রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


যে সব মাছ আমরা খাই বা আমাদের রাজ্যে যেগুলি চাষ করা হয় সেই মাছগুলির মধ্যে একটি বিশেষ প্রজাতির মাছ আছে, যাদের স্বাদ খুবই অতুলনীয়। আর এই সুন্দর স্বাদ হওয়ার কারণে বহু মানুষ এই মাছগুলিকে পছন্দও করেন। যতই আমরা রুই, কাতলা মাছ পছন্দ করি না কেন, ওই মাছের বিশেষ কদর রয়েছে আমাদের কাছে। ওই মাছ ‘ক্যাট ফিশ’ নামে পরিচিত।

শিঙ্গি, মাগুর, পাবদা, ট্যাংরা প্রভৃতি এই ‘ক্যাট ফিশ’ প্রজাতিরই মাছ। এগুলি আমাদের পছন্দের মাছ হলেও এর চাষ সেভাবে হয় না। ফলে বাজারে যেমন মাছের যোগান থাকা উচিত, তেমন থাকে না। এর ফলে দামও থাকে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। পোনা মাছের উপর আমাদের রাজ্যের মানুষের ঝোঁক এত বেশি যে ‘ক্যাট ফিশ’ চাষের কথা তাঁরা ভাবেনই না।
এই মাছগুলিকে যদি আমরা চাষের আওতায় নিয়ে আসি, তাহলে আর আমাদের ভিনরাজ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। বিভিন্ন ধরনের ট্যাংরা, পাবদা, শিঙ্গি, মাগুর, হোরা ব্যাগারাস বা হলদে ক্যাট ফিশ (মালাবার পশ্চিম উপকূলে পাওয়া যায়) প্রভৃতি মাছ চাষে অল্প বিস্তর কষ্ট আছে। এদের কাঁটা থাকার কারণে পুকুরে নেমে এদের ধরা একটু মুশকিল হয়।

কিন্তু এই সমস্যার সমাধানও আছে। উরু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বিশেষ একটি গার্ড দিয়ে পা দুটিকে ঢেকে রাখা হয়। এর ফলে কাঁটা ফুটে সম্ভাবনা থাকে না। তাই এই মাছ চাষের প্রধান প্রতিবন্ধক যে এর কাঁটা তার ভয়টি থাকছে না। তাই এই মাছ এখন নিশ্চিন্তেই চাষ করা যেতে পারে। চাষ করা হলে মাছের যোগানও বাড়বে। স্বাভাবিক ভাবে সহজপাচ্য এই সব মাছের জন্য আর অন্যরাজ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।
 

উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য

বিড়ালের মতো গোঁফ থাকার কারণে ‘ক্যাট ফিশ’ নামকরণ করা হয়েছে।
এদের পুরো শরীরে কাঁটা থাকে না। এরা এক কাঁটার মাছ। তাই ছোট থেকে বড় সকলের খেতে পারেন এই মাছ।
এদের জিওল মাছও বলা হয়।
জলে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম থাকলেও এদের কোনও অসুবিধা হয় না।

আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৫: হৃদয়ে হৃদয় মিলল মিথিলা অযোধ্যার

অবাধ অ্যান্টিবায়োটিক ডেকে আনছে বড় বিপদ, সতর্ক হন এখনই

ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৩৫: বসুন্ধরা এবং…

 

ট্যাংরা মাছ চাষের পদ্ধতি

মার্চ-এপ্রিল মাসে পরিণত পুরুষ ও স্ত্রী ট্যাংরা মাছ সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত পরিণত স্ত্রী মাছের ওজন হয় ২৫ গ্রাম। আর পরিণত পুরুষ মাছের ওজন হয় কমবেশি ১৫-২০ গ্রাম।
পরিণত পুরুষ ও স্ত্রী ট্যাংরাকে এখন হরমোনাল ইনজেকশন দেওয়া হয় খুব অল্প পরিমাণে। ইনজেকশন দেওয়ার পরে ওই পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ৩:২ অনুপাতে কিঞ্চিৎ লবণ জলে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে জলের গভীরতা হবে ৪-৬ ইঞ্চির মধ্যে।

আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল

ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকির মধ্যে আপনি নেই তো? সতর্ক হতে হবে গোড়াতেই/ পর্ব: ১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৪: জাপানি-কুকুর পুষেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ

সাধারণত ১০-১২ ঘণ্টা পরে স্ত্রী মাছ ডিম পাড়ে। অন্য মাছের ডিমের সঙ্গে এদের ডিমের পার্থক্য হল, এদের ডিম সামান্য আঠালো হয়। এই ডিমগুলি আটকে থাকে কোনও ইঁটের দেওয়ালে বা ছোট গাছের ডালে। সেই ডিমগুলি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয় এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জলাশয়ে রেখে দিলে ২ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তারপর অল্প অল্প করে প্রাণীকনা খাবার দেওয়া হয়। এদের মৃত্যুর হার কম হওয়ার কারণে এরা সহজেই বেড়ে যায়।

কিছু আনুষঙ্গিক খরচ-সহ আটটি পরিণত পুরুষ ও স্ত্রী মাছ যদি আমরা কিনি এবং প্রাণীকনা যুক্ত খাবারের যোগান দিই তাহলে কমবেশি ১৮০০ টাকার মতো খরচ হবে। তিনটি স্ত্রী ট্যাংরা প্রায় পাঁচ হাজার ডিম বা বাচ্চা দেয়। দেখার বিষয় হল, ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর সময় কত টাকা খরচ হয়েছে আর ওই মাছগুলিকে বিক্রির পর কত আয় হল।
কেউ যদি মনে করেন চাষ করবেন না, তাহলে শুধু বীজ উৎপাদনও করতে পারেন। তাঁরা এর পোনা বিক্রি করে দিতে পারেন। কারণ, এই মাছ চাষে উৎসাহী ব্যক্তি অনেক সময় বীজ পান না। এই মাছের খাবারে আমিষের পরিমাণ থাকতেই হবে। তাই খাবার কিনতে হয়। আর একটি সুবিধা হল, এই মাছ খুব বড় না হওয়ার কারণে দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে বিক্রি করে দিতে যায়। অর্থাৎ বিনিয়োগের টাকা অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে চলে আসে।

বক্তব্য হল, শিঙ্গি, মাগুর, পাবদা প্রভৃতি মাছের চাষ হবে একই নিয়মে অর্থাৎ ট্যাংরার মতোই। অন্যান্য মাছের সঙ্গে (রুই, কাতলা, মৃগেল) এই ‘ক্যাট ফিশ’ প্রজাতির মাছকে সঙ্গী ফসল হিসাবে চাষ করা যেতে পারে। আমাদের রাজ্যের মাছ চাষে নতুন একটি দিগন্তের কথা চাষিদের ভাবতেই হবে। এই মাছগুলি চাষের প্রসার হোক, যেটি আমাদের কাম্য। এই সব সুস্বাদু মাছকে চাষের আওতায় আনতে না পারলে আগামী দিনে আমরা যে শুধু এর স্বাদ-বৈচিত্র্য থেকেই বঞ্চিত হব তাই নয়, এরা হবে লুপ্ত।

ছবি: লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content