শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রুই, কাতলা, মৃগেল, বাটা, কালবোস ইত্যাদি যে সব মাছ আমরা চাষ করি বা অন্যত্র চাষ হয়ে থাকে সেই সব মাছ কোনটাই বদ্ধ জলাশয়ে কখনই ডিম পাড়ে না। এরা বর্ষাকালে নদীতেই শুধু ডিম পাড়ে। বহু আগে আমাদের রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা, ধুলিয়ান এবং মালদহ জেলার মানিকচক অঞ্চলের নদী থেকে মাছের ডিম পোনা সংগ্রহ করা হতো। সেগুলো দিয়েই মাছ চাষ শুরু হতো সর্বত্র। পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থার একটু উন্নতি হয়।
পরবর্তীকালে দেখা যায়, বাঁকুড়া পুরুলিয়া এবং অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কিছু বিশেষ বাঁধেও এই মাছগুলি ডিম ছাড়ে। ফলে সেখান থেকেও ডিম পোনা পাওয়া যায়। এই সমস্ত ডিম ডিমা পোনা কেনার পরে বড় হাঁড়িতে করে ট্রেনে, ট্রাকে বা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ছাড়াও মানুষের কাঁধে করেও এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাঠানোর রেওয়াজ ছিল।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৬: গভীর সমুদ্র, আন্টার্কটিকার হিমশৈল থেকে মরুভূমি হয়ে পর্বতের হ্রদ—মাছেদের উপস্থিতি সর্বত্র

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১২: সিদ্ধাশ্রমে সাফল্য, বিশ্বামিত্রের বংশবর্ণনা এবং নদীকথায় কীসের ইঙ্গিত?

নদীর ডিমপোনা ভালো করে দেখে না নিতে পারলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো। কারণ ওইসব ডিম পোনার সঙ্গে অন্যান্য মাছের ডিম পোনাও মিশে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যেত। তুলনামূলকভাবে সেদিক থেকে বাঁধের ডিম পোনা ছিল নিরাপদ। পরে আরও কিছুটা অগ্রগতি হয়। জানা যায়, মাছকে হরমোন ইনজেকশন করেও প্রজননের মাধ্যমে প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে ডিমপোনা পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৬: আবার নুনিয়া

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

পাকা মাছের মস্তিষ্কের নিচে পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যে এই হরমোন থাকে, যা প্রজনন ঋতুতে আপনাআপনি শরীরে মিশে গিয়ে মাছকে ডিম পাড়তে সাহায্য করে। যত্ন নিয়ে মস্তিষ্কটির খুলি সরিয়ে ফেলতে পারলে এই পিটিউটারি গ্রন্থিটি দেখা যাবে একটি পাতলা পর্দায় ঢাকা আছে। সাধারণ একটি বাঁকা নিডল যা দেখতে অনেকটা কান খোটার কাঠির মতো, তা দিয়ে এই গ্রন্থি তুলে নেওয়া যায় সহজে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তা খাঁটি বা অ্যাবসলিউট অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখলে কিছুদিন তা সতেজ থাকে।
সচরাচর গ্রীষ্মকাল বা বর্ষার আগেই এই গ্রন্থি সংগ্রহ করার কাজ সেরে নিতে হয়। অদ্ভুতভাবে দেখা গিয়েছে, এক জাতের মাছের গ্রন্থির মিশ্রিত রস অপর জাতের মাছকে ইঞ্জেকশন দিয়েও প্রজনন করানো সম্ভব। গ্রন্থি প্রস্তুতি ও প্রয়োগের পরিমাণ ও ইঞ্জেকশন দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি একটু শিখে নেওয়ার দরকার আছে। প্রতি কেজি ওজনের ডিমভরা মাছ থেকে প্রায় এক লক্ষ ডিম পাওয়া যেতে পারে। আঁতুরপুকুরে এই ডিম ফুটিয়ে পোনা উৎপাদন ও তা বিক্রি করে একজন ভাল আয় করতে পারেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

সাধারণত স্ত্রী মাছকে প্রথম দফায় বিকেলের দিকে ও দ্বিতীয় দফায় রাত্রে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, জলের তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩০ ডিগ্রি থাকলে হরমোন প্রয়োগের ফল ভালো পাওয়া যায়। অর্থাৎ মাছের প্রজননের জন্য সব দিন ঠিক উপযুক্ত নয়। ইঞ্জেকশন দেওয়ার ৫-৬ ঘণ্টা পর প্রজনন শুরু হয় হাপার মধ্যে। ডিম দেওয়া হয়ে গেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার দরকার হয়, যাতে ডিমগুলি পরিপূর্ণভাবে ফুলে ওঠে এবং শক্ত হয়। স্ফুটন হাপায় সাধারণত ২x১ মিটার ঢাকা কাপড়, সেটা নাইলন বা সুতির মার্কিন কাপড়ও হতে পারে।

একটি কাপড়ের চৌবাচ্চার মধ্যে আরেকটি চৌবাচ্চা বলা যেতে পারে। একে ডবল হাপা বলা যায়। বাইরের হাপাটি মার্কিন কাপড়ের এবং ভেতরের হাপা গোল নেটের মশারির কাপড়ের। ভেতরের হাঁপাটি ১.৫ মিটার x ৭৫X৫০ সেন্টিমিটার। এটি চারটে বাঁশের খুঁটির সাহায্যে জলের মধ্যে টাঙানো থাকে। প্রতিটি স্ফুটন বা হ্যাচিং হাপায় দুই থেকে চার লিটার ডিম মশারির গোল নেটের উপর জলের তলে বিছিয়ে দেওয়া হয়। এ ভাবে ষোলো ঘণ্টা থাকলে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে ডিমপোনা যা মার্কিন কাপড়ের হাপায় চলে যায় আপনাআপনি। আর ডিমের খোসাগুলি নেটের হাপায় পড়ে থাকে।
ডিম থেকে বের হয়ে বাচ্চাগুলি তিন দিন অবধি কিছু খায় না। দেহলগ্ন কুসুমে ওদের চলে যায় এই তিন দিন। স্ফুটন হাপায় থেকেও কিঞ্চিৎ বেড়ে ওঠে। তারপর ১০ মিলিমিটার চামচে মেপে আগে থেকে প্রস্তুত করা আঁতুড় পুকুরে পরিমাণ মতো ছাড়তে হয়। সাধারণত এক মিলিলিটারে ৫০০টি বাচ্চা থাকে পিটুইটারি সংগ্রহের যন্ত্রপাতি এবং প্রজননের জন্য সাজ সরঞ্জাম কিছুটা এই ছবিতে দেখানো হলো। আগামী সংখ্যায় এই কীভাবে হ্যাচারিতে প্রজনন করা হয় তার বিস্তৃত বিবরণ থাকবে আশা করি।—চলবে
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content