বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণী মাছ আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সহজলভ্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার হিসেবেই শুধু নয়, আমাদের সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেও এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে মাছ। আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে মাছ চাষের সুযোগ ও বাজার দুটোই আছে। এখানে যে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে তার অনেকটাই এখনও অধরা।
আমাদের রাজ্যের মতো পরিবেশের এত বৈচিত্র্য বোধহয় আর কোথাও নেই। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কথাই যদি চিন্তা করি, দেখা যাবে উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য স্রোতের জলে দ্রুতগামী অগুণতি প্রজাতির মাছ আছে, মাঝের নদী পরিবেষ্টিত পলিসমৃদ্ধ সমতলের মাছও অনেক। সেই সঙ্গে আছে পশ্চিমের লাল মাটির জলের মাছ ও দক্ষিণের জোয়ার ভাটা সমৃদ্ধ উপকূলভাগের কত রকমের সুন্দর মাছ। এছাড়াও পুকুর, খাল, বিল এসবের সংখ্যা অগুণতি। যেখানে মিষ্টি জলে মিশ্র মাছ চাষ বহুল প্রচলিত।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

অজানার সন্ধানে: মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…

পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

মাছের ফলনের জন্য বারবার আমরা জাতীয় স্তরে সেরা পুরস্কৃত হলেও আমরা কিন্তু জানি মাছের ফলন ও বৈচিত্র্যে আমরা যে উচ্চতায় পৌঁছতে পারি, তার ধারে কাছে এখনও যেতে পারিনি। বাজারে গেলে সেই সাকুল্যে ১০-১২ প্রজাতির মাছই রোজ দেখা যায়। যদিও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় আড়াইশো প্রজাতির মাছ আমাদের রয়েছে। এছাড়া তো আছে পরিকল্পনাহীন মাছ চাষ, অনেক বেশি। পরিকল্পনা অনুযায়ী যেটুকু হয় তা খুবই কম।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ

আমাদের অনেক জলাশয় পতিত পড়ে থাকে। অথচ হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন উপকরণ ব্যবহার করে এবং পরীক্ষিত গ্রামীণ চিরাচরিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের ফলন বাড়িয়ে তোলা ও মৎস্য সম্পদের জীববৈচিত্র্য বজায় রেখে পদক্ষেপ গ্রহণ ও তাকে অগ্রাধিকারযোগ্য কার্যক্রম বলে বিবেচিত হতেই পারে। কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গ্রামের মানুষ মৎস্য সম্পদের জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার লক্ষ্যে কিছু জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে অভয়পুকুর বানিয়ে অনেক মাছের সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন। এই অভয় পুকুর অনেকটা অভয়ারণ্যের মতো। এখানে বিনা বাধায় বিপন্ন মাছগুলি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে এবং বেড়ে উঠতে পারে।
এই রকম সচেতনতা সার্বিক আকার নিক। এর সঙ্গে চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পুকুর কেমন হওয়া দরকার, তাদের প্রস্তুতিকরণ ইত্যাদি বা কোন মাছ কীভাবে চিনবো? নানান রকম মাছ একসঙ্গে কীভাবে চাষ করতে পারি? মাছ চাষের পুকুরে জল ও মাটির পরিচর্যা কেমন হবে? যাতে মাছ চাষও হবে আবার পুকুরের জলও গ্রামীণ গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহৃত হতে পারবে, মাছের খাবার স্থানীয়ভাবে জোগাড় করার উপকরণাদি দিয়ে কীভাবে বানাতে হবে? প্রয়োগ পদ্ধতিই বা কেমন হবে? যাতে খাবারও অপচয় হবে না জলও দূষিত হবে না, মাছের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি প্রয়োজনে কেমন হবে? স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে পদ্ধতিও সুসংহত পদ্ধতি সমন্বিত পালনে কৃৎ কৌশল ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১৩: পয়লা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’— অসম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্ব ঐতিহ্য

এইসব বিষয়গুলি নিয়ে সাবলীল বাংলায় ছবি-সহ পোস্টার ব্যানারের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। মূল উদ্দেশ্য হবে, আগামী দিনে যদি আমরা চাকরি সকলে নাও পাই স্থানীয় উদ্যোগে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে আমরা উপকৃত হতে পারি যাতে গ্রামের কেউ পিছিয়ে থাকবে না। সমস্ত গ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যপূরণে স্থানীয় উদ্যোগ বিশেষ গুরুত্ব পাবে। দেশীয় মাছচাষের বিস্তার ঘটিয়ে আয়ের পরিমাণ বাড়ানো যাবে। সেই বাজার নির্ভরশীলতাও কমাতে পারবো। বিভিন্ন জৈব উপাদানের আবর্তন ঘটিয়ে মাছ পালন ও সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খাদ্যের যোগান নিজের পুকুর জমি থেকে কীভাবে পেতে পারবো? মাছ চাষের উৎপাদন বৃদ্ধির এইসব চিন্তাকে সর্বস্তরে পৌঁছনোর চেষ্টা বিভিন্ন রকম পোস্টারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করলে নিশ্চয়ই তা ফলপ্রসু হবে।
সাধারণ কিছু সচেতনতার অভাবে আমরা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের কীভাবে ক্ষতি করে চলেছি তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিছু শিকারি মাছ বিদেশ থেকে আমাদেরণ জলাশয়ে চলে এসেছে এই মাছগুলির মধ্যে হাইব্রিড মাগুর, রূপচাঁদা জাতীয় রাক্ষুসে মাছ যে পুকুরে থাকে সেখানে আমাদের দেশীয় ছোট মাছগুলি টিকে থাকতে পারে না। এছাড়া ওই সব পুকুরের জলে গ্রামের মানুষ বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েরা নামা এবং স্নান করা সাঁতার কাটা, যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে। এইরকম বিষয়গুলি দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়।

কিছু মানুষের জন্য আমাদের নিঃশব্দে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে চলেছে। আমাদের দেশীয় মাছগুলি কি আর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে? যদি এই মাছগুলি আমাদের জলাশয় গুলিকে গ্রাস করে? কিছু ব্যানার পোস্টারের মাধ্যমে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞাপিত করলে সচেতনতা বাড়বে নিশ্চয়ই এবং সাধারণ মানুষ অবহিত হতে পারবেন এইসব বিষয়গুলি সম্পর্কে তাই এই ধরনের প্রচারে কিছুটাতো সাফল্য আসবেই, আশা করা যেতে পারে।—চলবে

ছবি: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content