বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


কমন কার্প বা সাইপ্রিনাস কার্পও আমাদের কাছে আমেরিকান রুই নামে পরিচিত। যদিও এটি কোনওভাবে আমেরিকান তো নয়ই, বরং এর মাতৃভূমি হল চিন দেশ। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই এই একটিমাত্র মাছের চাষ হয়ে থাকে। কার্প বা পোনা বলতে বিদেশিরা সাধারণত এই মাছটিকেই বুঝিয়ে থাকেন। আমাদের পোনা মাছ বলতে যেমন কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবোস ইত্যাদি ভারতীয় কার্প বা ইন্ডিয়ান মেজর কার্প নামেই সর্বত্রই পরিচিত। এই মাছটির অর্থাৎ আমেরিকান রুই-এর চাষ আমাদের দেশে আগে হত না। যখন থেকে মিশ্র মাছ চাষের প্রচলন শুরু হল তখনই এই মাছটি এবং সঙ্গে আরও দুটো বিদেশি কার্প—সিলভার কার্প ও গ্রাস কার্প আমদানি করে আনা হয়। আমাদের পুকুরে পোনা মাছের মিশ্র চাষে এটি পাকাপাকিভাবে স্থান করে নেয়।
এই মাছের দেহ বেশ স্থূল হলেও মুড়োটি খুবই ছোট। পুকুরের নিম্নস্তরে থাকতে এরা ভালোবাসে। একে সর্বভুক বলা যায়। পুকুরের তলদেশে বিভিন্ন কীটপতঙ্গের লার্ভা, কেঁচোজাতীয় প্রাণী, উদ্ভিদ কণা, প্রাণী কণা সবকিছুই খায়। এই একটি মাত্র পোনা মাছই আছে যে, পুকুরে ডিম ছাড়তে পারে। এক কেজি ওজনের একটি পরিপক্ক মাছ এক লক্ষেরও বেশি ডিম দিতে পারে। সর্বোপরি বছরে একবার নয় সাধারণত দু’ বার এরা ডিম ছাড়ে। প্রথমে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে, পরে আবার জুলাই আগস্টে। কাপড়ের হাপায় (২মিটার x ১ মিটার x ১ মিটার আকারের) পুকুরে, এমনকি বড় চৌবাচ্চাতেও এরা ডিম ছাড়তে পারে। ডিমগুলি আঠালো প্রকৃতির হয়। জলে হাপা খাটিয়ে এবং সেই হাপায় জলজ ঝাঁঝি অনেকটা পরিমাণে দিতে হয়। ডিমগুলি নির্গত হয়ে এই ঝাঁঝির গায়ে লেগে থাকে। কচুরিপানাও দেওয়া চলে। ওদের শিকড়েও এই একই ভাবে ডিমগুলি লেগে থাকে। ডিমের রং ঈষৎ হলুদ কিন্তু উজ্জ্বল বর্ণের। অর্থাৎ বেশ চকচকে হয়। আকারে অনেকটা সরষে দানার মতো।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৯: হ্যাচারিকে কাজে লাগিয়ে বছরভর মাছ চাষ করে আয় সুনিশ্চিত করা সম্ভব

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৫: কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ প্রাজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সর্বত্যাগীর কেন এই মায়াবন্ধন?

ডিম পাড়া হয়ে গেলে ধীরে হাত-জাল দিয়ে তুলে পটাশ পারমাঙ্গানেট জলে স্নান করিয়ে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া যায়। আর ডিম-সহ ঝাঁঝি বা কচুরিপানা ফুটনহাপায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে শীতকালে তিন চারদিন লাগে। কিন্তু বর্ষাকালে দু’ দিনেই হয়ে যায়। ডিম ফোটার পর ঝাঁঝি-সহ ডিমের খোলাগুলি ফেলে দেওয়া হয়। আমাদের রাজ্যে তুলনামূলকভাবে এর চাহিদা কম থাকলেও বিহার, ঝাড়খণ্ডে এই মাছটি অত্যন্ত দামী মাছ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। যেমন আমাদের রাজ্যে বড় কাতলা বা রুইয়ে অতিরিক্ত চর্বি থাকায় এদের চাহিদাটা কম। কারণ, আমাদের এখানে মানুষজন সাধারণত মাছ খেতে চান প্রোটিনের উৎস হিসেবে, চর্বির উৎস হিসেবে নয়। হয়তো সেই কারণেই এর চাহিদা আমাদের রাজ্যে কিছুটা কম।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৪: সতী ও অসতী মাঝে পিতৃতন্ত্র

বিষয়টি মনে রেখে এই মাছেরই একটি ‘স্লিম ভ্যারাইটি’ নতুন চেহারায় এসে গিয়েছে হাঙ্গেরি থেকে। এর নাম দেওয়া হয়েছে আমুর কার্প। বিলম্বিত পরিপক্কতার কারণে এদের দেহের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো হয়। আর তাই পুকুরের নীচের তলার মাছ হিসেবে মিশ্র চাষে এখন অনেকেই আমেরিকান রুইয়ের পরিবর্তে আমুর কার্প পছন্দ করছেন। যদিও আমুর কার্প কিন্তু সাইপ্রিনাস কারপিও।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

এই মাছের প্রজননে না লাগে হরমোন, না প্রয়োজন হয় ইনজেকশন দেওয়া দক্ষ হাত। সাধারণভাবেই দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে পুরুষ ও স্ত্রী মাছ জোগাড় করে হাপায় ঝাঁঝির উপস্থিতিতে দু-তিন দিনের মধ্যেই লক্ষাধিক মাছের ডিম পোনা পাওয়া যায়। যারা আগ্রহী এই লক্ষাধিক মাছকে বিক্রি করে খুব কম করেও ৫০০০-১০০০০ টাকার রোজগার একটি ঋতুতে সম্ভব। পরবর্তীকালে সেই মাছ পুকুরে ছেড়ে আবার কয়েক মাস পরে এর প্রজনন ঘটানো যায়।
সুতরাং সাইপ্রিনাস দুটি বা আমেরিকান রুইয়ের ওপর ভরসা করে একজন অনায়াসে ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার করতে পারেন, কেবলমাত্র মাছের পোনা বিক্রি করে। আর এই পোনা নেওয়ার জন্য বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে যথেষ্ট চাহিদা সারা বছরই থাকে। অনুরূপভাবে আমাদের রাজ্যের জন্য আমুর কার্পের বীজ উৎপন্ন করে মিশ্র মাছ চাষের কাজে লাগানো যেতে পারে। এটি একটি গ্রামীণ স্বনির্ভর নিযুক্তির প্রকল্প হতে পারে। সহজেই আত্মনির্ভর ভারতের কথা ভাবলে গ্রামীণ মাছ চাষের মাধ্যমে এ ভাবেও কিছু ভালই রোজগার সম্ভব‌।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

Skip to content