বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে যে কয়েকটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে তার মধ্যে একটি বলা যেতে পারে রুইমাছ। গ্রামবাংলার লোককথাতেও রুইমাছের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, ‘মাছের রাজা রুই’ এইরূপ বাক্যের দ্বারা। আমাদের আজকের আলোচনা এক অন্য প্রকার রুইমাছ নিয়ে, যে উন্নতমানের মাছের নামকরণ করা হয়েছে ‘জয়ন্তী রুই’।
রুইমাছের কেন এরকম একটি নামকরণ করা হল?
এরই বিবৃতি প্রকাশ পাবে আজকের লেখনীতে। ভারতে মাছ উৎপাদনের ভারসাম্য নির্ভর করে রুই, কাতলা, মৃগেলের উৎপাদনের উপর। কিন্তু কাতলা ও মৃগেল চাষ করে চাষি যে আনন্দ পান, রুই চাষ করে তা সম্ভব হয় না। মূলত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তাঁকে। এর কারণ হল কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি মাছের বৃদ্ধি যতটা দ্রুত হারে হয় রুইমাছের বৃদ্ধি সেরূপ হয় না। অত্যন্ত ধীর ভাবে বৃদ্ধি পায় এই মাছ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যদি কাতলা মাছ একবছরে দু’ কেজি হয়, সেই দিক থেকে রুইমাছ এক কেজিও হয় না। এক কেজি রুইমাছ আমাদের পছন্দ নয়, আমাদের পছন্দ দেড় কেজি বা তার বেশি ওজনের মাছ। আর এই ওজনের রুই পেতে গেলে চাষির সময় লাগবে প্রায় এক বছর ছয় মাস। তাই এত দিন ধরে তাকে রেখে চাষ করা চাষির কাছে বিড়ম্বনারই নামান্তর।
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩১: স্বাদ-বৈচিত্র্যে অতুলনীয় মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ছোটদের যত্নে: সুস্থ ও পরিপুষ্ট সন্তানের জন্য এগুলি মেনে চলছেন তো? সন্তানসম্ভবাদের জরুরি পরামর্শে শিশু বিশেষজ্ঞ
অমরনাথের পথে, পর্ব-২: লিডারের তীরে তখন যাত্রীদের তাঁবুর মেলা…
প্রথমে দেখা হল এই মাছের বৃদ্ধি কেমন?
পাঁচটি প্রজন্ম পরীক্ষা করে দেখা গেল যে প্রতি প্রজন্মে এই মাছের কুড়ি শতাংশ করে বৃদ্ধি ঘটছে। মাছের এই বৃদ্ধিরও অনেক রকম দিক আছে যেগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খতার সঙ্গে দেখে সিদ্ধান্তে আসা গেল যে এর বৃদ্ধি খুব ভালো হচ্ছে।
১৯৯৭ সালে আমরা গবেষণায় সফল হলাম। এবার শুধু মাছের মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। সে সময় এই সংবাদ শুনে খুব খুশি হলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন চতুরানন মিশ্রও। উনি এই মাছটিকে দেখে বললেন, মাছটির একটি নামকরণ করুন। যেহেতু এটি সাধারণ রুই নয়, তাই এর নামকরণটি আবশ্যক। তিনিই আমাদের বললেন, এখন ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ (আইসিএআর) এর স্বর্ণজয়ন্তী চলছে। তাই আপনার যদি মনে করেন স্বর্ণজয়ন্তীর ‘জয়ন্তী’ শব্দটিকে নিয়ে একটি নামকরণ করুন। সেই থেকেই মাছটির নাম হয়ে গেল ‘জয়ন্তী রুই’।
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৩: রাজা থেকে ঋষি — উত্তরণের আলোকপথযাত্রী বিশ্বামিত্র
মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কতটা ক্ষতিকর? জানুন চিকিৎসকের মতামত
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৬: বসুন্ধরা এবং…
এই ‘জয়ন্তী রুই’ হল আমাদের দেশের গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা একটি উন্নততর মাছ। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই মাছের বৃদ্ধি সম্পর্কিত পরীক্ষা করা হল। তারপর সেই বৃদ্ধির তথ্যও নেওয়া হয় সেই প্রদেশ বা সেই রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা দপ্তরের কাছ থেকে। সব সরকারি তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের পর জানা গেল ‘জয়ন্তী রুই’-র বৃদ্ধি হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে। রঙের দিক থেকেও চমৎকারিত্ব আছে।
১৯৯৩ সালে শুরু হয়েছিল যে গবেষণা, তা এখনও চলছে। আরও উন্নতি লাভ করছে। যেমন এই ‘জয়ন্তী রুই’-র রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। অ্যারোমোনিয়াসিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া কারণে এই মাছের রোগ দেখা দেয়। কিন্তু এখন এই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম এই মাছ। ফলে চাষির কাছেও এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাই চাষি যদি ‘জয়ন্তী রুই’ চাষ করেন তাহলে তিনি সবদিক থেকে যে লাভবান হবেন তা বলাইবাহুল্য।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।