রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


বাঙালির জীবনে যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র পুরাণগাথা থাকুক না কেন, একটি পুরাণ ছাড়া কিন্তু বাঙালিজীবন এক্কেবারে অচল, আর সেটি হল বাঙালির মৎস্যপুরাণ। এই একটি পুরাণই দেশ-বিদেশে বাঙালির মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের মৎস্যপুরাণে মাছের যাবতীয় পুরাণগাথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে থাকবেন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়

পর্ব – ৩

রসনার অপর নাম মাছ। মাছের সঙ্গে আমাদের যেন নাড়ির টান। মধ্যাহ্নভোজনে মাছের ঝোল ভাত না পেলে গোটা দিনের সমস্ত কাজের উৎসাহই যেন নষ্ট হয়ে যায়, তাই না? কিন্তু জানেন কি রসনা পরিতৃপ্তির পাশাপাশি আপনার শরীর যাতে পৌষ্টিক গুণসমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই দিকেও সমান খেয়াল রাখেন আমাদের এই মৎস্যদেবতা। আজ আপনাদের সঙ্গে মাছের এই পৌষ্টিক গুণাগুণের যাবতীয় তথ্যসম্ভার ভাগ করে নেব, কথা বলব মাছের অনবদ্য পৌষ্টিক গুণ নিয়ে।

পুষ্টি বলতে সবার আগে আমাদের মাথায় যে পৌষ্টিক উপাদানটির নাম মাথায় আসে সেটা হল প্রোটিন। প্রোটিন মানবশরীরের জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য উপাদান৷ কারণ স্নেহ, শর্করা ইত্যাদি উপাদান আপনার শরীর জমিয়ে রাখতে পারে অর্থাৎ সাত আটদিন টানা স্নেহজাতীয় খাবার না খান তাহলে আপনার কোনও শারীরিক সমস্যা হবে না কিন্তু প্রোটিন আপনার শরীর সঞ্চিত করে রাখতে সক্ষম নয়, তাই টানা বেশ কয়েকদিন প্রোটিনজাতীয় খাবার না খেলে আপনার বিভিন্নরকমের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সুতরাং বুঝতে নিশ্চয়ই সমস্যা হচ্ছে না যে কেন প্রোটিন মানবশরীরের জন্য এতটা অপরিহার্য? এই প্রোটিন কিন্তু সবথেকে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় মাছে। অন্যান্য প্রাণীজ খাবার যথা মাংস বা ডিম থেকেও প্রোটিন পাওয়া গেলেও মাছে প্রোটিনের পরিমাণ সবথেকে বেশি। পাশাপাশি প্রোটিনের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে উপকারিতার দিক থেকে সবথেকে বেশি কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় প্রোটিন হল মাইফাইব্রিলার প্রোটিন যার উদাহরণস্বরূপ মায়োসিন, অ্যাকটিন বিভিন্ন নাম উল্লেখ্য। মাছে এই মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন থাকে সবথেকে বেশি পরিমাণে, আর প্রোটিনের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সবথেকে কম উপকারী যেটি সেটি হল স্ট্রোমা আর অদ্ভুভাবে এই স্ট্রোমা মাছে সবথেকে কম পরিমাণে থাকে। এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক, যেন কোনও এক অদৃশ্য শক্তি আগে থেকে যোগসাজশ করে সমস্ত ভালো গুণাবলিগুলি দিয়েই আমাদের অতি প্রিয় মৎস্যদেবতাটিকে তৈরি করেছেন।
এ তো গেল প্রোটিনের কথা। কিন্তু কেবল প্রোটিনই নয় মাছে থাকে এমন এক পৌষ্টিক গুণ যে পৌষ্টিক গুণটি সর্বোতভাবে মাছ ছাড়া অন্য কোনও খাবার থেকে পাওয়া সম্ভবপর নয় আর সেটি হল দীর্ঘশৃঙ্খল ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। সাধারণত পুকুরের মাছ বা মিষ্টি জলের মাছের তুলনায় সামুদ্রিক মাছ থেকেই এই পৌষ্টিক গুণ অধিক পরিমাণে পাওয়া সম্ভব। এটি মানবশরীরের জন্য অপরিহার্য এমন একটি উপাদান যা কেবলমাত্র মাছ থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া সম্ভব। এছাড়া ভিটামিন এ, বি, ই, কে—এই চারটি ভিটামিন একাধারে মাছ থেকে পাওয়া সম্ভব। প্রতিটি ভিটামিন যৎসামান্য পরিমাণে হলেও মাছই একমাত্র একসঙ্গে এই চারটি ভিটামিনের উৎস হিসাবে কাজ করতে পারে। সবশেষে আরও একটি পৌষ্টিক উপাদানের কথা না উল্লেখ করলে এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে আর সেটি হল ভিটামিন বি১২। এটি হল এমন একটি উপাদান যেটি প্রাণীজ খাবার ছাড়া অন্য কোনও জাতীয় খাবার থেকে পাওয়া সম্ভব নয় আর প্রাণীজ খাবারের মধ্যে সবথেকে বেশি পরিমাণে পাওয়া সম্ভব মাছ থেকে। মানবশরীরের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় পৌষ্টিক উপাদান ভিটামিন বি১২-এর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল মাছ, এই উপাদানটি পেতে হলে মাছের বিকল্প আর কিছুই নেই।

সুতরাং রসনা তো আছেই মন্ত্রীমশাইয়ের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে কিন্তু তার পাশাপাশি মাছ যে কত বিভিন্ন বিবিধ উপকারী পৌষ্টিক উপাদান যে সমৃদ্ধ করছে আমাদের মৎস্যদেবতায় মাহাত্ম্যকে সে নিয়ে নিশ্চয়ই আর আমার প্রিয় পাঠকগণের কোনও সন্দেহ নেই। রসনা ও উপকারিতা উভয় মন্ত্রীই পাশাপাশি থেকে হাতে হাত মিলিয়ে আরও সুপ্রশস্ত করে তুলুক মৎস্যদেবতার যাত্রাপথ—এই আশা নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব পুষ্টির পথে রসনাকে সঙ্গে নিয়ে, সর্বোপরি মৎস্যপুরাণ সঙ্গে নিয়ে।

ছবি : লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content