বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


মাছ উৎপাদনের দুটি ক্ষেত্র হল সমুদ্র বা লবণাক্ত জল এবং মিষ্টি জলের নদী, পুকুর, খাল, বিল, ঝিল ইত্যাদি। এই সব আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন জলসম্পদ থেকে মাছ সংগ্রহের জন্য নানান রকম উপকরণ ও সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। এইসব উপকরণ এর মধ্যে মাছ ধরার অন্যতম হাতিয়ার হল জাল।
গ্রামাঞ্চলে পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে নানান ধরনের জাল যেমন খ্যাপলা জাল, টানাজাল হাত জাল—এইসব নিজেদের কাজের অবসরে বুনে থাকেন। বিভিন্ন জালের আকৃতি, ফাঁসের আকার, সুতোর বৈশিষ্ট্যের রকম ফের আছে। সময়ের সঙ্গে মূল উপাদান সুতো আজকাল পাল্টে যাচ্ছে। যেমন, মনোফিলামেন্ট সুতো, প্লাস্টিক সুতো। এছাড়াও মোটা দড়ি, প্লাস্টিকের বল যেটি অনেকটা ফ্ল্যাশ ট্যাংকের বলের মতো, পোড়ামাটির চাকতি আরও কত কী প্রয়োজন হয় এই জাল তৈরি করতে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯: কৌরবদের জন্ম এবং কুরুপাণ্ডবদের ছেলেবেলার শত্রুতা

উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় খটি। আসলে মৎস্যজীবীদের মরশুমি আবাসস্থল সচরাচর অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত। এই সময়টা খটিগুলি সব জেগে ওঠে এবং মৎস্যজীবীরা বিভিন্ন জাল নিয়ে নৌকায় চলে যান সমুদ্রে মাছ ধরতে। এই সমস্ত জাল বেশ দামী এবং এদের সংরক্ষণ করাও খুব জরুরি। সংরক্ষণ অর্থাৎ দীর্ঘায়ু করবার জন্য মৎস্যজীবীরা বিভিন্ন গাছের ছাল যেমন গাব, গড়ান এসবের সাহায্য নিয়ে জালের সুতোকে শক্তপোক্ত করে থাকেন।
ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাছ ধরবার জাল ছিঁড়ে গেলে যথাযথভাবে সেলাই করবার জন্যে প্রশিক্ষিত মৎস্যজীবীর সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। তাই জাল ছিঁড়ে গেলে কীভাবে সেলাই করা দরকার? এইসব জাল কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা প্রয়োজন? সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি। যেমন মাছ ধরার পরে জালকে কাদামাটি মুক্ত করে, অবাধে বাতাস চলাচল করতে পারে এমন জায়গাতেই সংরক্ষণ করা দরকার।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

মাছ চাষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণ চললেও জালের রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে সেরকম উদ্যোগ কমই দেখা যায়। নদী থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জালের ব্যবহার নিয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে। যেমন উপকূলের বারো নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত (এক নটিক্যাল মাইল সমান ১৮৫২ মিটার) অঞ্চলে টানা জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

এছাড়াও ইলিশের আশ্রয়স্থল বলে চিহ্নিত জায়গাগুলি, যেমন, ফারাক্কা ব্যারেজের পাঁচ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী লালবাগ থেকে ফারাক্কা দূরত্বটি আবার ডায়মন্ড হারবার থেকে নিশ্চিন্তপুর বা গদখালি পর্যন্ত ৯০ মিলিমিটারের কম ফাঁসযুক্ত মনোফিলামেন্ট জাল ব্যবহার করা যাবে না। নানাবিধ ছোট মাপের জালে আইনের তোয়াক্কা না করে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ছোট ইলিশ ধরার ব্যবহারে প্রবণতা দেখা যায়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?

দশভুজা: আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩২: মঞ্জু ও অনুভা এসে বললেন, ‘আসুন বিকাশবাবু চু-কিত-কিত খেলি’

যেহেতু আমাদের নজরদারি কিছুটা দুর্বল, সেই সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ এই সময় ছোট ইলিশ ধরেন। এর ফলশ্রুতিতে মৎস্যজীবীদের জীবিকাই অনেকটা বিপন্ন হয়ে পড়ে। সারা পূর্ব ভারতে এই জাল বা ফিশিং নেটের একমাত্র বড় বাজার হল নিউ আলিপুরের চেতলা রোডে। শুধু পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি কেন, অন্যান্য রাজ্য থেকেও এই অঞ্চলে বিভিন্ন দোকানে জাল কিনতে আসেন বহু মানুষ এবং মৎস্যজীবীরা।
সেই অর্থে আলিপুরের এই নেট বাজার এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে মাছের বাজারের দুনিয়ায়। এছাড়াও প্রত্যেকদিনের সান্ধ্য মাছের বাজার, বিশেষ করে নৈহাটির বটতলায় রোজকার রাতের বাজারে বহু মানুষ মাছ এবং মাছের সরঞ্জাম কিনতে আসেন। সেখানেও বিভিন্ন মাছের জালের কারবারিরা বসেন তাদের পসরা নিয়ে আসেন। এই অনন্য মাছ এবং মাছের সরঞ্জামের বাজার বোধহয় সারাদেশে আর কোথাও নেই।—চলবে

ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content