অলঙ্করণ: লেখক।
পাড়ার মোড়ে গুচ্ছের লোক জমেছে। একেকজনের হাতে একেক যন্ত্র। দৌড়োদৌড়ি। একটা কাচ ঢাকা কালো বাস। ট্রাইপডে পেল্লায় ক্যামেরা। আশেপাশে লোকলস্কর, কারও হাতে খাতা, কারও হাতে ছাতা। টেবল, চেয়ার, ট্রলি, রেললাইন, মেকআপ, ব্রেকআপ, প্যাকআপ ইত্যাদি মিলিয়ে এলাহি কাণ্ড। একে শুটিং বলে।
এরপর শুরু হল একটা শুট আউটের দৃশ্য। একজন এগিয়ে আসছে। আরেকজন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বন্দুক বের করে ঘোড়া টিপল; ঢিচক্যাঁও… উল্টোদিকের লোকটা পড়ে গেল। এটাই বার বার ‘টেক’ করা হতে থাকল। সাড়ে তেত্রিশবারের পর সকলে গোনা ছেড়ে দিল। কিছুই একসঙ্গে পারফেক্ট হয় না… একবার দৌড়ে আসাটা ঠিক হয় তো পড়ে যাওয়াটা ভালো হয় না। আবার পড়াটা যদিও বা ‘চলেবল’ হয় তো, ঘোড়াটেপা ভালো হয় না। আর ঘোড়াটেপা যদিও বা উতরোয় তো সানগ্লাস খুলতে ডাঁটি ভেঙে যায়। শেষে সব যদিও বা ঠিক থাকে, মরা লোক ‘কাট’ বলার আগেই উঠে বসে। এই করে করে সূর্য ডুবে গেল। তখন শুটিং পার্টি প্যাকআপ করে চলে গেল। একজন উৎসাহী জানতে চেয়েছিল ফিল্মের নাম কী দাদা! সেই দাদা ফিচেল হেসে বলেছিলেন “তোর তাতে কী রে?”
শেষবেলা পাড়ায় একটা মারামারি লেগে যায় যায়!! শেষে জানা গেল ফিল্মের নামই “তোর তাতে কী রে?”
মানুষমাত্রেই চিন্তাশীল। পৃথিবীর বুকে হেঁটে-ছুটে-বেয়ে বেড়ানো অন্যান্য মনুষ্যেতরদের থেকে মানুষ ভিন্নতর এখানেই। এই ধরুন, আপনার আশেপাশে লালু-কালু-ভুলুরা নিজেদের পাড়া আগলাচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় উৎসবে, বিনোদনে, পতাকা তোলায়, কি দৌড় প্রতিযোগিতায় কিশোর-মান্না-হেমন্ত-লতাকণ্ঠীর কসরত; আর একটু রাত হলেই লালুরা সারাদিনের শেখা গানগুলোই একটু নিজেদের মতো করে পরিবেশন করতে চাইলে পাড়ার লোকজন তাদের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন চতুর্দশ মনুষ্যেতরগণকে নরকস্থ করেন। দ্বাপরে যুধিষ্ঠিরকে এদেরই একজন নরক ও স্বর্গ ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। সুতরাং, মানুষের দেওয়া তিরস্কার অথবা পুরস্কারে লালু-ভুলুদের তেমন কিছু আসে যায় না, সে বেশ দেখাই যায়। তাদের বংশগতি অথবা সঙ্গীতসাধনা কিছুই ব্যাহত হয় না।
এরপর শুরু হল একটা শুট আউটের দৃশ্য। একজন এগিয়ে আসছে। আরেকজন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে বন্দুক বের করে ঘোড়া টিপল; ঢিচক্যাঁও… উল্টোদিকের লোকটা পড়ে গেল। এটাই বার বার ‘টেক’ করা হতে থাকল। সাড়ে তেত্রিশবারের পর সকলে গোনা ছেড়ে দিল। কিছুই একসঙ্গে পারফেক্ট হয় না… একবার দৌড়ে আসাটা ঠিক হয় তো পড়ে যাওয়াটা ভালো হয় না। আবার পড়াটা যদিও বা ‘চলেবল’ হয় তো, ঘোড়াটেপা ভালো হয় না। আর ঘোড়াটেপা যদিও বা উতরোয় তো সানগ্লাস খুলতে ডাঁটি ভেঙে যায়। শেষে সব যদিও বা ঠিক থাকে, মরা লোক ‘কাট’ বলার আগেই উঠে বসে। এই করে করে সূর্য ডুবে গেল। তখন শুটিং পার্টি প্যাকআপ করে চলে গেল। একজন উৎসাহী জানতে চেয়েছিল ফিল্মের নাম কী দাদা! সেই দাদা ফিচেল হেসে বলেছিলেন “তোর তাতে কী রে?”
শেষবেলা পাড়ায় একটা মারামারি লেগে যায় যায়!! শেষে জানা গেল ফিল্মের নামই “তোর তাতে কী রে?”
মানুষমাত্রেই চিন্তাশীল। পৃথিবীর বুকে হেঁটে-ছুটে-বেয়ে বেড়ানো অন্যান্য মনুষ্যেতরদের থেকে মানুষ ভিন্নতর এখানেই। এই ধরুন, আপনার আশেপাশে লালু-কালু-ভুলুরা নিজেদের পাড়া আগলাচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় উৎসবে, বিনোদনে, পতাকা তোলায়, কি দৌড় প্রতিযোগিতায় কিশোর-মান্না-হেমন্ত-লতাকণ্ঠীর কসরত; আর একটু রাত হলেই লালুরা সারাদিনের শেখা গানগুলোই একটু নিজেদের মতো করে পরিবেশন করতে চাইলে পাড়ার লোকজন তাদের ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন চতুর্দশ মনুষ্যেতরগণকে নরকস্থ করেন। দ্বাপরে যুধিষ্ঠিরকে এদেরই একজন নরক ও স্বর্গ ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। সুতরাং, মানুষের দেওয়া তিরস্কার অথবা পুরস্কারে লালু-ভুলুদের তেমন কিছু আসে যায় না, সে বেশ দেখাই যায়। তাদের বংশগতি অথবা সঙ্গীতসাধনা কিছুই ব্যাহত হয় না।
তবে ওই সঙ্গীতই যদি মানুষের কণ্ঠ থেকে উদ্গত হয়, তবে তা বিশেষ বৌদ্ধিক প্রয়াস বলে বিবেচিত হয়, আর লালু-ভুলুদেরটা শুধুই ঘেউ ঘেউ। এই ব্যবস্থার একমাত্র উপভোক্তা মানুষ। সে নিজেই নিজেকে ‘চিন্তক’ এই আখ্যা দিয়ে ধন্য করেছে। তবে প্রতি মুহূর্তের মানবমনের সেই চিন্তারাশির মধ্যে সবটাই কি অনবদ্য? বিন্দুমাত্র ক্যাবলামির ছিটেফোটা নেই বুঝি তাতে? চিন্তা করে করেই মানুষ চাঁদে কী মঙ্গলে, মহাকাশে কী মহাসাগরে, নোবেলের মঞ্চে এমনকি পাড়ার ঠেকে জায়গা করে নেয়। চিন্তাশীলতা মানুষের মজ্জাগত ও পরম্পরায় পাওয়া এক দায়, যার ভাগ সে কাউকে ছেড়ে দিয়ে দু’দণ্ড স্বস্তি পাবে তার উপায় নেই। তার ফলাফল কীরকম হয়?
“চিন্তাশীল নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে। মা মাছি তাড়াইতেছেন।
মা: অত ভেবো না, মাথার ব্যামো হবে বাছা!
নরহরি: আচ্ছা মা,’বাছা’ শব্দের ধাতু কী বলো দেখি।
মা: কী জানি বাপু!
নরহরি: ‘বৎস’। আজ তুমি বলছ ‘বাছা’—দু-হাজার বৎসর আগে বলত ‘বৎস’—এই কথাটা একবার ভালো করে ভেবে দেখো দেখি মা! কথাটা বড়ো সামান্য নয়। এ কথা যতই ভাববে ততই ভাবনার শেষ হবে না।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কৌতুক, চিন্তাশীল।
চিন্তাশীল নরেন মায়ের প্রতিকথায় চিন্তাকুল হয়ে পড়ে। এমন চিন্তা করলে ক্ষেত্র ও সুযোগবিশেষে চিন্তাশীল মানুষ ক্ষ্যাপা, পাগলা অথবা ক্যাবলা এই অভিধা পেয়ে থাকে। সকলেই আইনস্টাইন হয়ে সমুদ্রের ধারে নুড়ি অথবা ক্ষ্যাপার মতো পরশপাথর খুঁজে ফেরে না বটে, তবে কেউ কেউ নরেন হয় তো বটেই।
“মা: যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কী বাপ! ভাবনা তো তোর চিরকাল থাকবে, ভাত যে শুকোয়। লক্ষী আমার, একবার ওঠ।
নরহরি: (চমকিয়া) কী বললে মা? লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বোঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলোককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে দেখো পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে! একবার ভেবে দেখো মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে।” (ভাবনায় দ্বিতীয় ডুব)
“চিন্তাশীল নরহরি চিন্তায় নিমগ্ন। ভাত শুকাইতেছে। মা মাছি তাড়াইতেছেন।
মা: অত ভেবো না, মাথার ব্যামো হবে বাছা!
নরহরি: আচ্ছা মা,’বাছা’ শব্দের ধাতু কী বলো দেখি।
মা: কী জানি বাপু!
নরহরি: ‘বৎস’। আজ তুমি বলছ ‘বাছা’—দু-হাজার বৎসর আগে বলত ‘বৎস’—এই কথাটা একবার ভালো করে ভেবে দেখো দেখি মা! কথাটা বড়ো সামান্য নয়। এ কথা যতই ভাববে ততই ভাবনার শেষ হবে না।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই কৌতুক, চিন্তাশীল।
চিন্তাশীল নরেন মায়ের প্রতিকথায় চিন্তাকুল হয়ে পড়ে। এমন চিন্তা করলে ক্ষেত্র ও সুযোগবিশেষে চিন্তাশীল মানুষ ক্ষ্যাপা, পাগলা অথবা ক্যাবলা এই অভিধা পেয়ে থাকে। সকলেই আইনস্টাইন হয়ে সমুদ্রের ধারে নুড়ি অথবা ক্ষ্যাপার মতো পরশপাথর খুঁজে ফেরে না বটে, তবে কেউ কেউ নরেন হয় তো বটেই।
“মা: যে ভাবনা শেষ হয় না এমন ভাবনার দরকার কী বাপ! ভাবনা তো তোর চিরকাল থাকবে, ভাত যে শুকোয়। লক্ষী আমার, একবার ওঠ।
নরহরি: (চমকিয়া) কী বললে মা? লক্ষ্মী? কী আশ্চর্য! এক কালে লক্ষ্মী বলতে দেবী-বিশেষকে বোঝাত। পরে লক্ষ্মীর গুণ অনুসারে সুশীলা স্ত্রীলোককে লক্ষ্মী বলত, কালক্রমে দেখো পুরুষের প্রতিও লক্ষ্মী শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে! একবার ভেবে দেখো মা, আস্তে আস্তে ভাষার কেমন পরিবর্তন হয়! ভাবলে আশ্চর্য হতে হবে।” (ভাবনায় দ্বিতীয় ডুব)
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ
আমাদের দেশে চিন্তাশীল মানুষের একান্ত অভাব আছে, এটা যেমন সত্য, তেমনই যথার্থ নয়-ও বটে। এই যেমন, আপনি কেন অমুক কাজটি করলেন, কাজটা না করলে কী এমন ক্ষতি হতো, করে কী জাতীয় লাভ হল, না করলে আপনি কী ধরণের বিপদের মুখে পড়তেন, কাজটি করেও আপনি কতটা বিপন্ন, আপনি বিপন্ন হলে কী করতেন, বিপন্ন না হলে কী করতেন ইত্যাদি নিয়ে আপনার থেকে আপনার পার্শ্ববর্তী বা পার্শ্ববর্তিনীদের মাথাব্যথা অনেকটাই বেশি। আমাদের চারপাশে ঘটনার ঘনঘটা। ঘটমান যে বর্তমান অথবা অনাগত যে আগামী, তার কালের পুতুলদের জন্য যে মঞ্চ প্রস্তুত রেখেছে সেখানে কেবলই ভাবনার উপাদান, চিন্তার বীজোদ্গম। কিন্তু কী তার বিষয়? অনেকাংশেই অসঙ্গতি। এই মঞ্চ থেকেই দেবদূতরূপী দাশু স্বর্গপানে বিদায় নেবে। তারপর মন্ত্রী যখন রাজাকে এসে সেই সংবাদ জানাচ্ছে “বারবার মহারাজে আশিস করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে”, তখন সেই দেবদূত যদি “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” বলে মঞ্চে এসে ঢোকে তখন কেমন হবে?
“… একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কী রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম— অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগাড় হয়ে এল। তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কী বলিতেছিলে।” তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল। রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কী যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গিয়েছে, অমনি দাশু “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”—বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা—“এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা” ইত্যাদিনিজেই গড়গড় করে ব’লে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” ব’লে অভিনয় শেষ করে দিল।”
“… একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত। হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কী রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম— অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগাড় হয়ে এল। তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কী বলিতেছিলে।” তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল। রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কী যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গিয়েছে, অমনি দাশু “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”—বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল। ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা—“এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা” ইত্যাদিনিজেই গড়গড় করে ব’লে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” ব’লে অভিনয় শেষ করে দিল।”
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩০: প্রচুর প্রোটিন, তাই যতখুশি ডাল খান?
আমাদের জীবনের রঙ্গমঞ্চটাও এমন ক্যাবলামিতে ভরা বুঝি। খুব চালাকি করে যা করতে চাও, তা আদতে বোকামি আর যা লজ্জায় করতে পারলে না, সেটাই হয়তো যথার্থ ছিল। নদীর এপার-ওপারের মধ্যে যে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের আদান-প্রদান, চোর পালালেই বুদ্ধির যে বাড়বাড়ন্ত আর, হাতের মাছটা পালিয়ে গেলে সেটাই ‘বড় ছিল গো’ বলে হাহাকারের যে জমা-খরচ তাতে কতটা আবেগ, কতটা বা বিচক্ষণ নৈপুণ্য, আর কতটাই বা ক্যাবলামি জমে ওঠে, জমে জমে পাহাড় হয় তার জল মাপে কে?
“এক বাও মেলে না। দো বাও মেলে—এ-এ না” বলতে বলতে মুখে হাসি টেনে রেখে এক অতুলনীয় অবাক জলপানের মাধুকরী দেখে অমূল্য বিস্ময়ের আবর্তে পাক খেয়ে অথবা পাকদণ্ডী বেয়ে “কূল কিনারা পরিহরি” নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে যদি নতুন এক ক্যাবলামিতে ভরা দুনিয়ায় এসে পৌঁছোন আপনি? সেটা হতে পারে তাসের দেশ, হতে পারে চাটুজ্জেদের রোয়াক, হতে পারে হেঁশোরাম হুঁশিয়ার-প্রফেসর শঙ্কু-হিজিবিজবিজ-দাশু-গঙ্গারাম-গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়াদের নাট্যমঞ্চ।
“এক বাও মেলে না। দো বাও মেলে—এ-এ না” বলতে বলতে মুখে হাসি টেনে রেখে এক অতুলনীয় অবাক জলপানের মাধুকরী দেখে অমূল্য বিস্ময়ের আবর্তে পাক খেয়ে অথবা পাকদণ্ডী বেয়ে “কূল কিনারা পরিহরি” নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে যদি নতুন এক ক্যাবলামিতে ভরা দুনিয়ায় এসে পৌঁছোন আপনি? সেটা হতে পারে তাসের দেশ, হতে পারে চাটুজ্জেদের রোয়াক, হতে পারে হেঁশোরাম হুঁশিয়ার-প্রফেসর শঙ্কু-হিজিবিজবিজ-দাশু-গঙ্গারাম-গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়াদের নাট্যমঞ্চ।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৫: রাজা যে কখন, কার উপর, কী কারণে সদয় হন সেটা জানা সত্যিই দুষ্কর
বিচিত্রের বৈচিত্র, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…
অসঙ্গতির দুনিয়ায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে একই বিষয়ের দ্বিমুখী সঞ্চার ঘটতে পারে। অভিমান, বিক্ষোভ, ক্রোধ যেমন তার একটি অভিমুখ, তেমনই আরেকটি হল বিদ্রুপ, উপহাস, ব্যঙ্গ। ক্ষেত্রবিশেষে একেকটি অধিক কার্যকর হয়। প্রশ্ন জাগে, অসঙ্গতির দুনিয়ামাত্রেই কি মজার দুনিয়া? এর উত্তর হ্যাঁ অথবা না। যদি না হয় তবে আপনি বলতেই পারেন,
“মালা জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও/ আমার লাগছে।”
যদি হ্যাঁ হয়, আপনি দাশুর মতো বলতে পারেন “কাঁচকলা খাও।”
অথবা, ওই অসঙ্গতির দুনিয়ায় একান্তই অসঙ্গত আপনি বলে উঠুন “আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটবে।” ওই ‘ফুল’ যদি জীবনের পাত্রখানি পূর্ণ না করে নিটোল বোকামি বা ক্যাবলামিতে ফুলে ফেঁপে উঠতে চায়, তবে জানবেন, আপনার হাতে পেনসিলটুকু তো আছে। দিগ্বিজয়ী বীর অর্জুনের হাতে সেটাও ছিল না। হাতের গাণ্ডীব ত্যাগ করে তিনি যখন বলতে থাকলেন, আমি পারব না, এ কাজ আমার দ্বারা হবে না গো, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁর এই ক্যাবলামিতে বিমূঢ় না হয়ে, মাথায় গাঁট্টা পর্যন্ত না মেরে, বোঝাতে লাগলেন। তার “ছোট্ট আমি” টাকে “বড়ো আমি” তে ক্রমে ক্রমে বসে জিরিয়ে টেনে বের করতে লাগলেন…যেমন করে জাদুকর ঐন্দ্রজালিক টুপিকে পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দেন অথবা রুমালকে করে দেন একটা আস্ত ম্যাঁও-বেড়াল। ওহে অর্জুন! মনের অন্দর-কন্দরের রিপুভয় থেকে বেরিয়ে এসে “যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া/ লাউমাচাটার পাশে/ ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল/ সন্ধ্যার বাতাসে”…ওখানেই খুঁজে পাবে তোমার লক্ষ্য, মোক্ষ, পাবে তোমার জীবন স্বামীকে।
“মালা জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও/ আমার লাগছে।”
যদি হ্যাঁ হয়, আপনি দাশুর মতো বলতে পারেন “কাঁচকলা খাও।”
অথবা, ওই অসঙ্গতির দুনিয়ায় একান্তই অসঙ্গত আপনি বলে উঠুন “আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটবে।” ওই ‘ফুল’ যদি জীবনের পাত্রখানি পূর্ণ না করে নিটোল বোকামি বা ক্যাবলামিতে ফুলে ফেঁপে উঠতে চায়, তবে জানবেন, আপনার হাতে পেনসিলটুকু তো আছে। দিগ্বিজয়ী বীর অর্জুনের হাতে সেটাও ছিল না। হাতের গাণ্ডীব ত্যাগ করে তিনি যখন বলতে থাকলেন, আমি পারব না, এ কাজ আমার দ্বারা হবে না গো, শ্রীকৃষ্ণ তখন তাঁর এই ক্যাবলামিতে বিমূঢ় না হয়ে, মাথায় গাঁট্টা পর্যন্ত না মেরে, বোঝাতে লাগলেন। তার “ছোট্ট আমি” টাকে “বড়ো আমি” তে ক্রমে ক্রমে বসে জিরিয়ে টেনে বের করতে লাগলেন…যেমন করে জাদুকর ঐন্দ্রজালিক টুপিকে পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দেন অথবা রুমালকে করে দেন একটা আস্ত ম্যাঁও-বেড়াল। ওহে অর্জুন! মনের অন্দর-কন্দরের রিপুভয় থেকে বেরিয়ে এসে “যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া/ লাউমাচাটার পাশে/ ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল/ সন্ধ্যার বাতাসে”…ওখানেই খুঁজে পাবে তোমার লক্ষ্য, মোক্ষ, পাবে তোমার জীবন স্বামীকে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৩০: কারণে-অকারণে পুরুষত্বের কাঠামো পরিবর্তন
হাত বাড়ালেই বনৌষধি, টেম্পেল ট্রি চাঁপার এই গুণগুলি সম্পর্কে জানতেন?
মনে পড়ে? সেই গাছের ডালের পাখিটাকে, অস্ত্রপরীক্ষায় তুমি তো তাকে ছাড়া কিছুই দেখতে পাওনি… সকলেই হেসেছিল অনেক, অবাক হয়েছিল এই আশ্চর্য ক্যাবলামিতে ক্ষণিকের জন্য, তারপর মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল, পরাজিত হয়ে। সেই তাদের কেউ কেউ আজ ওপারে দাঁড়িয়ে ধনুর্বাণ নিয়ে, সেদিন যে অসঙ্গত খাপছাড়া ক্ষ্যাপামির অভিষেক ঘটেছিল আজ নিষ্কাম কর্ম করে তার উদযাপন ঘটাও, ওঠো, লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থাকো অবিচল, বিচলিত হয়ে ব্যাকুল হয়ো না।
টেনিদা হলে হয়তো এতো ‘গীতা’ আওড়াতো না, এই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ না গেয়ে হয়তো একটা রাম গাঁট্টা কষাতো, ফুল ফুটতো চোখে সর্ষে ক্ষেতের মতো, ফুলেল ক্যাবলামি ছেড়ে অর্জুন হয়তো বলে উঠতেন “ডি লা গ্রান্ডি”…
গাছের ডালে ফলভোগী ক্যাবলা পাখিটার পাশে স্বয়ং কৈবল্যের অবস্থান, যেমন ক্যাবলা-প্যালা-হাবলার পাশে টেনি, তোপসের পাশে ফেলু, সন্তুর পাশে কাকাবাবু অথবা যদুপতির পাশে পার্থ। তাঁরা পদে পদে বোকামির অনুপ্রেরণা দিয়ে তুলেও ধরেন সেই আবর্ত থেকে। “ক্ষুদ্র আমি”দের ছোটবেলার ছোট ছোট বেদনাহত অনিশ্চয় সংশয় আর অপটু হাতের আড়বাঁশি থেকে যে সুর ঘনিয়ে ওঠে, তার মায়া-অশ্রু-মজা মিশে যে সারল্য, বোকামিতে ভরা আর বিপরীত অথবা ভিন্ন স্বরের যে ক্যাবলামি, তাই তোমার জয়মাল্য, কখনো তা মরণফাঁস, কখনও বুঝি অপমানজর্জর বন্ধনরজ্জু, তবু…অনন্ত জাগে!!!
ঋণ স্বীকার:
● পাথরের ফুল: সুভাষ মুখোপাধ্যায়
● আবহমান: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
● দাশুর খ্যাপামি: সুকুমার রায়
টেনিদা হলে হয়তো এতো ‘গীতা’ আওড়াতো না, এই ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ না গেয়ে হয়তো একটা রাম গাঁট্টা কষাতো, ফুল ফুটতো চোখে সর্ষে ক্ষেতের মতো, ফুলেল ক্যাবলামি ছেড়ে অর্জুন হয়তো বলে উঠতেন “ডি লা গ্রান্ডি”…
গাছের ডালে ফলভোগী ক্যাবলা পাখিটার পাশে স্বয়ং কৈবল্যের অবস্থান, যেমন ক্যাবলা-প্যালা-হাবলার পাশে টেনি, তোপসের পাশে ফেলু, সন্তুর পাশে কাকাবাবু অথবা যদুপতির পাশে পার্থ। তাঁরা পদে পদে বোকামির অনুপ্রেরণা দিয়ে তুলেও ধরেন সেই আবর্ত থেকে। “ক্ষুদ্র আমি”দের ছোটবেলার ছোট ছোট বেদনাহত অনিশ্চয় সংশয় আর অপটু হাতের আড়বাঁশি থেকে যে সুর ঘনিয়ে ওঠে, তার মায়া-অশ্রু-মজা মিশে যে সারল্য, বোকামিতে ভরা আর বিপরীত অথবা ভিন্ন স্বরের যে ক্যাবলামি, তাই তোমার জয়মাল্য, কখনো তা মরণফাঁস, কখনও বুঝি অপমানজর্জর বন্ধনরজ্জু, তবু…অনন্ত জাগে!!!
ঋণ স্বীকার:
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।