আমাদের সুন্দরবন জলজ জৈব সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এর মধ্যে অন্যতম হল সন্ধিপদ বিভিন্ন প্রকার কাঁকড়া। অনেকে আবার একে জীবন্ত জীবাশ্ম আখ্যা দিয়ে থাকেন। কারণ, হয়তো কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েও এখনও অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে।
কাঁকড়া লবণাক্ত জলে ভালো হয়, যা এখানে সহজলভ্য। এখানকার জলের গুণমান কাঁকড়া চাষের অত্যন্ত উপযোগী। উপকূল বরাবর স্বল্প জলের তলদেশে এদের বাস। শামুক, ছোট মাছ, চিংড়ি হল এদের পছন্দের খাবার। প্রায় সমগ্র দেহটাই খোলসে ঢেকে রাখে। সেই খোলসের নীচে পাঁচ জোড়া সন্ধিযুক্ত পদ থাকে। উদরের দু’পাশে পাঁচজোড়া পাতার মতো ফুলকা থাকে, যা শ্বাস নিতে ও চলাচলে সহায়তা করে।
খোলসের ওপরে একাধিক লেন্স দ্বারা গঠিত দুটি পুঞ্জাক্ষি থাকে, তামাগঠিত হিমোসায়ানিন থাকায় অক্সিজেন যুক্ত অবস্থায় এদের রক্তের রং নীলাভ হয়। রক্তের অ্যামিবো সাইট থেকে কিছু উত্সেচক বের হয়, যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিশ্চিত টক্সিন নির্ণয়ে সহায়তা করে। ওষুধ শিল্পে তাই এর বিশেষ কদর আছে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৮: শ্রীপুরার কাহিনি
পুরুষ কাঁকড়ার সামনের দাঁড়া দুটি দৃঢ় ও আকারে বড় হয়। উল্টো করে ধরে দেখলে অ্যাবডোমিনাল ফ্ল্যাপ পুরুষ কাঁকড়ার ক্ষেত্রে সরু ও চিকনাকৃতি। কিন্তু স্ত্রী কাঁকড়ার ক্ষেত্রে তা অর্ধ বৃত্তাকার হয়। স্ত্রী কাঁকড়া একসঙ্গে কয়েক লক্ষ ডিম বহন করতে পারে। নিষিক্ত হওয়ার ১৫-১৬ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা নির্গত হয়। বিভিন্ন লার্ভাদশাগুলি কাটিয়ে শিশু কাঁকড়া হতে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। কাঁকড়ার এই অবস্থার এ ধরণের বীজ সুন্দরবনের জোয়ার ভাটা প্লাবিত অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই মেলে। তবে তুলনায় বর্ষার প্রাক্কালে বেশি পাওয়া যায়।
আজ পর্যন্ত কাঁকড়ার প্রজনন সম্ভব হয়নি। যদিও চাষের সফলতা পাওয়া গিয়েছে। চাষের সময়সীমা দুই থেকে আড়াই মাস। এই চাষের মূল কথা হল, বেশি করে খাইয়ে স্ত্রী কাঁকড়ার ডিম্বাশয় বৃদ্ধি ও পুরষ কাঁকড়ার মাংস বৃদ্ধি করা, যাকে চলতি কথায় ক্র্যাব ফ্যাটেনিং বলা হয়। সুন্দরবনের সন্দেশখালি অঞ্চলে কাঁকড়া চাষের যথেষ্ট প্রসার হয়েছে। এখানকার মানুষ প্রথাগত চিংড়ি ও কৃষিজ ফসল চাষের সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়া চাষেও মনোযোগী হয়েছেন। এখানে মানুষের জীবন এবং জীবিকা তাই অনেকটাই উন্নত।
আরও পড়ুন:
স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৭: উত্তমের প্রশ্নে মজাদার জবাব ভানুর, হাসির বন্যা বয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়ো ফ্লোরে
কাঁকড়া সাধারণত অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় খোলস ত্যাগ করে বড় হয়। কাঁকড়ার ওজন যা থাকে, খোলস পরিবর্তনের পর তা অনেকটা বেড়ে যায়। বাজারে আজকাল নরম ও শক্ত দু’ ধরনের খোলসযুক্ত কাঁকড়ারই চাহিদা আছে। একটি এক বিঘা জমির ঘেরিতে আনুমানিক এক হাজার কেজির মতো কাঁকড়া চাষ করা যেতে পারে। এই চাষে ঝুঁকি কম। কারণ, কাঁকড়ার মৃত্যুর হার খুবই কম। রপ্তানিযোগ্য বাজার ও চাহিদা দুই আছে যথেষ্ট।
কাদা কাঁকড়া বা সেলার সেরেটা চাষের সময় দেখা গিয়েছে ১০০ কেজি কাঁকড়া ৫ কেজি মতো খাবার খায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় কৃষিজ ফসলের ওপর এখানে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। হয়তো সেই কারণেই এখানে মত্স্যজীবিরা ঘেরিগুলিতে কাঁকড়া চাষে মনোযোগী হয়েছেন। আবার লাভের মুখও দেখতে পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৬: রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রা সফল হল কি?
মাইগ্রেনও পুরোপুরি সেরে যেতে পারে, জেনে নিন এর থেকে বাঁচার সহজ উপায়
কাঁকড়ার বাজারজাতকরণে সেরকম কোনও অসুবিধা না থাকায় কাঁকড়া চাষ এখনও পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয়। কাঁকড়া চাষ এখন মানুষের জীবন ও জীবিকার কিছুটা হলেও উন্নতি করতে পেরেছে। হোটেল, রেস্তরাঁতে কাঁকড়ার যে কোনও পদই ভালো দামে বিকোয়। কারণ, স্বাদ ও পুষ্টিতে তা অতুলনীয়। তাই কাঁকড়া এখনও নজর কাড়ে মত্স্য রসিকদের।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।