বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সময় বয়ে চলে তার আপন স্রোতে। অতীতের মায়া কাটিয়ে, বর্তমানকে দুর্ভেদ্য করে চলে যায় দূর ভবিষ্যতে।সে খানে দাঁড়িয়ে অতীতের কাজ বা ঘটনাগুলি স্মৃতির সংজ্ঞা লাভ করে। কখনও কখনও কল্পনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে সেদিনের সে দৃশ্যবলি।

বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে যে কয়েকটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে তার মধ্যে একটি বলা যেতে পারে রুইমাছ। গ্রামবাংলার লোককথাতেও রুইমাছের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, ‘মাছের রাজা রুই’ এইরূপ বাক্যের দ্বারা। আমাদের আজকের আলোচনা এক অন্য প্রকার রুইমাছ নিয়ে, যে উন্নতমানের মাছের নামকরণ করা হয়েছে ‘জয়ন্তী রুই’।
 

রুইমাছের কেন এরকম একটি নামকরণ করা হল?

এরই বিবৃতি প্রকাশ পাবে আজকের লেখনীতে। ভারতে মাছ উৎপাদনের ভারসাম্য নির্ভর করে রুই, কাতলা, মৃগেলের উৎপাদনের উপর। কিন্তু কাতলা ও মৃগেল চাষ করে চাষি যে আনন্দ পান, রুই চাষ করে তা সম্ভব হয় না। মূলত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তাঁকে। এর কারণ হল কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছের বৃদ্ধি যতটা দ্রুত হারে হয় রুইমাছের বৃদ্ধি সেরূপ হয় না। অত্যন্ত ধীর ভাবে বৃদ্ধি পায় এই মাছ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যদি কাতলা মাছ একবছরে দু’ কেজি হয়, সেই দিক থেকে রুইমাছ এক কেজিও হয় না। এক কেজি রুইমাছ আমাদের পছন্দ নয়, আমাদের পছন্দ দেড় কেজি বা তার বেশি ওজনের মাছ। আর এই ওজনের রুই পেতে গেলে চাষির সময় লাগবে প্রায় এক বছর ছয় মাস। তাই এত দিন ধরে তাকে রেখে চাষ করা চাষির কাছে বিড়ম্বনারই নামান্তর।

ক্রেতার কাছে রুইমাছের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে, পাশাপাশি চাষিদের কাছেও এর আকর্ষণীয়তা রক্ষার্থে সিআইএফএ (Central institute of freshwater Aquaculture) ভুবনেশ্বর একটি গবেষণার প্রকল্প নেয়। প্রকল্পটি হল কী উপায়ে স্বল্প সময়ে রুইমাছের বৃদ্ধি ঘটানো যায়। রুইমাছের বৃদ্ধির জন্য প্রথমে যে পদক্ষেপটি নেওয়া হল, তা হল বিভিন্ন নদী থেকে (গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, গোমতী) পুরুষ ও স্ত্রী রুইমাছ সংগ্রহ করা হল। তারপর গঙ্গার পুরুষ মাছের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের স্ত্রী মাছের ব্রিডিং করানো হল, যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় সিলেকটিভ ব্রিডিং।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩১: স্বাদ-বৈচিত্র্যে অতুলনীয় মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ

অমরনাথের পথে, পর্ব-২: লিডারের তীরে তখন যাত্রীদের তাঁবুর মেলা…

এটি একটি দীর্ঘদিনের প্রকল্প। দীর্ঘদিনের এই প্রকল্পে সিআইএফএ কর্তৃপক্ষ নরওয়ে সরকারের সাহায্য নিলেন। ১৯৯২ সালে নরওয়ে সরকারের যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা যুক্ত হলাম তার নাম ইন্সটিটিউট অব অ্যাকোয়াকাচার রিসার্চ। যে প্রকল্পে আমরা কাজ করলাম সেটি হল একেভিএএফওআরএককে (AKVAFORSK)। ১৯৯৩ সালে কাজ শুরু হলেও দীর্ঘদিন এই গবেষণা চলে। পাঁচ বছর পর দেখা গেল আমরা একটি উন্নতমানের রুইমাছ পাচ্ছি, যে রুই পরবর্তী প্রজন্মে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে না।
 

প্রথমে দেখা হল এই মাছের বৃদ্ধি কেমন?

পাঁচটি প্রজন্ম পরীক্ষা করে দেখা গেল যে প্রতি প্রজন্মে এই মাছের কুড়ি শতাংশ করে বৃদ্ধি ঘটছে। মাছের এই বৃদ্ধিরও অনেক রকম দিক আছে যেগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খতার সঙ্গে দেখে সিদ্ধান্তে আসা গেল যে এর বৃদ্ধি খুব ভালো হচ্ছে।

১৯৯৭ সালে আমরা গবেষণায় সফল হলাম। এবার শুধু মাছের মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। সে সময় এই সংবাদ শুনে খুব খুশি হলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন চতুরানন মিশ্রও। উনি এই মাছটিকে দেখে বললেন, মাছটির একটি নামকরণ করুন। যেহেতু এটি সাধারণ রুই নয়, তাই এর নামকরণটি আবশ্যক। তিনিই আমাদের বললেন, এখন ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ (আইসিএআর) এর স্বর্ণজয়ন্তী চলছে। তাই আপনার যদি মনে করেন স্বর্ণজয়ন্তীর ‘জয়ন্তী’ শব্দটিকে নিয়ে একটি নামকরণ করুন। সেই থেকেই মাছটির নাম হয়ে গেল ‘জয়ন্তী রুই’।

আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৩: রাজা থেকে ঋষি — উত্তরণের আলোকপথযাত্রী বিশ্বামিত্র

মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কতটা ক্ষতিকর? জানুন চিকিৎসকের মতামত

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৬: বসুন্ধরা এবং…

এই গবেষণায় যাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন—ড. ত্রিপাঠি, ড. রেড্ডি, ড. জানা এবং ড. দাস মহাপাত্র। বিভিন্ন সময়ে গবেষণার মূল হোতা ছিলেন এই চারজনই। তারপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি প্রধান হয়েছেন। আমিও প্রধান ছিলাম একটি সময়ে। এই গবেষণাকে কেন্দ্র করে আমাদের স্লোগান ছিল— কোয়ালিটি ইনক্লুডস কোয়ানটিটি (Quality Includes Quantity)। আমার দায়িত্ব ছিল, এদের খাবার কী হবে। খাবার নিয়ে আমরা অনেক কিছু বিচার বিবেচনা করেছি। তখন আমরা এদের খাবারের কম্পোজিশন বের করলাম। সেটি হল—বাদমখোল ৩৩%, চালের পালিশ কুঁড়ো ৩৫%, সয়াবিন মিল ২৫%, ফিশ মিল ৫%, ভিটামিন ও খনিজের মিশ্রণ ২%। চাউমিন আকারে এই খাবার তাদের দেওয়া হয়। এই খাবারই ওদের বেশি পছন্দ। আর অদের বৃদ্ধিও খুব দ্রুত ঘটতে থাকলো।
এই ‘জয়ন্তী রুই’ হল আমাদের দেশের গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা একটি উন্নততর মাছ। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই মাছের বৃদ্ধি সম্পর্কিত পরীক্ষা করা হল। তারপর সেই বৃদ্ধির তথ্যও নেওয়া হয় সেই প্রদেশ বা সেই রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা দপ্তরের কাছ থেকে। সব সরকারি তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের পর জানা গেল ‘জয়ন্তী রুই’-র বৃদ্ধি হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে। রঙের দিক থেকেও চমৎকারিত্ব আছে।
১৯৯৩ সালে শুরু হয়েছিল যে গবেষণা, তা এখনও চলছে। আরও উন্নতি লাভ করছে। যেমন এই ‘জয়ন্তী রুই’-র রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অ্যারোমোনিয়াসিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া কারণে এই মাছের রোগ দেখা দেয়। কিন্তু এখন এই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম এই মাছ। ফলে চাষির কাছেও এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাই চাষি যদি ‘জয়ন্তী রুই’ চাষ করেন তাহলে তিনি সবদিক থেকে যে লাভবান হবেন তা বলাইবাহুল্য।

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content