সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আমাদের এই সুজলা সুফলা রাজ্যটিকে শস্য শ্যামলা করে তোলার মূলেই আছে জল ও মাটি। শুধু শস্য ফলনের জন্যই নয়, মাছের ফলনেও জল এক অত্যাবশক উপাদান। আর জল রয়েছে অসংখ্য স্থায়ী বা বহুবর্ষজীবী পুকুর, খাল, বিল ইত্যাদিতে। আর এই সবের মাধ্যমে আমরা সারা বছর পেয়ে থাকি বিভিন্ন ধরণের মাছ। আমাদের প্রতি প্রকৃতির অকৃপণ দাক্ষিণ্য বর্ষিত হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষণের মাধ্যমে, যা আমাদের যে কোনও ফসল ফলনের আশীর্বাদ স্বরূপ।
কয়েক মাস এই বর্ষণের ফলেই মাছের উৎপাদনে যে অভাবনীয় উন্নতি হতে পারে তার একটা দুটো উদাহরণ আমরা দেখতে পারি। যেমন চৌবাচ্চায় বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে জিওল মাছের প্রতিপালন সহজেই সম্ভব। এখানে জিওল মাছ বলতে বলতে চাইছি শিঙ্গি, কই এবং দেশি মাগুরের। এই মাছচাষের জন্য ৫ ফুট x ৬ ফুট x ৪ ফুট একটি চৌবাচ্চা তৈরি করে যার অবস্থান বিশেষে আকারের কিছুটা রকম ফের হতে পারে। জমির থেকে খানিকটা উঁচুতে থাকবে চৌবাচ্চার তল। ঢালও এমন হবে যে, নির্গম নল খুলে দিলে, জল বের করা যাবে সহজে। চৌবাচ্চায় আড়াই ফুট উচ্চতায় জল বেরোনোর জন্য একটি নল থাকবে, যেটি নাইলন নেটের সাহায্যে বন্ধ করা যাবে। এর ফলে বাড়তি জল বেরিয়ে যেতে পারবে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৩: মাছচাষের ক্ষেত্রে প্রতিকারের চাইতে সতর্কতাই আসল কথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

বৃষ্টির জল ভরতে দেওয়ার আগে দু-একবার ধুয়ে নিয়ে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট মিশ্রিত জলে নিয়ে ধুয়ে নিয়ে তাতে তিন দিন থেকে চার দিন জল ভরে রেখে দিতে হবে। এরপর বৃষ্টির জল ধরে মাগুর, শিঙ্গি বা কই-এর চারা ছাড়া যেতে পারে। সংখ্যায় এইরকম চৌবাচ্চার জন্য ১০০ থেকে ১২০টি আঙুলে পোনা ছাড়া যেতে পারে।
এই সব মাছের নিয়মিত খাবার ছোট লাল কিছু কেঁচো বা টিউবিফেক্স কেঁচো পাশেই মাটির ভ্যাটে চাষ করা যেতে পারে। সেখান থেকে নিয়মিত ৩০ থেকে ৪০গ্রাম মতো নিয়ে নিয়মিত খাবার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। এর পরিবর্তে ভেজানো বাদাম খোল, সঙ্গে মুড়ির গুড়ো এবং একটু সিদ্ধ মাছের মিশ্রণ দিয়ে একসঙ্গে মেখে মণ্ড করে চৌবাচ্চার ভেতরে পিভিসি পাইপের টুকরোর মধ্যে খাবার হিসেবে নিয়মিত দেওয়া যেতে পারে। মোট ওজনের আনুমানিক চার থেকে পাঁচ শতাংশ হারে, ছ’ মাসে একটি চৌবাচ্চা থেকে ৪ কেজি মাছ তো উৎপন্ন করা যেতেই পারে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৭: তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

শিঙ্গি, মাগুর থাকলে কই না দেওয়াই ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে কই চাষ করলে আলাদা একটি চৌবাচ্চায় করাই শ্রেয়। যারা সিমেন্টের চৌবাচ্চা চাইবেন না তারা পলিথিন লাইনিং দেওয়া (ছবিতে দেখানো) কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে বর্ষার জল সংরক্ষণ করতে পারেন এবং সেখানেও এই জাতীয় মাছ কিংবা ল্যাটা, পাবদা, শোল ছেড়ে দিতে পারেন এবং আগের বর্ণনা অনুযায়ী মণ্ড আকারে খাবারও দিতে পারেন। যাদের পিঁপড়ের ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব তারা সেই পিঁপড়ের ডিমের সঙ্গে চিঁড়ের গুঁড়ো, চালের গুড়ো, কিঞ্চিত সাবু মিশিয়ে আঠালো মণ্ড তৈরি করে দিতে পারেন। যদি পাকাল মাছের পোনা পাওয়া যায় এই পাকাল মাছও, এই কৃত্রিম পুকুরে বাড়তে পারে, এমনকি তেলাপিয়াও।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৯: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু আচার্য দ্রোণ এবং তাঁর বিখ্যাত শিষ্যদ্বয়, কে মহান? গুরু না শিষ্য?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৯: পঞ্চমের সুরে লতার গাওয়া ‘মেরে নয়না সাওন ভাদো’ গান শুনে শুনেই প্রস্তুতি শুরু করেন কিশোর

এইরকম ভাবে যে কোনও একটি পরিবার পাঁচ ছয় মাসের চেষ্টায় বেশ কিছুটা মাছ উৎপন্ন করে নিতে পারেন বাড়ির লাগোয়া চৌবাচ্চা কিংবা পলিথিনের লাইনিং দেওয়া পুকুরে। এতে আর যা হোক আয় বাড়ুক বা না বাড়ুক বাড়ির সকলের দৈনন্দিন খাবার মাছটি কিন্তু অনায়াসে পাওয়া যেতে পারে। এই বর্ষার জমা জলেই এটা সম্ভব। এর জন্য বিশেষ কোনও পরিচর্যার দরকার নেই। কিঞ্চিৎ জৈব সার বা জৈব জুস নিয়মিত প্রয়োগ করলে উদ্ভিদকণা এবং প্রাণীকণারর কিছুটা যোগান হয়ে যায়, যা এই মাছগুলির প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে কাজ করতে পারে। জৈব জুস বানাতে যদি চান তাতে লাগবে সামান্য সর্ষের খোলের গুঁড়ো, সেদ্ধ করা চালের খুদ, চিটে গুড় এবং ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম মত কুড়ে নেওয়া আনারসের শাঁস যা একটু নরম হওয়া আনারস থেকে সংগ্রহ করতে পারলে ভালো হয়। এগুলি মিশিয়ে তার মধ্যে রুই, মৃগেল, বাটা ইত্যাদির নাড়িভুড়ি অল্প মিশিয়ে একটি কলসি বা মাটির পাত্রে ঢাকা দিয়ে দিন সাতেক রাখতে হবে।
প্রত্যহ একটি দণ্ডের সাহায্যে ঘেঁটে নিয়ে দিন সাতেক পর থেকে সেই চৌবাচ্চায় কিংবা পলিথিন লাইনিং দেওয়া পুকুরে নিয়মিত খুব অল্প পরিমাণে দিতে পারলে প্রাণীকণার কোনও অভাবই থাকবে না। অর্থাৎ আমাদের প্রায় নিখরচাতেই বর্ষার জমা জলে কিছুটা মাছ উৎপন্ন করা হয়ে যেতে পারবে। এর জন্যে লাগবে শুধু নিজেদের কর্মোদ্যম। এর সঙ্গে বর্ষার এই কটি মাসের মাছের ফলন বাড়িয়ে পারিবারিক পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করা যেতে পারে ― যাতে শিঙ্গি, মাগুর, কই, পাকাল, পাবদা, ল্যাটা, শোল এইরকম কিছু বৈচিত্র্যপূর্ণ মাছের মাধ্যমে স্বাদবৈচিত্র্য ও সেই সঙ্গে পুষ্টি দুইই আমরা যোগান পেতে পারি।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content