বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


বৈচিত্র্যে ও রসনা তৃপ্তিতে আমাদের ভালো লাগার উৎকৃষ্ট খাদ্য মাছ। পুষ্টিগুণ যে এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে আছে তা বলাই বাহুল্য। মিষ্টি জলের মাছ নিয়ে ইতিপূর্বেই বহু আলোচনা হয়ে গিয়েছে। তাই বিষয়েও বৈচিত্র্য রক্ষার্থে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় সামুদ্রিক মাছ।

আমাদের দেশে সমুদ্র উপকূল আছে প্রায় ৭০০০ কিলোমিটার। পৃথিবীর খুব কম দেশেই সমুদ্রের ব্যপ্তি এমন দেখা যায়। যার মধ্যে মাত্র ২০০ কিলোমিটার পড়ছে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। এই ২০০ কিলোমিটারের ব্যপ্তি মূলত দুটি জেলায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও পূর্ব মেদিনীপুর। উত্তর চব্বিশ পরগণায় সমুদ্র উপকূল থাকলেও তার ব্যপ্তি খুবই সামান্য। মাত্র ২০০ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলের ব্যপ্তি হলেও অনেক মাছ রয়েছে এর মধ্যে। প্রথমেই যে মাছটির নাম আমাদের করতে হয় তা হল ইলিশ। কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্যই ইলিশকে আমরা পাই।
 

সারাবছর পাওয়া যায় এমন কিছু সামুদ্রিক মাছ

সারাবছর পাওয়া যায় এমন সামুদ্রিক মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, তোপসে, পার্সে, সিলভার, পমফ্রেট, সামুদ্রিক বেলে, লটে মাছ বা বোম্বে ডাক, ভেটকি, পায়রা চাঁদা। তবে এছাড়াও আরও বিভিন্ন রকমের মাছ রয়েছে।
 

সমুদ্রে জাত কিছু মূল্যবান প্রাণী

মাছ ব্যতীত আরও কিছু মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায় সমুদ্রে। যেমন: রাজকাঁকড়া বা অশ্বখুরাকৃতি কাঁকড়া যেটি ভেষজ গুণে ভরপুর। এর চাহিদাও রয়েছে যথেষ্ট। এছাড়াও বিনোদনের জন্য রয়েছে বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন: সাগরকুসুম, নীলচাকতি প্রভৃতি। এগুলি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও অ্যাকোরিয়ামে রেখে সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে বিশেষ সহায়ক।
 

শরীর ও স্বাস্থ্যে সামুদ্রিক মাছ

স্বাস্থ্যের দিক থেকে সামুদ্রিক মাছ মিষ্টি জলের মাছের তুলনায় অনেক বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। সামুদ্রিক মাছ থেকে পাওয়া দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যসিড তো মিষ্টি জলের মাছ, এমনকি সবজি থেকেও খুব একটা পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-২৯: জীবন-জীবিকায় পুণ্যসলিলা গঙ্গা, হারিয়ে যাওয়া নদীয়ালি মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে আমাদেরই

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৫: শ্যুটিংয়ের মজার গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২: এক ছবিতে অনেক ‘কামনা’ [০৪/০৩/১৯৪৯]

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৮: কুশরাজার দেশে এলেন কৌশিক বিশ্বামিত্র

যাঁরা সামুদ্রিক মাছ খান তাঁদের সাধারণত এই পুষ্টিগুলির অভাব হয় না। আর এই পুষ্টিগুলির অভাব যাঁদের নেই তাঁদের হার্টের সমস্যাও কম। আমাদের দেশে প্রতি বছর যত সংখ্যক মানুষ মারা যান (অসংক্রমিত রোগহীন) তাঁদের বেশিরভাগটিই হার্টের সমস্যার কারণে। আর এই হার্টের সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণে আনে দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যসিড, যা আমরা সামুদ্রিক মাছ থেকে পাই। তাই সপ্তাহে অন্তত একদিন সামুদ্রিক মাছ খাওয়া উচিত।

আমাদের রাজ্যে এই সামান্য তটরেখার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করেন। সমুদ্র উপকূলকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও জীবিকার জন্যই বহু মানুষ এই অঞ্চলে থাকেন। শুধু আমাদের রাজ্যেই নয় সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা সাধারণত ঘনজনবসতি পূর্ণ হয়, যেমন: মুম্বই, চেন্নাই প্রভৃতি জায়গায়।
পূর্বে উল্লিখিত দুটি উপকূলবর্তী জেলায় মৎস্য বন্দর আছে তিনটি। পেটুয়াঘাট মৎস্য বন্দর ও শংকরপুর মৎস্য বন্দর। এই দুটিই পূর্ব মেদিনীপুরে রয়েছে। আর একটি হল, ফ্ৰেজাররগঞ্জ মৎস্য বন্দর, যেটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় অবস্থিত।

এই সামুদ্রিক প্রাণীগুলির সঙ্গে ডাঙার প্রাণীদের একটি বিশেষ পার্থক্যও আছে। সেটি হল, সমুদ্রের প্রাণীরা কিন্তু ডাঙা প্রাণীদের উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু ডাঙার প্রাণীরা পুরোপুরি সমুদ্রের প্রাণীদের উপর নির্ভরশীল। জলে যে প্রাণীগুলি বাস করে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে ডাঙার প্রাণীরা অর্থাৎ আমরা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নই, আমরা ওদের উপর নির্ভরশীল।
সমুদ্র উপকূলে এখন বহু মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। সেইসব মাছ অতীতে পাওয়া যেত। এই সব মাছ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ুর প্রভাব এবং দূষণ। এছাড়াও অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত এই সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে আমরা প্রাণীগুলিকে বিপন্ন করে ফেলছি। যেমন: সুন্দরবন অঞ্চলে চিংড়ির মীন সংগ্রহের জন্য হাজারো হাজারো অন্যান্য মাছের মীনকে নষ্ট করা হচ্ছে। ফলে তারা বড় হতে পারছে না। এই বিষয়ে যদি আমরা একটু যত্নবান হই তাহলে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে যেটুকু মাছের সম্পদ আমরা পাই সেটুকু যদি সংরক্ষণ করতে পারি তাহলে আগামী দিনেও একই ভাবে এই জীবন যাপনের ধারা চলতে থাকবে বলে মনে হয়।

ছবি: লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content