অলঙ্করণ: লেখক।
ক্যাবলামি এড়িয়ে বুঝি জগৎ চলতে পারে না। ভুলে ভরা পৃথিবী, সেই ভুলগুলোকে ঠিক বলে চালানোর মতো গলার জোর, সেই ভুল-ঠিকের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরে মরা জীবন কিংবা ওই ভুলের মতো দেখতে ঠিকগুলো, ঠিক বলেই মনে হতে থাকা ভুলগুলো বা ঠিক অথচ সত্য নয়, ভুল অথচ মিথ্যা নয়, সত্য অথচ ঋত নয়, মিথ্যা অথচ… এইসব এড়িয়ে পৃথিবীর সুন্দরগুলিকে লালন করে মহীরূহ করার মতো ঘটনা পৃথিবীতেই ঘটে। তবু মনে হতে থাকে, চারপাশে যা চলছে, যা চলে এসেছিল সবই নির্ভেজাল নয়, তবে অদূর ও সুদূর ভাবীকালে যা ঘটবে তা আর এমনটা থাকবে না। একে কেউ বলবেন স্বপ্ন, কেউ বলবেন দিবাস্বপ্ন, কেউ বলবেন নিছক ক্যাবলামি, কেউ খুঁজবেন অভিসন্ধি, কেউ ভাববেন এই যে “কাল থেকে ঠিক বদলে যাবো”র মতো তত্ত্বানুশীলন, এটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় পরিহাস।
এই সকল মতদ্বৈধ, বিচিত্র গতায়াত, বিপুল শূন্যতার মাঝে একটাই বুঝি যথার্থ যে, সত্য অভ্রান্ত হলেও তা আপেক্ষিকতায় আক্রান্ত, আর মিথ্যা বিচিত্র। এই মিথ্যা কখনও মায়া, এই মিথ্যা বহুস্তরীয় বিচিত্রগামী এবং আপেক্ষিক সত্য-ই কখনও মিথ্যা, কখনও মিথ্যাকে অতিক্রম করে তা-ই ঋত হয়ে ওঠে। ঋত কখনও সত্য ও মিথ্যার অতীত এক ও অদ্বিতীয় এক বোধ, তবে সত্য মিথ্যার বহু সংঘাত, বহু সত্যের মিথ্যা হয়ে পড়ার ও বহু মিথ্যার সত্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে অতিক্রম করেই এই বোধের জন্ম।
আরও পড়ুন:
পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা
এই সকল সত্য, মিথ্যা, ঋত কিংবা ন্যায় অন্যায়ের শুভ অশুভের বোধকে আকীর্ণ করে সত্যবাদী, মিথ্যুক, তত্ত্ববেত্তা সকলের মধ্যেই যে বিচিত্র ভাব ঘোরাফেরা করে সেটাই বুঝি ক্যাবলামি। তাই মনে হয় ক্যাবলামি সত্য, ক্যাবলামি মিথ্যাও, ক্যাবলামি ভুল কিংবা বোকামি, কখনও অন্যায়, কখনও বা আত্মরক্ষার বিশেষ প্রকৌশল। তাই ক্যাবলামি কী এবং কেন, কবে বা কোথায় কোথায় কী কী প্রেক্ষিতে তা আবির্ভূত হতে পারে তা বলা বা বোঝা কী বিপুল সংশয়বাদে আক্রান্ত ভেবে আতঙ্ক জাগে।
টেনিদা যখন “শাট-আপ ক্যাবলা” বলে তখন আমরা ক্যাবলাকে বোকা বা নির্বোধ ভাবতে পারি না, কিন্তু যখন হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন রাস্তায় নামেন, তাঁদের মূর্খামিগুলোই আমরা উপভোগ করে উৎফুল্ল হই। এঁরাও ক্যাবলা, আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন যখন কিছু করেন অথবা করেন না, তাঁর কর্ম-অকর্মগুলি দেখে সংশয়-বিস্ময়-হাসি-বিরাগবিজড়িত এক কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা জাগে। এ কি সত্যই এরকম নাকি সেয়ানাজাতীয় মূর্খ, পণ্ডিতন্মন্য এক মূঢ় কিংবা বোকা বোকা সেজে থাকা এক মহা ধুরন্ধর লোক নাকি ত্রিগুণাতীত সর্বজ্ঞ… কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না, বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন:
চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন
শাস্ত্র বলেছে হেতুবিদ্যা বা যুক্তি সকল বিদ্যার মূল, যুক্তিবোধের দৃঢ় ভিত্তি সকল কর্মের উপায়, সকল ধর্মের আশ্রয়। যুক্তির বলেই সত্য ও মিথ্যাকে নিয়ে কন্দুকক্রীড়া, যুক্তির পথেই অন্যায়ের সাধন, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, যুক্তির বলেই মৃতে প্রাণসঞ্চার, বেঁচেও মরে থাকা। সত্য এই যুক্তির পাড়াতে থাকলেও খুব বাছবিচার করেই মেশে।
এই যুক্তির জাল যে বুনতে পারে অথবা ছিন্ন করে দেয় কখনও বা তারা সকলেই ক্ষেত্রবিশেষে “ক্যাবলা” হয়ে উঠতে পারে। অহং যখন আক্রান্ত হয়, সে বাদে সকলেই ক্যাবলা। এতটা সরলীকরণের পথে যদি নাও যেতে হয়, তবে একথা বলতে বাধা নেই ক্যাবলামি এক সংক্রামক ব্যাধি, হাসির মতো ছড়িয়ে পড়ে, কান্নার মতোই সর্বত্রগামী, আট থেকে আশির, সাড়ে বত্রিশ, ছাব্বিশ কী সুইট সিক্সটিন থেকে চালসের চল্লিশ, খোকা থেকে “পশ্যেমঃ শরদং শতম্” এর বেত্তা, পণ্ডিতন্মন্য থেকে আঙুর ফল টকের ধূর্ত শেয়ালের দল, কাক্কেশ্বর থেকে ষষ্ঠীচরণ, “আমাকে দেখুন”-এর জুগুপ্সা থেকে জনপদ, নগর, প্রান্তরের গৃহ থেকে গৃহান্তরে একমুঠো মৃত্যুগন্ধহীন সর্ষের মুষ্টিভিক্ষার আকুতি নিয়ে ঘুরে মরা প্রাণ… সকলের জন্য অক্ষয় বাঁচার অক্সিজেন আর ধ্বংসের নিশান।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৪: চাঁদ ঢাকার কৌশল
যে ক্যাবলামি করে, আয়াসে কী অনায়াসে, ইচ্ছায় কী শোণিতধারার প্রবল তাড়নায়… তারা ছোট হতে থাকে, ওই সদর্থক ও নঞর্থক ক্যাবলামি তাদের বড় হতে দেয় না, তাদের এই ছোটবেলা অক্ষয় অনন্ত হলে ক্ষতি কি? যেটুকু মরে বেঁচে থাকা… সেটুকু তো তাদেরই একান্ত আপনার ধন, বেঁচেও মরে যেতে যেতে কিছু নিদাঘের সন্ধ্যার কূলে “দিনের চিতা”র মেদুর আর্তি, কিছু শৈত্যসঙ্কুল ক্লিষ্ট আর্তনাদ, কিছু হৈমন্তিক গোধূলির “বিপন্ন বিস্ময়”, কিছু অবসাদদীর্ণ বসন্তবায়… তাদের জীবনের ক্লান্ত সরণীর পথে ছুটে চলে অনন্ত আকাঙ্ক্ষার স্রোত ঠেলে ঠেলে, কীসের অকালবোধনের বীজমন্ত্র কিংবা শোকোত্তীর্ণ শ্লোকের বুকে নিয়ে?
ঋণ স্বীকার:
● হারমোনিয়াম চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত তপন সিনহা রচিত গানের অংশ
ঋণ স্বীকার:
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।