বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


বাংলায় শুঁটকি মাছের চাহিদার কোনও শেষ নেই। তবে অবশ্যই সেই মাছ তাজা হতে হবে। উদ্বৃত্ত সামুদ্রিক এবং মোহনার কাছে পাওয়া মাছ হাওয়ায় এবং সূর্যকিরণে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে যে শুঁটকি মাছ প্রস্তুত করা হয়, তার চাহিদাও ভালোই। শুঁটকি মাছের বিপুল চাহিদা উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যেই। যার প্রায় সবটাই আমাদের রাজ্য থেকে যায়। কারণ, আমরাই সেই সব রাজ্যের কাছের উপকূলবর্তী রাজ্য। শীতের সময় বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত আমাদের উপকূলবর্তী দুই জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে এই সময়ে প্রচুর খোটি তৈরি হয়। এই সময়ে সেই সব খোটিতে বহু মানুষজন এই শুঁটকি মাছ তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন।
সাধারণত যে সমস্ত মাছ শুকানো করা হয় তার মধ্যে লোটে, ভোলা, তোপসে, পার্শে, ভাঙান কিছু প্রজাতির পমফ্রেট এবং সার্ডিন ম্যাকারেল, বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এতদিন ধরে বালির ওপর ছড়িয়ে বা বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে মাছ শুকানো করার রেওয়াজ ছিল। তবে এখনও অনেক জায়গায় এরকম ভাবে মাছ শোকানো হয়। এর কয়েকটি অসুবিধা আছে, যেমন —
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে।
প্রক্রিয়াটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত চলায় এতে নানাভাবে বর্জ্য মিশে যেতে পারে, যেমন পাখির বিষ্ঠা, বিভিন্ন পোকামাকড়ের শুটকীট ইত্যাদি।
এ সবের হাত থেকে রেহাই পেতে অনেক সময় কীট বিতারক ওষুধও স্প্রে করা হয়, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
সব মলিয়ে আদর্শগত ভাবে এ ভাবে প্রস্তুত করা শুঁটকি মাছ খাবার অনুপযুক্ত থাকে।
 

শুঁটকি মাছ স্বাস্থ্যসম্মত? নিরাপদ? আদৌ পুষ্টিগুণ অটুট থাকে?

মাছের পুষ্টিগুণের কথা উঠলে প্রথমেই আমাদের প্রোটিনের কথা মাথায় আসে।
প্রথমত: অন্যান্য মাছের থেকে শুঁটকি মাছের মূল পার্থক্য হল—এই মাছ থেকে জল বের করে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, মাছ থকে কেবল জলই বের করা হয়, বাকি সব খাদ্যগুণ কিন্তু একই রকম থাকে।

দ্বিতীয়ত: জানলে ভালো, জল বের করে দেওয়া ফলে অন্য মাছের তুলনায় শুঁটকি মাছে বরং প্রোটিনের মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণভাবে একটি ফ্রেশ একশো গ্রাম মাছে শতকরা হিসেবে ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম জল থাকে। আর ২০ শতাংশকে যদি প্রোটিন হিসেবে ধরা হয়, তাহলে ২০ শতাংশের বেশিই প্রোটিন শুঁটকি মাছে। কারণ, শুঁটকি মাছে জল বের করে দেওয়ার ফলে পুরোটাই প্রোটিন পড়ে থাকে।

তৃতীয়ত: যতটুকু পুষ্টিগুণ ক্ষতি হয় তা হল মাছে প্রোটিন ছাড়া আরও কিছু মূল্যবান অনুপুষ্টি থাকে। তার মধ্যে দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড অন্যতম। শুঁটকি মাছে অল্প-বিস্তর সেই দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড ক্ষতি হলেও হতে পারে। তবে, এখন বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি যে উচ্চ প্রযুক্তিতে শুঁটকি মাছ প্রস্তুত করছে, তা অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদও। শুধু তাই নয়, এদের প্রস্তুত শুঁটকি মাছে সর্বাধিক পুষ্টিগুণ বজায় থাকছে। কেন্দ্র সরকারের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই)-ও বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি-র বিশেষ ভাবে প্রস্তত করা শুঁটকি মাছকে নিরাপদ বলে মান্যতা দিয়েছে।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে

জাঁকিয়ে শীত পড়ার আগেই গালভর্তি ব্রণ? চিন্তা নেই, হাতের কাছেই রয়েছে সহজ সমাধান

ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে? হার্ট ভালো রাখতে রোজের রান্নায় কোন তেল কতটা ব্যবহার করবেন? দেখুন ভিডিয়ো

অচেনা টলিউড, পর্ব-১: পরিচালক স্বপন সাহার কাছে ছবির গল্পটাই ছিল আসল

নিমপীঠে অবস্থিত বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির উদ্যোগে এই মাছ সংরক্ষণ অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। আমি কিছুদিন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখানে মাছ শুকানোর কাজ অনেকটাই করা হয় সৌরশক্তি সহায়তায়। ফলে পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। প্রথমে আঁশ, নারিভুঁড়ি, ফুলকা ইত্যাদি পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। তার পরে লবণ জলে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কিছুটা কাঠ পোড়ানো চিমনি-সহ ওভেনে পুরোপুরি জল মুক্ত করা হয়। এর পরে আবার সোলার ড্রাইং করে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে হাতের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চমৎকারভাবে প্যাকিং করা হচ্ছে। এতে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি হল— ক্রেতা একদম স্বাস্থ্যস্মমত, নিরাপদ মাছ পাচ্ছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা। এতে তাঁরা শ্রমের মর্যাদাও যেমন পাচ্ছেন, তেমনি তাঁদের আর্থিক সমৃদ্ধিও হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৩: নোবেল-প্রাপ্তির সংবর্ধনা-সভায় রবীন্দ্রনাথ ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৭: পিতৃসত্য রক্ষা, নাকি পিতার অনুনয়ে রাজ্যভার গ্রহণ?

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৮: এখানে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা…আবার সূর্য ডুবলে বাড়ি ফিরে যাই

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৬: ভৃগুবংশে জন্ম নিলেন পরশুরাম— চরুবদলের ভুলে ক্ষত্রতেজ পেলেন তিনি

আমাদের দেশে তো বটেই এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি মাছের বাজার হল গুয়াহাটির কাছে জাগ্গি রোডে জাতীয় সড়কের ওপর অবস্থিত বাজার। এখানে প্রতিদিন যে পরিমাণ শুঁটকি মাছ বিক্রি হয় তা শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। এ থেকে সহজে বোঝা যায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে শুঁটকি মাছের চাহিদা কতটা!
বাংলার সুন্দরবনের মাছও এখানে জায়গা করে নিতে পারে, যদি যথাযথভাবে উদ্বৃত্ত মাছের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। সাগরদ্বীপে এরকম একটি প্রকল্প আমরা নিমপীঠ থেকে চালিয়েছি। সাগরদ্বীপে মায়া গোয়ালিনীর কাছে সমুদ্র বন্দর হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। যদি এই প্রকল্প সম্পন্ন হয় তাহলে এখান থেকে মাছ বিপণনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার অনেক সুবিধা হবে। শুধু তাই নয়, সুন্দরবনের প্রধান জীবিকা মাছের চাষ। তাই মাছ উৎপাদন একটি বিশেষ মাত্রা পাবে। মানুষজনের জীবিকার মানও উন্নত হবে।

ছবি: লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content