রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

শোনা গিয়েছিল, একবার এক বিয়ের কনে এক কাণ্ড ঘটিয়েছিল। সে অন্য কালের কথা। রবীন্দ্রনাথের সুভাষিণী কথা বলতে পারতো না। কিন্তু এ বলতো, তীব্র ভয়ানক স্বরে। তাকে বারবার বলা হয়েছিল, সাত চড়ে “রা না কাড়ার” অভিনয় চালিয়ে যেতে। সে কথা বলেওনি, ভালোই চলছিল সব, শেষে যখন অভ্যাগত অতিথিদের ভিড় মারাত্মক, সেই ভিড়ে একটা কুকুর কী করে যেন ঢুকে পড়ল, নিমন্ত্রিত নয় ভেবেই সম্ভবত, খুলে রাখা জুতো থেকে একপাটি তুলে নিল সন্তর্পণে, বেশ নরম নরম মোলায়েম নতুন জুতো, চিবিয়েও সুখ। সবে সটকে পড়ার চেষ্টা করেছে, ওমনি বিয়ের মণ্ডপ থেকে কনের ত্রাহি ত্রাহি আর্ত চিৎকারে পাড়াপড়শির দাঁতে খিল লেগে গেল।

বর চোখ উল্টে বিষম খেল। কনের বাপ-কাকা-দাদারা ঘাবড়ে চমকে এ ওর ঘাড়ে পড়ে গেল। যারা গরম বেগুনি মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, এই ধাক্কায় পুরোটা মুখে চালান করে দিয়ে আঁতকে উঠল, যারা আরেকটু এগিয়ে মাছ খাচ্ছিল, কাঁটার খোঁচায় সেখানেই তাদের খাওয়া মাথায় উঠল, যে রসগোল্লা গুনছিল মাঝপথে খাবি খেয়ে সব ভুলে গেল, একটা ব্যাঙ ঠাকুরের চোখ এড়িয়ে মাংসের কড়ায় লাফ দিল। বিয়ের মণ্ডপে সকলে যখন পুরোহিত মশায়ের চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান আনছে তখন কনে ভালো ছাত্র অর্জুনের মতো “স্যার, আমি তো পাখির চোখ ছাড়া কিছুই দেখছিনে” এরকম একনিষ্ঠতায় “কুকুরে জুতো নিয়ে গেল গো, ধর ধর” বলেই চলেছে!
তার এই অবিমৃষ্যকারিতায় কী হয়েছিল, কুকুর জুতো নিতে পেরেছিল কীনা এসব জানা যায় না, এসব গল্প “ছোটগল্পের” মতো, শেষ হবে না, শেষটুকু আপনার জন্য…

কিন্তু এমন ক্যাবলামিতে হাসি, রাগ, দুঃখ, কষ্ট কী যে হয় তা বলা কঠিন। কিন্তু, এসব ঘটনা তো ঘটেছিল বলে শোনা যায় কিংবদন্তির মতো। কিন্তু যা ঘটে না, ঘটে নি, ঘটতে পারে না তাকে ঘিরে ক্যাবলামি কেমন দানা বাঁধে?

যেমন হোঁত্কা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। তার জন্য বেশি বেশি ঘুমোতেও হয়। তো একদিন হোঁত্কা কোথায় একটা যাবে বলে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। বাস এল। উঠে সে একটা সিটে বসল। ভাড়া দিল। বাস চলছে। এবার হোঁতকার খেয়াল এল সে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। অঙ্ক না ভৌত বিজ্ঞানের একজাম। হোঁত্কা ভোরে উঠে পড়বে ঠিক করেছিল। সারা বছরেরটা ভোরেই পড়বে। ভোরে পড়লে মনে থাকে। বাস ছুটছে। কিন্তু ভোরে পড়তে ভুলে গেল কী করে সে?
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৫: মন বলে আমি মনের কথা জানি না!

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৫: সুন্দরবনে বসন্ত রোগের দেবতা বসন্ত রায়

এ বার অ্যারিথম্যাটিকে যদি বিভীষণ স্যার সেই মাদুর বোনার অঙ্কটা দেন? কিংবা দুটো উল্কা একসঙ্গে নিচে পড়ছে… একটা একটু এগিয়ে গেল… উফ্ বাপরে… পরীক্ষা শুরু হতে আর পাঁচ মিনিট দেরি, কিন্তু বাস কলকাতা ছাড়িয়ে ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটছে। কী করবে এখন সে? ও দাদা… এ বাস কোন্ রুটের? আপনি তো বললেন ধুতরোগাছি হয়ে যাবে এই বাস। ধুতরোগাছি কোথায়? কলকাতাতে ধুতরোগাছি নেই? তাহলে তার স্কুলটা কোথায়? এই তো কার্ড, স্কুলের কার্ড… পরিষ্কার লেখা ধুতরোগাছি ল্যাংচাখালি বাঁদরডাঙা মিক্সড স্কুল উঃ মাঃ, কী বলছেন এটা আইকার্ড নয়, বাজারের ফর্দ? না, না, ওরে বাবা, এটা কোথা থেকে এল? দশপাতার হাতের তালুর মাপে মাইক্রোজেরক্স টুকলি, সামনে সূচিপত্র, আমাকে পরীক্ষা হলে পৌঁছে দাও কাকু, আধঘণ্টা হল পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে, এ বার পাশ না করলে… হোঁতকার পাশের সিটের লোকটা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৬: মোমো চিত্তে!

এ বার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল, “বমালসমেত গ্রেপ্তার। অ্যাই, হাতকড়া বের করো”… হোঁত্কা ভীষণ চমকে তাকিয়ে দেখল বিভীষণ স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে। তার মুখটা ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছে, দেখতে দশেরার দশমাথা রাবণের মতো লাগছে। কণ্ডাক্টর হাঁটু মুড়ে বসে হাতজোড় করে বলছে, “প্রভো! এই আসামীর কী শাস্তি দেবেন, আমি বলি কি, গন্ধমাদনটা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিই, চাপে ব্যাটার রস খানিক বেরিয়ে গেলে, ঝেড়ে খেলার মাঠে দড়ি টাঙিয়ে রোদে শুকোতে দেব।”

হোঁত্কা চমকে দেখল, কণ্ডাক্টর কখন যেন হনুমান হয়ে গিয়ে জুলজুলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে।

বিভীষণ স্যার রাবণের মতো হাসতে হাসতে বলছেন, “হে কপিবর! একে গুণে বারোবার আছাড় দিয়ে দু’দিন গন্ধমাদনে চাপা দিয়ে বেশ করে ধুয়ে নিংড়ে মাঠে দেবেন, দু’চামচ বেশি সাবান দাও ক্ষতি নেই, ফর্সা না হলে মাইনে কেটে নেব। তার আগে হোঁত্কার ইন্টারভ্যু হবে। রোল নং চারশো বিশ, হোঁদলকান্ত ধাঁই চলে এসো।”

হোঁত্কা প্রতিবাদ করে বলতে যাচ্ছিল, এটা তার নাম নয়, এই রোল তার নয়, কিন্তু তার আগেই সে অবাক হয়ে দেখল কণ্ডাক্টর ওরফে কপিবর কাজের দিদি মোক্ষদা মাসির গলায় হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একটা গদা মাথার ওপর ঘোরাচ্ছে… ওদিকে বিভীষণ স্যার বলছেন,” হোঁত্কা! ধরো, তোমার কাছে দশটা রসগোল্লা আছে। তার থেকে কতো টাকা কেটে নিলে আটটা লাড্ডু পড়ে থাকবে?”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৩: পাঁকাল মাছের প্রোটিনের গুণমাণ তো ভালোই, সঙ্গে ফ্যাটের পরিমাণও যৎসামান্য

হোঁত্কা কিছুই না বুঝতে পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। বিভীষণ স্যার আবার বললেন “হোঁত্কা! তুমি কি দেখতে পাচ্ছো?”

হোঁত্কা বলল, “স্যার, আমি গাছের মাথায় একটা কুকুর ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কুকুরটা একটা মেরুণ রঙের স্যাণ্ডেল চিবোচ্ছে। আমি কিছু জানি না স্যার, ও কীভাবে ওখানে উঠল আমি জানি না স্যার, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার, আমি আর কখনও টুকলি করব না, এই অন গ…”
হোঁত্কার কথা শেষ হল না, চারিদিকে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। গন্ধমাদন পর্বতটা হুড়মুড় করে এগিয়ে আসছে…

কাকা বলল, ”হিপনিক জার্ক, স্বপ্নে কখনও কখনও এমনটা মনে হয়”…

বাবা দরজার খিলটা বাগিয়ে ধরে বলছেন,”এই বয়সেই টুকলি করা শিখেছিস, আজ তোর পিঠে এটা ভেঙে ছাড়ব। ভাবি ক্যাবলা ছেলে, ভাজামাছ উল্টে খেতে জানে না, তলে তলে এতো… ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও টুকলির স্বপ্ন। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন!
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content