিমপোনা উৎপাদন করতে একটি সাইকেলে সাকুল্যে সময় লাগে তিন দিন। চক্রাকারে জলপ্রবাহের জন্য পুলের ভেতর দেয়ালের গায়ের ৪৫ ডিগ্রি কোণে জলের পাইপের মুখে ডাক মাউথ লাগিয়ে জলপ্রবাহের ব্যবস্থা করে এবং জলের মধ্যে নির্দিষ্ট উচ্চতায় পাইপ দিয়ে বাড়তি জল বের করে দিতে হয়। মশারির সাহায্যে ও ছাকনির সাহায্যে এই কাজটি এখন একটি শিল্পের আকার নিয়েছে আমাদের গ্রামাঞ্চলে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৩: ‘ওই দেখ, রাহুল দেব বর্মণের বাবা হেঁটে যাচ্ছেন’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

আমাদের রাজ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় এই কাজ চলছে সুন্দরভাবেই। তবে আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, বাঁকুড়া জেলার ওন্দা ব্লকের বিষ্ণুপুরের কাছে অবস্থিত রামসাগরে বিড়াই নদীকে কেন্দ্র করে প্রায় তিনশটি মাছের হ্যাচারি তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকটি হ্যাচারি পূর্ণমাত্রায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। এক সময়ে এই অঞ্চলের জমিতে প্রচুর ঢাল ছিল। বর্ষার সময় ঢালে প্রচুর জল নামত এবং সেই জলকে কাজে লাগিয়ে বিশেষভাবে বাঁধ দিয়ে একটু দক্ষ পরিচালনার মাধ্যমে বাঁকুড়া জেলার বাঁধ ব্রিডিং সারা পৃথিবীতে মাছের প্রজননের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
অনুমান করা হয় এই বাঁধ ব্রিডিংই আজকের প্রণোদিত প্রজননের গবেষণায় প্রথম দিশা দেখায়। পরবর্তীকালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং ক্রমশ ইকো হ্যাচারি বা হ্যাচারির প্রবর্তন হওয়ায় ইদানীং মাছের প্রজননপদ্ধতি অনেকটাই হ্যাচারি নির্ভরহয়ে গিয়েছে। তার ফলে গ্রামের প্রচুর মানুষ এখন আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। রামসাগর মৎস্যবীজ উৎপাদনে এক অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। আমার মনে হয় মৎস্য পর্যটনের প্রভাব আমাদের দেশের অনেক মানুষকে আকর্ষণ করবে আগামীদিনে। হয়তো এই কথা মনে রেখেই সেখানে সরকারি বেসরকারি তরফে বিষ্ণুপুরী ঘরানায় অভিনব সব গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে ও প্রযুক্তিনির্ভর এই মৎস্য উৎপাদন সারাদেশে গ্রামীণ আর্থ সামাজিক বিকাশে ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হয়।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content