বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


বিধি সৃষ্ট এ ভুবনে সকলেরই সমান অধিকার। আমরা মানুষ বলে, শক্তিশালী বলে জগতের উপর আমরাই আধিপত্য কায়েম করব এমনটা নয়। বরং মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী (জীব-জন্তু,পশু-পাখি, মাছ) যাতে ভালোভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে, অনুকূল পরিবেশের স্বাদ পেতে পারে তা দেখাও আমাদের কর্তব্য।

আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় এই তেলাপিয়া মাছ। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম হল—ওরিওক্রোমিস নাইনোটিকাস। এই মাছ মূলত ছিল মিশরের নীলনদের মাছ। নীলনদের জলে এর অবাধ বিচরণ বলে একে নাইনোটিকাস বলা হয়, এই নাইনোটিকাস হল এর উপাধি। এখন এই মাছ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মিষ্টি জলের মাছ হিসাবে পৃথিবীতে সর্বাধিক বিক্রীত মাছ হল এই তেলাপিয়া।

সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পের মতো সামাজিক মৎস্যসৃজন প্রকল্প যদি থাকত তাহলে খুব ভালো হত। যেখানে যেরকম জলাশয় আছে যেমন খাল-বিল থেকে শুরু করে পুকুর-ডোবা সেখানে যদি এই মাছকে ছাড়া যেত তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য খুবই সুখকর হত।

সাধারণ মানুষের জন্য অসাধারণ মাছ অনেক আছে, তার মধ্যে একটি হল তেলাপিয়া। কিন্তু এই তেলাপিয়া মাছটি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আমাদের দেশে ব্রাত্য ছিল। ব্রাত্য হয়েছিল এই অর্থে সরকারিভাবে এই মাছ চাষ নিষিদ্ধ ছিল। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন রাজ্য সরকারের মৎস্য দপ্তর, কেন্দ্রীয় সরকারের মৎস্য দপ্তর এবং এই দপ্তরগুলির অধীনে থাকা যে গবেষণাগার বা ফার্মগুলি রয়েছে সর্বত্রই এই তেলাপিয়া মাছের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

এই মাছগুলি পুকুরে বা অন্যান্য জলাশয়ে ডিম থেকে বাচ্চা হত। সংখ্যার প্রাচুর্যের জন্য সাধারণের ধারণা হয়েছিল এরা যদি সংখ্যায় এতটাই বেড়ে যায় তাহলে জলাশয়ে অন্যান্য মাছ যেমন—রুই, কাতলা, মির্গেল প্রভৃতির স্থান থাকবে না। তাই তারা এর চাষ বন্ধ করে দেয়।

তখন সরকারিভাবে বলা হল এই মাছের প্রজননক্রিয়া টিকে যদি কোনওভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে এই মাছ রাখা যেতে পারে। তখন গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হল। জীববিজ্ঞানের উন্নত কিছু প্রযুক্তি দিয়ে দেখা গেল এই মাছের প্রজননক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখা বা বিলম্বিত করা সম্ভব হয়েছে।

প্রকৃতির নিয়মই হল যেকোনও প্রাণী সে যদি প্রজননক্ষম হয়ে যায় তাহলে তার দৈহিক বাড় কমে যায়। এখন বাজারে বা আমাদের সামনে এমন তেলাপিয়া মাছ রয়েছে যেগুলি পুকুরে ছাড়লে তাদের বৃদ্ধি হবে কিন্তু তাদের প্রজননক্রিয়া বন্ধ থাকবে।

তেলাপিয়া মাছের বৈশিষ্ট্য

এই মাছ মিষ্টিজল, নোনাজল, অল্পমিষ্টি জল বা অল্প নোনাজল সব জলেতেই থাকতে পারে।
এদের খাবার নিয়ে বিশেষ চিন্তা করতে হয় না। কারণ এরা সমস্ত কিছুই খেতে পারে।
ডিম থেকে বাচ্চা হওয়া অর্থাৎ এই মাছের বাচ্চার সংখ্যা অনেক অধিক হয়।
এই মাছ ওজনে প্রায় এক কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
এই মাছ চাষের খরচ খুবই কম। তাই বাজারে খুব কম দামে এটিকে পাওয়া যায়। আর তাই একে সাধারণের মাছ বলা হয়।
এই মাছের সুবিধা হল সারাবছর এই মাছ পাওয়া যায়।

তেলাপিয়া মাছের গুণাগুণ

সাধারণের কাছে এই মাছ খুবই পছন্দের। এই মাছ খেতে অনেকেই বেশ ভালোবাসেন হয়তো বা এই মাছ খুবই সুস্বাদু। এই মাছের পৌষ্টিক গুণও আছে যথেষ্ট। ফ্যাট কম কিন্তু প্রোটিন বেশি। ফ্যাট কম হওয়ার সুবিধা হল এই মাছের সহজপাচ্যতা। এই সহজপাচ্যতা হওয়ার কারণে একজন বয়স্ক মানুষ যেমন খেতে পারেন তেমনই এক রোগীও খেতে পারেন। সাধারণ মানুষ তো খাবেনই। এই মাছের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এর চামড়া ব্যবহার হচ্ছে আজকাল পুড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা করতে অর্থাৎ ক্ষতস্থান ঠিক করতে এই মাছের চামড়ার গুরুত্ব বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে।

তেলাপিয়া মাছের অভিভাবকত্ব

অন্যান্য বহু মাছ তার বাচ্চাদের যত্ন নেয়। কিন্তু তেলাপিয়া মাছের মতো বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া খুব কম মাছের মধ্যে দেখা যায়। যখন তেলাপিয়ার বাচ্চারা খেলছে তখন বাবা-মা উভয়েই প্রহরীর কাজ করে অর্থাৎ তাদের বাচ্চাদের পাহারা দেয়। বিপদ বুঝলেই সেই বাচ্চারা বাবা-মার মুখের মধ্যে প্রবেশ করে। আবার অনুকূল পরিবেশ হলে তাদের মুখ থেকে বের করে। সত্যি তেলাপিয়া মাছের এ এক চমৎকার অভিভাবকত্ব।

ছবি: লেখক

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content