প্রকৃতি আমাদের মা। জলই আমাদের জীবন। প্রকৃতি মায়ের অঙ্গনে পাই প্রাণভরা মুক্ত নিঃশ্বাস। আর জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবনের চাবিকাঠি। সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে উপরের কথাগুলির সত্যতা সর্বাগ্রে।
প্রকৃতি মায়ের বিভিন্ন দানের মধ্যে একটি হল নদী। অতীতের পাতায় লেখা আছে সভ্যতার সারবত্তা সেই নদীতীরেই। বর্তমান জনজীবনেও যার প্রভাব দৃশ্যমান। সেই নদীকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে কত মানুষ থেকে শুরু করে মাছ, বিভিন্ন জলজ প্রাণী, শৈবাল প্রভৃতি।
তিস্তা, তোর্সা, করলা, টাঙন, পুনর্ভবা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্য দিয়ে। যেমন—কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি। এই সমস্ত নদীর স্রোত সদা বহমান থাকার ফলে এই নদীগুলিতে কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ দেখা যায়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বরোলি। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম ব্যারিলিয়াস বেরিলা।
দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে এই মাছ পাওয়া যায় না। উত্তরবঙ্গের বাজারেই এই মাছের অবাধ বিচরণ। লম্বায় এই মাছ চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি হয়। এই মাছটি দেখতে কিছুটা বাটা মাছের মতো। আর জৌলুস এতটাই বেশি যে মনে হয় যেন হীরকদ্যুতি হচ্ছে। মাছটির স্বাদ এমনই যে রসনায় তুলনাহীন। উত্তরবঙ্গের হয়তো এমন কেউ নেই যিনি আহারে মাছটিকে রাখেননি। সকলেই একডাকে চেনে বহমান তিস্তায় ভাসা এই রাজাকে।
দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রুই, কাতলা মাছের নাম। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অতিথিদের আপ্যায়ন সবই হয় এই মাছ দিয়েই। সেইরূপ উত্তরবঙ্গের মানুষের কৃষ্টির সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাব দেখা যায় এই বরোলি মাছের। অতিথিদের তৃপ্তির নানারকম রেসিপি তৈরি হয় এই মাছের। এই মাছে আছে উচ্চমানের প্রোটিন এবং সেই সঙ্গে আছে অমূল্য কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড সাব অ্যামিনো অ্যাসিড যার দরুন স্বাদে ও স্বাস্থ্যে অতুলনীয় এই মাছ।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই মানুষ চায় কিন্তু পায় না এমন বিষয় কমই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং তৎসহ বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নানান মলে যেখানে রকমারি মাছ পাওয়া যায় সেখানে দেখা যায় দূরদূরান্তের মাছও আমাদের তালুবন্দি। আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছও দৃষ্টিগোচর হয় এবং আমরা চাইলে সেগুলিকে ক্রয় করতে পারি। কিন্তু আমাদের রাজ্যের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে যে বরোলি মাছ পাওয়া যায় তা বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যায় না। বর্তমান দিনে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফের বিভিন্ন খাঁচা তৈরি হলেও এই মাছকে সুস্থ ও সতেজ রাখবে এটা সম্ভব হয়নি। এই মাছ এতটাই মোলায়েম যে একে কোমলভাবে যত্ন করে না রাখতে পারলে ক্রেতার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
বরোলি মাছ প্রকৃতিজাত অর্থাৎ নদীতে আপনা থেকেই হয়। এই মাছ যখন খুবই ছোট স্পন বা ফ্রাই স্টেজে থাকে তখন তাদের নদী থেকে ধরে এনে চাষ করা যেতে পারে। মূলত দুই জায়গায় এই চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে—আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে। চাষ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ সফলতা না মিললেও কিছুটা সফলতা মিলেছে। হরমোনাল ইনজেকশন দিয়ে প্রজনন করা গেলেও পুরোপুরি পূর্ণতার জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি বদ্ধ জলাশয়ে।
নদীর বিভিন্ন দূষণের কারণে বরোলি মাছের বংশ বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং তাই সংখ্যাতেও কমে যাচ্ছে এই মাছ। আমরা যদি এই মাছটিকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি তাহলে এই মাছটিকে অবশ্যই যত্ন করে সংরক্ষণ করতে হবে। বনভূমি সংরক্ষণ করার জন্য যেমন বিভিন্ন অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে সেইরূপ এই মাছকে বাঁচানোর জন্য এমন কিছু গড়ে তুলতে হবে যেখানে মাছগুলি অবাধে থাকতে পারে। বরোলির জন্য অভয়ারণ্য আর সেরূপ যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমরা অচিরেই আমাদের রাজ্যের নিজস্ব মাছকে হারাব। সংরক্ষণের অভাবে বিপন্ন এই মাছ ও অন্য আরও মাছকে যদি না আমরা উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারি তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো ছবি হয়েই থাকবে এই মাছ।
ছবি সৌজন্য: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
প্রকৃতি মায়ের বিভিন্ন দানের মধ্যে একটি হল নদী। অতীতের পাতায় লেখা আছে সভ্যতার সারবত্তা সেই নদীতীরেই। বর্তমান জনজীবনেও যার প্রভাব দৃশ্যমান। সেই নদীকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে কত মানুষ থেকে শুরু করে মাছ, বিভিন্ন জলজ প্রাণী, শৈবাল প্রভৃতি।
তিস্তা, তোর্সা, করলা, টাঙন, পুনর্ভবা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির মধ্য দিয়ে। যেমন—কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি। এই সমস্ত নদীর স্রোত সদা বহমান থাকার ফলে এই নদীগুলিতে কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ দেখা যায়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বরোলি। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম ব্যারিলিয়াস বেরিলা।
দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে এই মাছ পাওয়া যায় না। উত্তরবঙ্গের বাজারেই এই মাছের অবাধ বিচরণ। লম্বায় এই মাছ চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি হয়। এই মাছটি দেখতে কিছুটা বাটা মাছের মতো। আর জৌলুস এতটাই বেশি যে মনে হয় যেন হীরকদ্যুতি হচ্ছে। মাছটির স্বাদ এমনই যে রসনায় তুলনাহীন। উত্তরবঙ্গের হয়তো এমন কেউ নেই যিনি আহারে মাছটিকে রাখেননি। সকলেই একডাকে চেনে বহমান তিস্তায় ভাসা এই রাজাকে।
দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রুই, কাতলা মাছের নাম। সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অতিথিদের আপ্যায়ন সবই হয় এই মাছ দিয়েই। সেইরূপ উত্তরবঙ্গের মানুষের কৃষ্টির সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাব দেখা যায় এই বরোলি মাছের। অতিথিদের তৃপ্তির নানারকম রেসিপি তৈরি হয় এই মাছের। এই মাছে আছে উচ্চমানের প্রোটিন এবং সেই সঙ্গে আছে অমূল্য কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড সাব অ্যামিনো অ্যাসিড যার দরুন স্বাদে ও স্বাস্থ্যে অতুলনীয় এই মাছ।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই মানুষ চায় কিন্তু পায় না এমন বিষয় কমই ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী এবং তৎসহ বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নানান মলে যেখানে রকমারি মাছ পাওয়া যায় সেখানে দেখা যায় দূরদূরান্তের মাছও আমাদের তালুবন্দি। আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছও দৃষ্টিগোচর হয় এবং আমরা চাইলে সেগুলিকে ক্রয় করতে পারি। কিন্তু আমাদের রাজ্যের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে যে বরোলি মাছ পাওয়া যায় তা বেশি দূর নিয়ে যাওয়া যায় না। বর্তমান দিনে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফের বিভিন্ন খাঁচা তৈরি হলেও এই মাছকে সুস্থ ও সতেজ রাখবে এটা সম্ভব হয়নি। এই মাছ এতটাই মোলায়েম যে একে কোমলভাবে যত্ন করে না রাখতে পারলে ক্রেতার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
বরোলি মাছ প্রকৃতিজাত অর্থাৎ নদীতে আপনা থেকেই হয়। এই মাছ যখন খুবই ছোট স্পন বা ফ্রাই স্টেজে থাকে তখন তাদের নদী থেকে ধরে এনে চাষ করা যেতে পারে। মূলত দুই জায়গায় এই চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে—আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারে। চাষ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ সফলতা না মিললেও কিছুটা সফলতা মিলেছে। হরমোনাল ইনজেকশন দিয়ে প্রজনন করা গেলেও পুরোপুরি পূর্ণতার জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি বদ্ধ জলাশয়ে।
নদীর বিভিন্ন দূষণের কারণে বরোলি মাছের বংশ বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং তাই সংখ্যাতেও কমে যাচ্ছে এই মাছ। আমরা যদি এই মাছটিকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি তাহলে এই মাছটিকে অবশ্যই যত্ন করে সংরক্ষণ করতে হবে। বনভূমি সংরক্ষণ করার জন্য যেমন বিভিন্ন অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে সেইরূপ এই মাছকে বাঁচানোর জন্য এমন কিছু গড়ে তুলতে হবে যেখানে মাছগুলি অবাধে থাকতে পারে। বরোলির জন্য অভয়ারণ্য আর সেরূপ যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমরা অচিরেই আমাদের রাজ্যের নিজস্ব মাছকে হারাব। সংরক্ষণের অভাবে বিপন্ন এই মাছ ও অন্য আরও মাছকে যদি না আমরা উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারি তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো ছবি হয়েই থাকবে এই মাছ।
ছবি সৌজন্য: লেখক
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।