শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

ক্যাবলামি আর ভালোমানুষি কোথাও যেন হাত ধরে চলে। বনভোজনে প্যালা একটা আইটেম জুড়ে দিয়েছিল। রাজহাঁসের ডিম। সেটাই আনতে গেছে প্যালা ভন্টার বাড়িতে। আইসক্রিমের লোভ দেখালেও ভন্টা ভোলে না। নিজেরা পোলাও-কালিয়া খেয়ে তার বেলায় আইসক্রিম কেবল! সে প্যালাকে সোজা রাজহাঁসের খোঁয়াড় দেখিয়ে দেয়।

“ফোঁসফোঁস করছে যে!
ভন্টা উৎসাহ দিলে: ডিম নিতে এসেছিস—একটু আপত্তি করবে না? তোর কোনও ভয় নেই প্যালা, দে হাত ঢুকিয়ে।”
প্যালা হাত ঢোকায় ও রাজহাঁসের রাজকীয় কামড়ে রক্তারক্তি ঘটে। শাস্ত্রে লেখে “যঃ পলায়তে স জীবতি”, অতয়েব সেটাই ঘটে। অথচ এই ভন্টা “চিয়ার আপ প্যালা। লেগে যা!” বলে উৎসাহিত করেছিল, আর প্যালাও বেকুবের মতো হাত বাড়িয়েছিল আগুনের দিকে। কিন্তু ব্যাপারটা এমনি এমনি ঘটেনি।
“কিন্তু কী খলিফা ছেলে ভন্টা! দু-আনার পাঁঠার ঘুগনি আর ডজনখানেক ফুলুরি সাবড়ে তবে মুখ খুলল।
—ডিম দিতে পারি, তবে, নিজের হাতে বার করে নিতে হবে বাক্স থেকে।”
সাধু সাবধান!

প্যালা মনে মনে ভন্টার মুণ্ডুপাত করতে করতে অদূর ভবিষ্যতে তার নিষ্ফল খরচের হিসাব বুঝে নেওয়ার কথা ভাবে, কিন্তু বিধি বাম।
“কী করা যায়—গাঁটের পয়সা দিয়ে মাদ্রাজি ডিমই কিনতে হল গোটা কয়েক।”

এই প্যালারামকে আমরা এ ভাবে দেখি অন্যত্র:
“আমি দুবার অঙ্কের জন্যে ডিগবাজি খেয়েছি—এবার থার্ড ডিভিশনে পাশ করলেও করতে পারি”
প্যালারামের কথা আরও আসবে। আসতে হবেই। আপাতত একটা কবিতার দু’ছত্র শোনা যাক:
“দ্রিমিকি দ্রিমিকি দেরে গায় প্যালা গলা ছেড়ে তাধিন তাধিন তানা ধিন তানা দেরে না / প্যালারাম গান গায় কাছে কেউ ভেড়ে না/গান গায় প্যালারাম কাছে কেউ ভেড়ে না।” (ছন্দযুদ্ধ / উপেন্দ্রচন্দ্র মল্লিক)
প্যালা যদি কিছু বলার চেষ্টা করে টেনিদা তখন কী করে?
“থাম বলছি প্যালা—থামলি?

—টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, যেমন তোর ছাগলের মতো লম্বা লম্বা কান, তেমনি ছাগলের মতো বুদ্ধি!” ইত্যাদি ইত্যাদি।

ক্যাবলামি যাদের রক্তে থাকে তারা মনুষ্যপদবাচ্য বলেই বিবেচিত নয় আসলে। তাদের অবস্থান লুকোচুরি খেলায় “দুধ-ভাতে”-র এক্সট্রার মতো, রাখতে হয়, নিজেদের বিনোদনের জন্য, না রাখলে ক্ষতি কিছু হয় না, রাখলেও কোনও উপকার নেই। এরাই ক্রিকেট খেলতে গেলে বল কুড়ানোর মহান দায়িত্ব পায়, ফুটবলে লাইনের ধারে ধারে বল আটকায়, আর নাটক করতে গেলে কাটা সৈনিকের পার্ট পায়। তারপর এসে বলে ‘ঐ লোকটা না মরলে তো গল্পটাই হতো না, আমিই ছিলাম নায়কের রোলে, হোক না মরা, মরা হাতিই তো লাখ লাখ টাকা না?’ আমরা শুনে খুব হাসি বা অন্য কিছু করি, কিন্তু সুকুমারের দাশু যখন এমনটাই করে তখন খানিক থমকাই।

দাশুর কথায় আসা যাবে। আমরা তার আগে দেখে নিই প্যালা কী করছে:
“আমাদের বাড়ির সামনে একটুখানি পাঁচিল-ঘেরা জায়গা। সেখানে বড়দার সিল্কের পাঞ্জাবি শুকুচ্ছে—নিজের হাতে কেচেছে বড়দা। আর একপাশে বাঁধা রয়েছে ছোড়দির আদরের ছাগল গঙ্গারাম। বেশ দাড়ি হয়েছে গঙ্গারামের।”

গঙ্গারাম। সেই গঙ্গারাম। কী আশ্চর্য তাই না!!
“ছাগলের খালি দাড়ি হয় অথচ কান পর্যন্ত গোঁফ হয় না কেন, এই কথাটা খুব দরদ দিয়ে ভাবছিলুম। ঠিক তক্ষুনি চোখে পড়ল–গঙ্গারাম এগিয়ে এসে বড়দার সিল্কের পাঞ্জাবিতে মুখ দিয়েছে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলুম। একটু আগেই বড়দা আমাকে গাধা-ছাগল এইসব বলেছে। খেয়ে নিক সিল্কের পাঞ্জাবি বেশ জব্দ হয়ে যাবে।”
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৫: কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ প্রাজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সর্বত্যাগীর কেন এই মায়াবন্ধন?

একে আপনি ক্যাবলা বলবেন নাকি বদমাস নাকি সেয়ানা! তারপরেই দেখা যায়
“ঢুকেই মেজদা চেঁচিয়ে উঠল: কী সর্বনাশ! ছাগল যে বড়দার জামাটা খেয়ে ফেললে! এই প্যালা ইডিয়ট-হতভাগা বসে বসে মজা দেখছিস নাকি?”

সত্যজিৎ রায় মোল্লা নাসিরুদ্দিনের কথা বলেছেন এইভাবে:
“মোল্লা নাসিরুদ্দিন ঠিক কেমন লোক ছিলেন তা তার গল্প পড়ে বোঝা মুশকিল। এক এক সময় তাকে মনে হয় বোকা, আবার এক এক সময় মনে হয় ভারী বিজ্ঞ। তোমাদের কী মনে হয় সেটা তোমরাই বুঝে নিও।”

ক্যাবলামি নিয়ে এর থেকে ভালো মূল্যায়ন পাওয়া মুশকিল।
এই ক্যাবলামি করে প্যালা যে ডিমের ব্যবস্থা করেছিল তা নিয়েই বনভোজনের পথে চলল সকলে। সঙ্গে আর সব উপকরণ।
“টেনিদা চোখ পাকাল: খবরদার প্যালা, ওসব মতলব ছেড়ে দে। টুপটাপ করে দু-চারটে গালে ফেলবার বুদ্ধি, তাই নয়?– বাবা–চালাকি ন চলিষ্যতি।”

এই যে “খাই খাই” পর্ব, সুকুমার জানাচ্ছেন—
“ভ্যাবাচ্যাকা খেও নাকো, যেয়ো নাকো ভড়কে/ খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে ।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা—
খাও তবে কচু পোড়া, খাও তবে ঘণ্টা।”

ক্যাবলাদের জীবনের সব বনভোজনগুলোর স্বাদ কি তবে কচুপোড়ায় এসে ঠেকে?
“কিন্তু তিন পাও যেতে হল না। তার আগেই ধাঁইধপাস্! টেনে একখানা রাম-আছাড় খেল হাবুল।
—এই খেয়েছে কচুপোড়া!–টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল।
সারা গায়ে কাদা মেখে হাবুল উঠে দাঁড়াল। হাতের ডিমের পুঁটলিটা তখন কুঁকড়ে এতটুকু—হলদে রস গড়াচ্ছে তা থেকে।
ক্যাবলা বললে, ডিমের ডালনার বারোটা বেজে গেল।”

এরপরেও টেনিদা বলবে শাট্ আপ্ ক্যাবলা!?
আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বাংলাভাষার স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক প্রয়োগ ও বিস্তারে তাঁর অবদান ভোলার নয়/১

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৫: পঞ্চমের অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে একটি কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয় ‘নদিয়া সে দরিয়া’ গানটি

রবি ঠাকুর বলেছিলেন বটে, পণ্ডিতরাই পণ্ড করে সব। আর পণ্ডিতমূর্খরা তো আছেই। মহাভারতে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে জানাচ্ছেন, যাঁদের সর্বত্রগামিনী বুদ্ধি ধর্মার্থের অনুসারিণী, কামকে পরিত্যাগ করে অর্থকেই আশ্রয় করে তাঁরা পণ্ডিত। তাই হয়তো টেনিদা ভজহরি মুখুজ্জে ক্যাবলাকে ঝালমুড়ি কেনার নির্দেশ দেয়, আর মহামূর্খ সে-ই যে নিজে দোষযুক্ত হয়েও সেই দোষে অপরের নিন্দা করে আর প্রভুত্ব না থাকলেও ক্রুদ্ধ হয়, সে অতিমূর্খ ব্যক্তি।
ক্যাবলামি!!

ক্যাবলা অবশ্য অতটাও নয়, যতটা বিদুর ভাবতেন। টেনিদার বিরুদ্ধতা করলেই তার হিসেব চোকাতে হয়, রকের আড্ডায় টেনিদার ভুল ধরিয়ে ক্যাবলার ফাইন হয়, তাকে ঝালমুড়ি আনার আদেশ দেয় টেনিদা।

“আলুভাজা-আলুভাজা মুখ করে ক্যাবলা ফাইন আনতে গেল। ওর দুর্গতিতে আমরা কেউ দুঃখিত হলুম না বলাই বাহুল্য। সব কথাতেই ক্যাবলা ওরকম টিকটিকির মত টিকটিক করে।”

আচ্ছা, যারা ক্যাবলা বলে দাগিয়ে বেড়ায় সকলকে, তাদের চালচলন কেমন?
“টেনিদা বললে, ছোঃ! ওসব বাজে কথা! ভূত-টুত বলে কিছু নেই মেসোমশাই। আমরা চারজনেই যাব। ভূত যদি থাকেই, তাহলে তাকে একেবারে রাঁচির পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়ে তবে ফিরে আসব কলকাতায়। আর…

কিন্তু তারপরেই আর কিছু বলতে পারল না টেনিদা হঠাৎ থমকে গিয়ে দু’ হাতে হারুল সেনকে প্রাণপণে জাপটে ধরল”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

কী হয়েছিল তখন? সত্যিই কি ভূত নেমেছিল সেদিন?
“পৈশাচিক অট্টহাসিটা থামিয়ে মেসোমশাই বললেন, একটা হুলো-বেড়াল দেখেই চোখ কপালে উঠল, তোমরা যাবে সেই ডাক বাংলোয়!—ভেংচি কাটার মতো করে আবার খানিকটা খ্যাঁকঘেঁকে হাসি হাসলেন ভদ্রলোক: বীর কী আর গাছে ফলে!”
এই টেনিদার প্রোফাইল দেখার মতো…

“আর টেনিদা—
তার কথা না বলাই ভালো। সে ম্যাট্রিক দিয়েছে কে জানে এনট্রান্সও দিয়েছে কি না। এখন স্কুল ফাইন্যাল দিচ্ছে—এর পরে হয়তো হায়ার সেকেন্ডারিও দেবে। স্কুলের ক্লাস টেন-এ সে একেবারে মনুমেন্ট হয়ে বসে আছে—তাকে সেখান থেকে টেনে এক ইঞ্চি নড়ায় সাধ্য কার!
টেনিদা বলে, হেঁ—হেঁ–বুঝলিনে? ক্লাসে দু-একজন পুরনো লোক থাকা ভালো মানে, সব জানে-টানে আর কি!”

একটা জায়গায় পৌঁছে যেন মনে হতে থাকে, টেনি, গঙ্গারাম, প্যালারাম, দাশু ইত্যাদি সকল চরিত্রগুলিই যেন এক… একটাই চরিত্র, সকলেই যেন ক্যাবলামির জ্বরগ্রস্ত। অন্যদিকে, যারা ‘ক্যাবলা’ অভিধা নিয়ে চলে, তারা সত্যিই বোকা হোক বা না হোক, এদের অস্তিত্বের জন্য তাদের “ক্যাবলামি”টা অপরিহার্য বটে!

ঋণ:
● নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (বনভোজনের ব্যাপার, চারমূর্তির অভিযান, চারমূর্তি, ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ)
● সুকুমার রায় (খাই খাই)
* ক্যাবলাদের ছোটবেলা (kyablader-chotobela): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content