আগের সংখ্যায় ইলিশের পরিযায়ী জীবন নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সে এক বিচিত্র জীবন। সামুদ্রিক মাছ হয়েও ডিম পাড়তে ছুটে আসে নদীতে, আর সেখানে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে আবার তারা ফিরে যায় সাগরে। এ বারের আলোচনাতে জানবো আর এক ধরনের পরিযায়ী মাছের কথা। এটি হল ক্যাটাড্রোমাস। আর ইলিশ হল অ্যানাড্রোমাস। এই ক্যাটাড্রোমাস মাছের জীবনধারা আরও বিচিত্র। এটি এতটাই অদ্ভুত যে, আজও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি কারণ উদঘাটন করতে পারেননি এর বিচিত্র জীবনের দিকগুলি। এই মাছটি হল ‘ঈল’।
লম্বা ঈলের লম্বা শরীর, গোলাকার আঁশহীন মসৃণ দেহ। পিঠে কোনও পাখনা নেই। অনেকটা আমাদের বান কিম্বা পাঁকাল মাছের মতো। মূলত এই ঈল মাছ আমেরিকা ও ইউরোপের মাছ। অ্যাঙ্গুইলা গ্রুপের এই মাছগুলি সারা বছর নদী, পুকুর এইসব মিষ্টি জলেই কাটায় জীবনের বেশি সময়টা। তারপর হঠাৎ এক সময় যৌবনের জোয়ার এলে যাত্রা করে অতলান্তিক মহাসাগরের দিকে। রাতের অন্ধকারে মাঠ, ঘাট, ডাঙা সব পেরিয়ে নদীতে পৌঁছয়। তারপর সেখান থেকে অতলান্তিকের অভিমুখে রওনা হয়।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৫: ইলিশ নামটির মধ্যে আমাদের আবেগ ও আস্বাদ দুটোই জড়িয়ে আছে
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২১: শিষ্য যখন গুরু হয়ে ওঠেন, তাঁর পরিবর্তিত মানসিকতা কী আরও উন্নত করে তোলে শিষ্যকে?
অতলান্তিক পৌঁছে ক্রমশ সমুদ্রের গভীরে চলে যায়। একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপরে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে, ডিম সম্পৃক্ত হয়ে, বাচ্চা বের হয়। আর সেই জায়গাটা ঈল-শিশুতে ভরে ওঠে। এর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই শিশু ঈলের সঙ্গে পরিণত ঈল মাছের আকৃতির কোনওই মিল নেই। বহুদিন যাবত এই শিশুগুলিকে আলাদা কোনও একটি মাছ বলে মনে করা হতো। যাই হোক পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় এগুলি সবই ঈল, অন্য মাছ নয়।
অতলান্তিক পৌঁছিয়ে ক্রমশ সমুদ্রের গভীরে চলে যায়। একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপরে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে, ডিম সম্পৃক্ত হয়ে, বাচ্চা বের হয়। আর সেই জায়গাটা ঈল-শিশুতে ভরে ওঠে। এর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই শিশু ঈলের সঙ্গে পরিণত ঈল মাছের আকৃতির কোনওই মিল নেই। বহুদিন যাবত এই শিশুগুলিকে আলাদা কোনও একটি মাছ বলে মনে করা হতো। যাই হোক পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় এগুলি সবই ঈল, অন্য মাছ নয়।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ
অজানার সন্ধানে: এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?
সব ঈল শিশুই দেখতে চ্যাপ্টা, অত্যন্ত স্বচ্ছ দেহ, দেহের তুলনায় মাথা অতি ছোট। ক্রমশ এরা বড় হয়ে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল ক্রমশ উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে পৌঁছয়, আর যেগুলো ইউরোপিয়ান অরিজিন ছিল সেই সব ছানা-পোনাগুলি ইউরোপ অভিমুখে রওনা হয়। ঠিকঠাক মতো পৌঁছেও যায়। আজ পর্যন্ত এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। ইউরোপিয়ান ঈল ইউরোপে, আর আমেরিকান ঈল আমেরিকায় পৌঁছে যায়।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত
এই সুদীর্ঘ যাত্রা পথে ধীরে ধীরে এদের আকৃতি বদলে যায়। ক্রমশ লম্বা হয়, গোল আকার ধারণ করে, রং বদলে যায়, গাঢ় হয়ে যায় রং। যদিও স্বচ্ছতা অনেকটাই থাকে। বড় হয়ে যাওয়ায় গায়ের রং গাঢ় হলে তখন সেগুলি পূর্ণাঙ্গ ঈলে পরিণত হয়। বিভিন্ন জলাশয়ে আবার নিজেরা জায়গা করে নেয়। এর কোনও ব্যতিক্রম হয় না। অর্থাৎ আমেরিকান ঈল এবং ইউরোপিয়ান ঈল ভুলক্রমেও কখনও মিশে যায় না। জীবজগতে এইরকম আশ্চর্য ঘটনা আর বিশেষ আছে বলে মনে হয় না।
বংশবিস্তারের জন্য এইরকম অভিযান চালিয়ে নিজে ঘরে ফেরা যে কত কষ্টসাধ্য, তা এদের জীবনধারা দেখলে বোঝা যায়। অভিযানের জন্য এ বার আবার শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে এরা। ঈল মাছের এই সহজাত প্রবৃত্তি বংশপরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
আজও এটি গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈল মাছের এই রহস্য উদঘাটন নিশ্চয়ই একদিন হবে। কীভাবে এরা পূর্বপুরুষের গুণসহ নিজের জায়গায় ফিরে যায়। এই ঘটনা যে আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এই অদ্ভুত প্রকৃতির কাণ্ডকারখানা ভাবলেই অবাক হয়ে যেতে হয়।
আজও এটি গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঈল মাছের এই রহস্য উদঘাটন নিশ্চয়ই একদিন হবে। কীভাবে এরা পূর্বপুরুষের গুণসহ নিজের জায়গায় ফিরে যায়। এই ঘটনা যে আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এই অদ্ভুত প্রকৃতির কাণ্ডকারখানা ভাবলেই অবাক হয়ে যেতে হয়।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।