শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ।

কুকুর, বিড়াল, পাখি প্রভৃতি প্রাণী আমাদের প্রিয় পোষ্য। আমরা তাদের ভালোবাসি। কেউ কেউ এদের কাছেও রাখেন। যদিও এই সব প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের জিনের মিলের থেকে অমিলই বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু এমন একটি প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ মানব জিনের সঙ্গে অভূতপূর্ব মিল রয়েছে। আমি আজ সেই প্রাণীটিকে নিয়েই আলোচনা করব।

‘জেব্রা ফিশ’ নামক একটি মাছ আছে। এটি সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়াম ফিশ হিসাবেই বেশি পরিচিত। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশের মাছ হল এটি। এককথায় বললে এটি এশিয়া মহাদেশেরই মাছ।

‘জেব্রা ফিশ’ এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে। এই খ্যাতি অর্জন করেছে এমন মাছের সংখ্যা কিন্তু বেশি নেই। মাছটির দৈর্ঘ্য ৫-৬ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চির মতো হয়। এটিই এই মাছের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য। এদের শরীরে জেব্রার মতো সাদা-কালো ডোরা কাটা দাগ থাকে বলে এর নাম ‘জেব্রা ফিশ’।
এই ছোট্ট একটি মাছ কীভাবে আন্তর্জাতিক স্তরের মাছ হয়ে উঠল এবং পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা একে নিয়ে গবেষণা করছেন তা আলোচনার বিষয়। সমগ্র পৃথিবীর জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এমন বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনও প্রতিষ্ঠান তাঁরা গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করছে। আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিবারের গবেষণাতে উঠে আসছে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য, যা নতুন দিককে উন্মোচিত করেছে।

যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা এই মাছকে নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁদের বক্তব্য, ‘জেব্রা ফিশ’ আগামীদিনে অনেক সমস্যার সমাধান করবে। সব থেকে অবাক করা তথ্য হল —এই মাছটির সঙ্গে মানুষের জিনের প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি মিল রয়েছে! এই মিল থাকার কারণে মনে করা হচ্ছে, এই মাছটি থেকে আমাদের সমস্যা নিরসনে হয়তো কিছুটা হলেও উপকার মিলতে পারে। বিশেষ করে জিনঘটিত বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে। যেমন-কোনও শিশু হয়তো জন্মগত সমস্যা নিয়ে জন্মালো, সেই সমস্যার সমাধানে ডাক্তারবাবু কিছুই করতে পারবেন না। কিন্তু এই মাছটি আমাদের সমস্যা সমাধানে হয়তো নতুন দিশা দেখাতে চলেছে।
আরও পড়ুন:

পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১০: কান্না-হাসির দোল দোলানো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ [২০/০২/১৯৫৩]

বাস্তুবিজ্ঞান, পর্ব-১৪: আধুনিক কম্পাসে খুব সহজেই জমির দিক, অঞ্চল ও কোণ নির্ণয় করা যায়

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১২: বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র বিরোধের ইতিবৃত্ত

বিজ্ঞানীরা প্রথমেই খুঁজেছেন এদের শরীরে যে জিন আছে তার সমস্ত খুঁটিনাটি। আমাদের মানব শরীরে তেইশ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। তার মধ্যে বাইশ জোড়া হল সাধারণ এবং আর এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম। একএকটি জিনের মধ্যে যে পরিমাণ ডিএনএ থাকে তাতে এক একটি প্রোটিন তৈরির নকশা থাকে। সব থেকে বড় সুবিধা হল — ‘জেব্রা ফিশ’-এর ওই নকশা থেকে শুরু করে তার সমস্ত জেনোমের সিকোয়েন্স আমরা জেনে গিয়েছি। এর ফলে এই মাছে কী কী বৈশিষ্ট্য আছে তা আমরা বিস্তৃত ভাবেই জানতে পেরেছি। আর সেই কারণেই মানব শরীরের জিনের সঙ্গে এর সাদৃশ্যের কথা আমরা বলতে পারি।

এই মাছটির একটি বিশেষ সুবিধা হল, এদের রেটিনাতে যদি কোনও অসুখ করে তাহলে এরা নিজেরাই তা ঠিক করে নেয়। যেহেতু এই মাছের সঙ্গে মানুষের মিল রয়েছে তাই এই জেব্রা ফিশ আমাদের চোখের রোগও সারিয়ে তুলতে পারে। শুধু সারিয়ে তুলতে পারে তাই নয়, পুরোপুরি সুস্থও করে তুলতে পারে। যে সমস্ত মানুষের বয়স বেড়ে গিয়েছে বার্ধক্যজনিত কারণে চোখে কম দেখছেন অর্থাৎ রেটিনার সমস্যা হচ্ছে তাঁদেরকে এই জেব্রা ফিশের জিন ট্রান্সপ্লান্ট করিয়ে ভবিষ্যতে রেটিনা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
আরও পড়ুন:

ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

সহজে ঘুম আসে না? অনিদ্রায় ভুগছেন? সমস্যার সমাধানে বদলে ফেলুন রাতের পোশাক!

নিয়মিত দই খান? এতে শরীরের ক্ষতি করছেন না তো? জেনে নিন দই খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি

ইংলিশ টিংলিশ: জানো কি ‘বাজি ফাটানো’ কিংবা ‘মোমবাতি জ্বালানো’র ইংরেজি কী?

 

একঝলকে ‘জেব্রা ফিশ’

এই মাছ বাঁচে সাধারণত দুই থেকে তিন বছর। কিন্তু যত্ন করে রাখলে পাঁচ বছরও বাঁচতে পারে।
একটি স্ত্রী জেব্রা ফিশ প্রায় ৫০০ ডিম পাড়ে।
তিন থেকে চার মাস অর্থাৎ অল্প দিনের মধ্যেই এই মাছ পূর্ণতা পায়।
এদের জিনকে খুব সহজেই সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
মূলত উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণাই হল এদের খাবার।
‘জেব্রা ফিশ’কে কেউ রাখতে চাইলে দলবদ্ধ ভাবে রাখতে হবে।
এই মাছের একটি বড় সুবিধা হল—এদের কোনও অঙ্গ নষ্ট বা ক্ষতি হলে তাকে পুনর্গঠন করতে পারে।

স্তন্যপায়ী না হয়েও ‘জেব্রা ফিশ’ মানুষের খুব কাছের একটি প্রাণী। বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, আগামীদিনে এই মাছ বিভিন্ন রকম জিনঘটিত অসুখ সারাতে নতুন দিশা দেখাবে।

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content