শনিবার ১০ মে, ২০২৫


গ্রাম থেকে শুরু করে মফস্বলের মাছের বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেলের সম্ভার অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেকটাই বেশি থাকে। বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে সামুদ্রিক মাছগুলি ওই সমস্ত বাজারে ভিড় জমালেও বেশিরভাগ সময়ই কিন্তু পোনামাছদের বিচরণ থাকে। আর এই পোনামাছের পাশাপাশি বাজারে দেখা যায় যে মাছ, তা হল— চুনোপুঁটি। চুনোপুঁটি বলা হয় এই কারণেই যে, এই মাছগুলিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো না বা এখনও হয় না। সেই চুনোপুঁটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা প্রভৃতি। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়—পুঁটি।
 

এখানে সাধারণত তিন ধরনের পুঁটিমাছ পাওয়া যায়

পুন্টিয়াস স্টিগমা (Puntius Stigma)
পুন্টিয়াস টিক্টো (Puntius Ticto)
পুন্টিয়াস ভিটাটাস (Puntius Vittatus)

 

গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য

এই মাছ প্রায় দুই থেকে তিন ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের একটি অদ্ভুত ব্যাপার হল, স্ত্রী পুঁটির তুলনায় পুরুষ পুঁটি আকারে খুব ছোট হয়। স্ত্রী পুঁটি পুরুষ পুঁটির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়! পুরুষ পুঁটির পাখনা ও আঁশের রং হলুদ বা সোনালি হয়। স্ত্রী পুঁটির পাখনাটি উজ্বল বেগুনি বা একটু লাল রঙের দেখা যায়। আঁশ হয় চকচকে রুপালি রঙের।

পুঁটি মাছ সাধারণত পুকুরের অগভীর জলে ডিম পাড়ে। এক একটি মাছ সর্বাধিক ২০০ কাছাকাছি ডিম দেয়। মে-জুন মাস হল এদের ডিম দেওয়ার উপযুক্ত সময়। ডিম থেকে মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই বাচ্চার জন্ম হয়ে যায়। আর জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করতে পারে।

 

পুষ্টিগুণ

পুঁটিমাছের মধ্যে থাকা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল, এই মাছের মধ্যে থাকা প্রচুর পরিমাণে অনুপুষ্টি। তাই এই মাছকে অনুপুষ্টির ভাণ্ডার বলা হলেও ভুল হয় না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যদি একটি পুকুর থেকে আমরা দশ কেজি পুঁটি মাছ উৎপাদন করতে পারি তাহলে ওই দশ কেজি মাছ চল্লিশ লক্ষ বাচ্চার একদিনের পুষ্টির (ভিটামিন-এ) চাহিদা পূরণ করতে পারে।
আজকাল প্রায় অনেক বাচ্চার চোখেই থাকে চশমা। কিন্তু এই বয়স তো চশমা পরার বয়স নয়। কাজেই ওদের দৃষ্টিশক্তির সঠিক বিকাশে বিশেষ ভাবে সাহায্য করে এই পুঁটি মাছ।

 

কিছু অসুবিধা

এই মাছের অসুবিধা হল, দীর্ঘক্ষণ এই মাছকে সতেজ রাখা যায় না। চকচকে রুপালি এই মাছকে পুকুর থেকে ধরার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই যদি সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে এদের দেহে পচন শুরু হয়ে যাবে। কাজেই এই মাছকে দ্রুত সংরক্ষণ করতে হবে। 

খাবারের যোগ্য অংশ ও মায়েদের কর্তব্য

অন্যান্য মাছ যেমন ভাবে পরিষ্কার করা হয় এই মাছটিকেও তদ্রূপ পরিষ্কার করা উচিত। খাওয়ার সময় কোনও অংশ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কাঁটা থাকে খুবই ছোট যা চিবিয়ে খেতে বড়দের কোনও অসুবিধা হয় না। মায়েরা অনেক সময় ভাবেন এই মাছে যেহেতু কাঁটা আছে সেহেতু তাঁরা বাচ্ছাদের খাওয়াতে ভয় পান যদি গলায় কাঁটা ফুটে যায়। তাই তাঁরা এই মাছ সাধারণত বাচ্চাকে খাওয়াতে চান না। কিন্তু মায়েদের মনে রাখা উচিত, এই মাছে আছে ভরপুর অনুপুষ্টি, যা তাঁর বাচ্চার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলতঃ বাচ্চার সুস্থতার কথা মাথায় রেখেই এই মাছ খাওয়ানোর দিকে যত্নবান হওয়া বিশেষ ভাবে প্রয়োজন।

 

ধীরে ধীরে লুপ্তের পথে

অনুপুষ্টিতে ভরপুর এরকম একটি মাছ জলাশয়ে সেরকম ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। যার কারণ হিসাবে মনে করা হয়, এই মাছগুলি যদি জলাশয়ে থাকে তাহলে তারা বংশবিস্তার করবে। আর অন্য মাছের জন্য দেওয়া খাবারও তারা খেয়ে নেবে। যার ফলে পুকুরের বড় মাছের বৃদ্ধি সেরকম ভাবে হবে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে জেলেরা বড় মাছ ছাড়ার আগে পুকুর প্রস্তুত করার সময় পুঁটি, মৌরলা জাতীয় মাছকে মেরে ফেলেন।
 

পুঁটিমাছের চাষ

এই মাছ চাষের জন্য সেরকম বিশেষ কোনও ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত মিষ্টি জলের মাছ হলেও অল্প নোনা জলেও এই মাছ হতে পারে। অর্থাৎ উপকূলবর্তী এলাকার অল্প নোনাজল-যুক্ত পুকুরে এবং মিষ্টি জলের পুকুরে এই মাছ চাষ করা হয়।

এমন অনেক পুকুর আছে যেগুলিতে মাছ চাষ হচ্ছে না, যেগুলিকে পতিত পুকুর বলা হয়। সেই সমস্ত পুকুরে যদি আমরা এই পুঁটি মাছ ছেড়ে দিই তাহলে আপনা থেকেই তারা বাঁচবে এবং বড় হবে। আমাদের যেমন সামাজিক বনসৃজন প্রকল্প আছে সেরকম যদি সামাজিক মৎস্যসৃজন প্রকল্প করা যায়, আর এই মাছগুলিকে যে কোনও জলাশয়ে (রেললাইনের ধারের জলাশয় বা অন্য কোনও পাতিত জলাশয়) যদি ছাড়া যায়, তাহলে সারা বছরই অনুপুষ্টির চাহিদা মিটতে পারে বলে মনে হয়।

ছবি: লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content