শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

কী ভাবছেন? ছোটবেলাতেই কেবল ক্যাবলা হওয়ার ভয়, বড় হলেই বুঝি এসব থেকে ছুটি? তখন শুধু “চুপ কর ক্যাবলা, ইস্টুপিড” বলে দাবড়ে দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ? আপনি ঠিকই ভাবছেন। তবে বয়সে বাড়লে শুধু হবে কি? না হয়তো। না হলে কেউ কথা রাখে না কেন?

“মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদা ঠাকুর/ তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো/ সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে!/ নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?” (কেউ কথা রাখেনি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর রাজা দুষ্যন্ত। একবার একটা হরিণকে তাড়া করে পৌঁছে গেলেন কণ্বের তপোবনে। ক্ষ্যাপা হাতির মতো যেন একরাশ ঝোড়ো হাওয়া নিয়ে এলেন এক আগন্তুক।

এ গল্প কি অচলায়তন ভাঙার? নাকি, প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে এই বুঝি তার বীজমন্ত্র? কী মনে হয়েছিল তখন রাজার, তিনি তাঁর আকাঙ্ক্ষিত দু’দণ্ড শান্তির বনলতার দেখা পেলেন? রাজা ফিরে যান নগরে। ঋষি দুর্বাসার একটা অভিসম্পাতে ভর করে সকল মর্ত্যপ্রেম অমর্ত্য সুরলোকের দিকে ছুটে চলে দিব্য আলোর তরণীতে। মুগ্ধা বোকা আজন্ম অকপট, ছলনার শিক্ষা না পাওয়া শকুন্তলার অবগুণ্ঠন সরে যায়। দুষ্যন্তকে ভর্তসনা করে ক্রোধে যেন ফেটে পড়ে সে! সেই শকুন্তলা, যে জানে না প্রমাণ কী করে দিতে হয়, জানে না বিশ্বাস নামক বস্তুর মধ্যে শ্বাসের বড়োই অভাব, জানে না মানুষ কখনও কখনও নিরপেক্ষ ‘রাজা’ হয়ে হৃদয়পুরমাঝ থেকে বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে যায়! কেউ কেউ কথা রাখে না। আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভালোবাসতে না জানলে জীবনের ষোলোআনা ফাঁকির তত্ত্বটাই হয়তো একটা বেবাক ফাঁকি অথবা, রাজবাড়ির অগ্নিপুরীর অগ্নিশালায় সে সব ভালোবাসার গাথা ছাই হয়ে হোমকুণ্ডে মিশে থাকে। ক্যাবলারা এসব জানে না। শকুন্তলা এসব জানতো না, সে মুগ্ধা, সরল, অকপট, নাগরিক জটিলতা, তঞ্চকতার শিক্ষাহীন সভ্যতায় অদীক্ষিত এক বুনো, ক্যাবলা বালিকা যাকে রাজভোগ ত্যাগ করে তেঁতুললোভী মানুষ আকাঙ্ক্ষা করে।

রাস্তা কারও একার নয়। জীবনের রাজপথ থেকে নগরের গলিঘুঁজি, গ্রামের মেঠোপথ থেকে ফুলে ঢাকা বনতল… হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা নামে, কালো কালো মেঘ নেমে এসে ছেয়ে ফেলে চোখ, মন, শরীর মস্তিষ্ক। সে ছায়াঘেরা আচ্ছন্ন কালে চোখ যা দেখে মন তা বলে না। তপোবনে আগত কোনও “মানুষকে” হঠাৎ করেই “রাজা” হয়ে উঠতে দেখা যায়। যা মনে হয় সত্য তা অলীক। যা অলীক তা-ই শাপে ভর করে সত্য হয়। যা কখনও হতে পারে না তা-ই হয়। হয়তো তা-ই হওয়ার ছিল। যা হয়ে ওঠে তা-ও সত্য হয় না। আসলে, পৃথিবী যেন মায়াবী নদীর পারের দেশ। এখানে কোনও সত্য শেষ সত্য নয়। পৃথিবী যেন অলকা। অস্তিত্বহীন এক অনন্ত, সত্তাহীন এক অনস্তিত্ব। তখন মরীচিকাকে জল, গাছকে মানুষ, রজ্জুকে সর্প মনে হয়।

একটু দেখে নেওয়া যাক একটা অংশ…

তারপর লণ্ঠন তুলে ওরা আমার মুখ দেখে বললে— ও, আপনি? কী হয়েছে আপনার? মুখ একেবারে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, ভয়-টয় পেলেন নাকি? বাউরিবাগান জায়গাটা ভালো না। সন্ধের পর এখানে অনেকে ভয় পায়।
“ওদের লণ্ঠনটা যখন উঁচু করে তুলে ধরলে আমার মুখে, সেই আলোয় দেখলুম— সামনের মূর্তিটা তখনও সেখানে ঠিক সেইরকম দাঁড়িয়ে। একজন বললে— কী দেখছিলেন এখানে দাঁড়িয়ে বাবু— এই ষাঁড়া গাছটা?

আর একজন বললে— গাছটায় ডালপালা কেটে মাথায় ঝোপের মতো করে রেখেছে, যেন মানুষ বলে অন্ধকারে ভুল হয় বটে, চলে আসুন বাবু। আমিও দেখলাম ষাঁড়া গাছই বটে। মাথার দিকের পাতাগুলো ছেঁটে গাছটাকে দেখতে হয়েছে ঠিক হর্সগার্ডসদের ঘোড়ার বালামচির টুপি। লোকের চোখের কী ভুলই হয়!”
(মেডাল: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

দর্শনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই আচ্ছন্নতা আর তার থেকে জেগে ওঠা এই মিথ্যাজ্ঞান, অজ্ঞানতাপ্রসূত মায়া–অধ্যাস। এখানে রজ্জু যখন নয়নপথগামী , সেটিই তখন ঘোর সত্য। আবার সেই রজ্জুই যখন নিমেষমাত্র সাপ হয়ে রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটাবে, তখন সেই সাপ-ই ঘোর, ঘোরতর বাস্তব।

অতনু রাস্তার পাশে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল লোকটার দিকে। ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, গায়ে শান্তিনিকেতনী বাটিকের জামা, কাঁধে পেটমোটা ঝোলা, এমনকী সেই চেনা কায়দায় ঝোলা থেকে ছাতার বাঁট আর খবরের কাগজ উঁকি মারছে। ঠিক যেমন সাতাশ বছর আগে দীপেশবাবুর ব্যাগ থেকে উঁকি দিতো। মাঝে সাতাশ বছর কেটে গিয়েছে, অতনু স্কুল ছেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে কর্মজীবন, স্কুলেই পা রাখেনি প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেল। যেমন হয় আর কী। নানা ঘাটে ঘুরে এখন একটু স্থিতিশীল জীবন, পোস্টিং। দীপেশবাবুর বয়স কতো ছিল তখন? সাঁইত্রিশ বা আটত্রিশ। এখন হবে পঁয়ষট্টির মতো। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আর খোঁজ রাখেনি। যেমন হয় আর কী। এই ভদ্রলোকের বয়স কতো হবে? পঞ্চাশ? ষাট? পঁয়ষট্টির কাছাকাছি?

ঠিক বুঝতে পারে না অতনু। স্যার কি এখনও চাকরি করেন? এ পাড়াতেই থাকেন নাকি?

সেই লোকটি মুখ ঘুরিয়ে বামদিকের পাঁচিলে লটকানো একটা আধভেজা পোস্টারে মন দিয়ে কী যেন দেখেছিলেন। হাঁপানির ওষুধ কিংবা বিফলে মূল্যফেরত জাতীয় কিছু বিজ্ঞাপন। নাকি কোচিং সেন্টারের? চোখের চশমার ফ্রেমটা সাতাশ বছরে একদম সেই আগের মতোই থেকে গিয়েছে। বেশ মনে পড়ে অতনুর। প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি মোটা ঘোর কালো ডাঁটিতে একটু লালের ছোঁয়া।

একটু এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে “শুনছেন, স্যার, একটু এদিকে দেখবেন, কেমন আছেন?”

লোকটি খানিক চমকে ফিরে তাকায়। তাকেই চমক ভাঙে অতনুর। পানখাওয়া দাঁত বের করে লোকটা বলে, “হ্যাঁ, কিছু বলছেন? আমাকে বলছেন?” নাকের নীচে একটা মাঝারি অসমান গোঁফ, চিবুকে কাটা দাগ। এ কে? অতনু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে “এক্সট্রিমলি স্যরি। আমি অন্য একজনকে ভেবেছিলাম।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৮: ও দয়াল! বিচার করো!

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখা যায় কালজয়ী লেখক কিংবা মনোহরণ নায়কের অবিকল প্রতিমূর্তি বেশ কায়দায় হাত পা নেড়ে মন কাড়ছেন। যাকে আপনি মুখ ভাবছেন তা মুখোশ। যাকে মুখোশ ভাবছেন তা অন্যকিছু। দিনকে রাত মনে হয়, মনে হয় যাদুকরের হাতে ধরা পাত্র থেকে পড়তে থাকা জলটা বুঝি চিরকাল অমন করেই পড়তে থাকবে। কিংবা ঐ যে আঙুল ফুঁড়ে সূঁচটা ঢুকে গেল, রক্ত ঝরছে, কিংবা শরীরটাই বুঝি দুখানা তিনখানা চারখানা হয়ে হাড়হিম করে দিচ্ছে, কিন্তু শরীরের মালিক দিব্যি উঠে বসে টপ্পা গাইলেন। নবীন মাঝি ঘাটে নৌকা বেঁধে গামছাটায় সদ্য ধরা লাফানো কৈমাছ গুলো বেঁধে পা ফেলতেই “বাবাগো” বলে দুটো লাফ দিয়ে ছিটকে গেল। ছিটকে গেল হাতের পুঁটলিটা জলের অতলে। রাতবিরেতে বর্ষার নদীর তীর। ভরা ভাদ্র। কিন্তু হালকা আলোয় দেখা লিকলিকে ওই কী যেন ওটা নড়ে না। ভুল ভাঙে। দড়িটা পড়ে থাকার জায়গা পেলে না। সাধের মাছগুলো গামছাসুদ্ধু ডুবে মরল? হায়!
অধ্যাস। ভ্রান্তজ্ঞানের অধ্যারোপ।

একটু দেখা যাক টেনিদা কী করছে।

“টেনিদা গলা ঝেড়ে বললে, আমি যখন যুদ্ধে যাই–মানে বার্মা ফ্রন্টে যেবার গেলাম—
খুকখুক করে একটা চাপা আওয়াজ। হাবুল সেন হাসি চাপতে চেষ্টা করছে।

—হাসছিস যে হাবলা?–টেনিদা এবার হাবুলের দিকে মনোনিবেশ করলে।
মুহূর্তে হাবুল ভয়ে পানসে মেরে গেল। তোতলিয়ে বললে, এই ন্-ন্-না, ম্-মানে, ভাবছিলাম তুমি আবার কবে যু-যু-যুদ্ধে গেলে—

টেনিদা দারুণ উত্তেজনায় বোয়াকের সিমেন্টের উপর একটা কিল বসিয়ে দিয়ে উঃ উঃ করে উঠল। তারপর সেটাকে সামলে নিয়ে চিৎকার করে বললে, গুরুজনের মুখে মুখে তঙ্কো! ওই জন্যেই তো দেশ আজও পরাধীন! বলি, আমি যুদ্ধে যাই না-যাই তাতে তোর কী? গল্প চাস তো শোন, নইলে স্রেফ ভাগাড়ে চলে যা। তোদের মতো বিশ্ববকাটদের কিছু বলতে যাওয়াই ঝকমারি।”
(ক্যামোফ্লেজ: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)

টেনিদা যুদ্ধু করতে গিয়ে নাক ডাকিয়ে, ঘুমের ঘোরে কিংবা চা খেতে খেতে শত্রু মারছিল তখন। কিন্তু কোথায় যুদ্ধ করছিল সে?
“যুদ্ধ করতে করতে সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলাম–যার নাম তোরা কাগজে খুব দেখেছিস। নামটা ভুলে যাচ্ছি–সেই যে কিসের একটা ডিম—
আমি বললাম, হাঁসের ডিম?
টেনিদা বললে, তোর মাথা।
ক্যাবলা বললে, তবে কি মুরগির ডিম?
টেনিদা বললে, তোর মুণ্ডু।

আমি আবার বললাম, তবে নিশ্চয় ঘোড়ার ডিম। তাও না? কাকের ডিম, বকের ডিম, ব্যাঙের ডিম—

ক্যাবলা বললে, ঠিক, ঠিক, আমার যেন মনে পড়েছে। বোধহয় টিকটিকির ডিম—
অ্যাই, অ্যাই মনে পড়েছে।—টেনিদা এমনভাবে ক্যাবলার পিঠ চাপড়ে দিলে যে ক্যাবলা আর্তনাদ করে উঠল–ঠিক ধরেছিস, টিড্ডিম।”
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

ঘোষিত ক্যাবলারা প্রশংসিত হচ্ছে, এ দৃশ্য বুঝি মহাজাগতিক বিস্ময়ের মতোই অবিশ্বাস্য। চোরা ক্যাবলাদের কথা আলাদা। কথায় বলে, চোরা না শোনে ধর্মের কথা। আর ধর্মের কল বাতাসে নড়ে নাকি। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। দেখা যাক টেনিদার যুদ্ধ।

“টেনিদা আবার শুরু করল: আমার একটা কুকুর ছিল। তোদের বাংলাদেশের ঘিয়ে ভাজা নেড়ি কুত্তো নয়, একটা বিরাট গ্রে-হাউন্ড। যেমন তার গাঁক গাঁক ডাক, তেমনি তার বাঘা চেহারা। আর কী তালিম ছিল তার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে দু’ পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতে পারত। বেচারা অপঘাতে মারা গেল। দুঃখ হয় কুকুরটার জন্যে, তবে বামুনের জন্যে মরেছে, ব্যাটা নির্ঘাত স্বর্গে যাবে।”

একদিন ইভনিং ওয়াকে পোষ্যসহ বেরিয়ে টেনি পাকা আমের গাছ দেখতে পেল। যুদ্ধের সময়। শত্রুপক্ষে জাপান। তারা তখন সে জায়গা থেকে বিপদ বুঝে খানিক দূরে সরে গিয়েছে। কিন্তু এই আরাকানে বাংলাদেশের আম গাছ কেন? এদিকে সেই পোষ্য সারমেয় আম খেতে চায়, চোখের ইঙ্গিতে বলে, কয়েকটা আম পাড়ো।

ক্যাবলা বললে, ‘কুকুরটা আম খেতে চাইল?’

‘চাইলই তো। এ তো আর তোদের এঁটুলি-কাটা নেড়িকুত্তো নয়, সেরেফ বিলিতি গ্রে-হাউন্ড। আম তো আম, কলা, মুলো, গাজর, উচ্ছে, নালতে শাক, সজনেডাঁটা—সবই তরিবত করে খায়। আমি আম পাড়তে উঠলাম! আর যেই ওঠা…!’ টেনিদা থামল।

‘কী হল?’

‘যা হল তা ভয়ংকর। আমগাছটা হঠাৎ জাপানি ভাষায় ফুজিয়ামা-টুজিয়ামা বলে ডালপালা দিয়ে আমায় সাপটে ধরলে। তার পরেই বীরের মতো কুইক মার্চ। তিন-চারটে গাছও তার সঙ্গে সঙ্গে নিপ্পন বানজাই বলে হাঁটা আরম্ভ করলে!’
‘সেকি!’ আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ‘গাছটা তোমাকে জাপটে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে!’
‘করলে তো। আরে, গাছ কোথায়? স্রেফ ক্যামোফ্লেজ।”

ছদ্মবেশ। দুষ্যন্তকে চেনা যায় না। মানুষকে ভূত মনে হয়। আর দড়িকে সাপ। এই হল অধ্যাস, ভ্রান্তজ্ঞান। একটি রূপে আরেকটির আরোপ। যেমন মঞ্চের ভীম, অর্জুন সত্য নয়। কিন্তু তারা মুগ্ধ করে, যেন তা সত্য বলে মনে হয়, দর্শক হাসে, কাঁদে, ভয় পায়, ভালোবাসে। কিন্তু আলু-আলুবোখরা, আম-আমড়া এক হয় না কখনও। হয় কি?

তারা টেনিদাকে মেরে ফেলে। তরবারির এক কোপে মুণ্ডু নামিয়ে দেয়।

“কী ভয়ানক!’ ক্যাবলা আর্তনাদ করে বললে, ‘তুমি বাঁচলে কী করে?’

‘আর কি বাঁচা যায়? বললে, নিপ্পন বানজাই—মানে জাপানের জয় হোক। তারপর তলোয়ারটা ওপরে তুলে…!’

হাবুল অস্ফুট স্বরে বললে, ‘তলোয়ারটা তুলে…?’
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

‘ঝাঁ করে এক কোপ! সঙ্গে সঙ্গে আমার মুণ্ডু নেমে গেল। তারপর রক্তে রক্তময়!”
তবে পটলডাঙার রোয়াকে এ কোন্ স্কনধকাটা ভূত নিয়ে কারবার চলছে? কুকুরটাই শুধু পালিয়ে এল?

“তবু বুঝলি না? আরে এখানেও যে ক্যামোফ্লেজ।

—ক্যামোফ্লেজ!!

—আরে ধ্যাৎ। তোদের মগজে বিলকুল সব ঘুঁটে, এক ছটাকও বুদ্ধি নেই। মানে আমি টেনি শর্মা–চালাকিতে অমন পাঁচশো জাপানীকে কিনতে পারি। মানে আমি কুকুর সেজেছিলাম, আর কুকুরটা হয়েছিল আমি। বেঁটে ব্যাটাদের শয়তানি জানতাম তো! ওরা যখন আমার, মানে কুকুরটার মাথা কেটে ফেলেছে, সেই ফাঁকে লেজ তুলে আমি হাওয়া!
আর তার পরেই পেলাম তিন নম্বর ভিক্টোরিয়া ক্রসটা!”
বোঝা গেল?

দড়িটাই কখনও কখনও সাপ, সাপটাই কখনও কখনও দড়ি, রাজাই কখনও কখনও প্রেমিক, প্রেমিক-ই কখনও কখনও রাজাগ্নি, চোর কখনও কখনও সাধু, শঠ কখনও কখনও ন্যায়ের রক্ষক, আঙুরফল কখনও কখনও মিষ্টি, আঙুরফল কখনও কখনও টক। অধ্যাস, মায়া, মিথ্যার বোধ, সত্যের উদ্ভাস, ক্যামোফ্লেজ করে করে একটা যুদ্ধ চলছে। সেখানে কেউ খুব বোকা ক্যাবলা মনে হলেও আদতেই তা নয়, কাউকে বুদ্ধিমান মনে হলেও তার চেয়ে বুঝি নির্বোধ হয় না। যা নয় তাকে ভাবাটাই জগতের জীবন। যা হওয়া উচিত তা হওয়াটাও সেই জগতের-ই ধর্ম। পৃথিবীর মায়াবী নদীর পারের দেশ আর পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি হয়ে ওঠার মধ্যেই সেই সব অলীক সত্য, রহস্যঘন অলকা আর বিপুল দূরবিসারী কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা বেঁচে থাকে।
 

“ক্যাবলাদের ছোটবেলা” এখন থেকে প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে। শুক্রবার দেখুন “কোন পুরাতন প্রাণের টানে”। পরিবেশনায়, ড. অভিষেক ঘোষ, অধ্যাপক, বাগনান কলেজ।

* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content